• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

গাজীপুরের নির্বাচনই বলে দিতে পারে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে

প্রকাশ:  ২৬ জুন ২০১৮, ১৫:৫৭ | আপডেট : ২৬ জুন ২০১৮, ১৬:০০
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

২৬ জুন মঙ্গলবার গাজীপুরে নতুন মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনের দিন। দেশে সম্প্রতি অনেক নির্বাচন হয়েছে; কিন্তু গাজীপুরের এই নির্বাচনের মতো সেগুলো এত গুরুত্ব পায়নি। সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ এখন এই গাজীপুরের দিকে। আগামী সাধারণ নির্বাচন যদি যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বাকি আছে আর মাত্র পাঁচ মাস। সন্দেহ নেই, গাজীপুরের এই নির্বাচনই বলে দিতে পারে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে অথবা আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে কী ঘটবে? গাজীপুর কি ইতিহাস গড়বে, না ইতিহাসের গতি রুদ্ধ করবে? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে গাজীপুরের মানুষের কাছ থেকে।

মেয়র পদে প্রার্থী সাতজন। ২৫৬ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৮৪ জন প্রার্থী রয়েছেন। মোট ভোটারসংখ্যা সাড়ে ১১ লাখের মতো। বলতে গেলে এই সাড়ে ১১ লাখ মানুষ এখন বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারক। বাংলাদেশে—বাংলাদেশ কেন, সারা উপমহাদেশেই নির্বাচন ও উপনির্বাচনের আগে যা ঘটে, বাংলাদেশেও তা-ই ঘটছে। ক্ষমতাসীন দল দাবি করছে, নির্বাচন এক শ ভাগ স্বচ্ছ ও অবাধ হবে এবং প্রধান বিরোধী পক্ষ থেকে রব তোলা হচ্ছে নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ ও পুলিশের হয়রানির।

সম্পর্কিত খবর

    পূর্বপশ্চিম বিশ্বকাপ কুইজে অংশ নিতে ক্লিক করুন।

    গাজীপুরের নির্বাচনেও যথারীতি এ ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি প্রচার করেছে, তাদের প্রার্থীর প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রার্থীর সমর্থকদের পুলিশ হয়রানি করেছে, মিথ্যা মামলা দিয়েছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার এই অভিযোগ তো তুলেছেনই, সেই সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা, যেমন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

    যদিও মেয়র পদে প্রার্থী সাতজন। কিন্তু সবাই জানেন, নির্বাচনী লড়াইটা হবে মূলত আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের মধ্যে। জাহাঙ্গীর আলম বয়সে তরুণ এবং জনপ্রিয়। হাসানউদ্দিন সরকার বয়োবৃদ্ধ এবং অতীতে এমপি, চেয়ারম্যান ইত্যাদি বহু পদে ছিলেন এবং বহু ঘাটের জল খেয়েছেন। বিভিন্ন পদে থাকার সময় তাঁর কার্যকলাপের সমালোচনাও আছে। এরশাদের সামরিক শাসনেরও তিনি একজন সহযোগী ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলমের বয়স ৩৯। আর হাসান সরকারের বয়স ৭০। এদিক থেকে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচনকে বার্ধক্য ও তারুণ্যের মধ্যে লড়াই বলা চলে।

    এই লড়াইয়ের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। বিএনপি প্রার্থী এবং তাঁর দলের একজন শীর্ষ নেতা—দুজনই প্রচণ্ড হুমকির সুরে কথা বলেছেন। অনেকটাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেমে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অভব্য হুমকি দিয়ে কথা বলেছিলেন, বাংলাদেশে একটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কণ্ঠে সেই হুমকি ও দম্ভের সুর। নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে আমার পরাজয় হলে সেই পরাজয় আমি মানব না। আমি গোটা আমেরিকা অচল করে দেব।’ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে নেমে বিএনপি প্রার্থী হাসান সরকার ট্রাম্পের চেয়েও গলার স্বর উঁচিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচনে হয়রানি বন্ধ না হলে এমন কাজ করব, যা সারা বিশ্ব স্মরণ রাখবে।’

    তিনি তাঁর দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশি অভিযানের অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘আমি আগেও একটা ঘোষণা দিয়েছি যে হয়রানি বন্ধ না হলে আমি এমন একটা কর্ম করব, তাতে সমাজের ক্ষতি হবে না; কিন্তু চিরদিন যেন এই বিশ্ব স্মরণ করে—নির্বাচনের জন্য হাসানউদ্দিন সরকার এই কর্মটি করেছেন।’ এই কর্মটি কী, তা তিনি বিশ্লেষণ করেননি। কিন্তু আমার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই—গত সাধারণ নির্বাচনের আগে এবং পরেও বিএনপি নেতারা রাজপথে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস শুরু করেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য সরকার উচ্ছেদ। দেশের ক্ষতি করা নয়। কিন্তু এই ‘আন্দোলনে’ কত শত নিরীহ নর-নারীকে পেট্রলবোমা হামলায় হত্যা করা হয়েছিল, বিশ্ববাসী তা-ও অবশ্যই স্মরণ রেখেছে।

    হাসানউদ্দিন সরকার যে হুমকি দিয়েছেন, তাতে আরো চড়া সুর লাগিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক আলোচনাসভায় বলেছেন, ‘খুলনার মতো গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।’ এই হুমকি দেওয়ার পরই তিনি বলেছেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’ মওদুদ আহমদ যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা তো বোঝা যায় দু-দুজন সামরিক শাসকের সেবাদাসের রাজনীতি করা থেকে। তাঁর সরকারের আমলে মাগুরা উপনির্বাচন এবং ছিয়ানব্বই সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে যে কাণ্ডকীর্তি হয়েছিল, তারপর খুলনা সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচন নিয়ে কথা বলা তাঁর মুখে সাজে কি? এ তো সেই প্রবাদবাক্যের মতো—‘সুচ বলে চালুনি, তোর কেন এত ফুটো?’

    মওদুদ বলেছেন, ‘গাজীপুরের নির্বাচনের পর আমরা ঠিক করব, আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব বাকি তিনটি সিটি করপোরেশন অর্থাৎ বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচনে যোগ দেব কি না?’ কথাটার অর্থ খুবই প্রাঞ্জল। গাজীপুরে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে পরাজিত হলেও বলবেন, ভোট কারচুপি হয়েছে। এবং সেই অজুহাতে পরবর্তী করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করে আরো পরাজয়ের দায় এড়াবেন। সাধারণ নির্বাচন বর্জনেরও হুমকি দেবেন। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভীষ্মের মতো স্বেচ্ছায় শরশয্যা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ যেকোনো নির্বাচনে স্বেচ্ছায় পরাজিত হয়ে প্রমাণ করতে হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে।

    মওদুদ দাবি করেছেন, ‘গাজীপুরে অসম্ভব জনসমর্থন রয়েছে ধানের শীষের পক্ষে।’ তা-ই যদি হবে, তাহলে নির্বাচনের আগে ফ্যাসিবাদী কায়দায় এই হুমকি-ধমকি কেন? নির্বাচনের আগে এ ধরনের হুমকি দেয় ভারতের শিব সেনা, আরএসএস প্রভৃতি দল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড টাম্পও দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম খান নির্বাচনে বিপক্ষকে হুমকি দিয়েছিলেন, ‘শির কুচল দেঙ্গে।’ অর্থাৎ ‘মাথা ভেঙে দেব।’ বাংলাদেশে গাজীপুর নির্বাচনে পরাজিত হলে মওদুদ ও হাসান সরকার কি একই কাণ্ড করার আগাম হুমকি দিচ্ছেন?

    গাজীপুরে যদি বিএনপি প্রার্থীর এতই জনপ্রিয়তা থাকে, তাহলে বিএনপি শিবিরে পরাজয়ের এই শঙ্কা কেন? ভোটে হস্তক্ষেপ বা কারচুপি হলে তো সচেতন জনগণই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কেন, চট্টগ্রামে একবার প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে মেয়র নির্বাচনে জয়ী হতে না দেওয়ার জন্য বিরাট চক্রান্ত হলে বিশাল জনপ্রতিরোধ কি গড়ে ওঠেনি? তিনি কি লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হননি? আবার এই নির্বাচকমণ্ডলী যখন বিগড়ে গেছে, তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী কি লক্ষাধিক ভোটে হেরে যাননি? কই, খুলনার সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচনে তো কোনো জনপ্রতিবাদ বা জনপ্রতিরোধ দেখা যায়নি। শুধু অভিযোগ শোনা গেছে বিএনপি নেতাদের মুখে। এই অভিযোগ তো তাঁরা নির্বাচনে পরাজিত হলেই তোলেন। তাতে নতুনত্ব আছে কি? পরাজয়ের গ্লানি মোছার জন্য এই ভাঙা রেকর্ড তাঁদের বাজাতেই হয়।

    গাজীপুর নির্বাচনে ‘পুলিশি হয়রানি, গণগ্রেপ্তার ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের’ লিখিত অভিযোগ বিএনপি প্রার্থী নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন, তার পরই এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের সময় না দিয়েই বিশ্বকাঁপানো কাণ্ড করার এই গর্জন কেন? এই ভীতি কাকে দেখানো হলো, শুধু সরকারি দলকে না ভোটদাতা সাধারণ মানুষকেও? এই হুমকি ও তর্জন-গর্জনের মধ্য দিয়েই বিএনপির স্বৈরাচারী ও সন্ত্রাসী মূর্তিটি জনসমক্ষে আবার প্রদর্শিত হলো।

    গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। এই যুবা বয়সী প্রার্থীর কোনো বিতর্কিত অতীত নেই। জনহিতকর বহু কাজে তাঁর ভূমিকা আছে। তিনি জনপ্রিয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়েও নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো হুমকি-ধমকি দেননি। কিছু বাস্তব তথ্য তুলে ধরেছেন। শহরে জলাবদ্ধতার জন্য তিনি বিএনপি নেতাদের দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, হাসান সরকার টঙ্গী পৌরসভার দুইবার মেয়র ছিলেন। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। দুইবার সংসদ সদস্য ছিলেন, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মেয়র বিএনপির। অথচ শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা নেই। অন্ত নেই মানুষের দুর্দশার। তিনি নির্বাচিত হলে গাজীপুরকে একটি বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

    প্রতিদ্বন্দ্বী হাসান সরকারের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমি বলব, উনি আমাদের একজন মুরব্বি মানুষ। মিথ্যাচার না করে মানুষের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। মাঠে নেমে মানুষের কাছে ভোট চাওয়া উচিত। তাঁরা ৪০ বছরে কী করেছেন, ভবিষ্যতে কী করবেন—মানুষের সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত।’ আমার ধারণা, তাঁর এই সহজ-সরল উক্তি ভোটারদের মনে দাগ কাটবে। তবে নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ দুই পক্ষেরই উচিত নির্বাচনে পুলিশি হয়রানি ও অন্যান্য উপদ্রব সম্পর্কে বিএনপি নেতারা যে অভিযোগ তুলেছেন, তাকে একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে তার যথাযোগ্য তদন্ত করা এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা না হলে নির্বাচনে জয়ী হলেও অভিযোগগুলো জনমনে দাগ কেটে থাকবে। নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ থাকবে বিএনপির।

    আগেই বলেছি, গাজীপুরের নির্বাচন একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলেও সময় ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এটি জাতীয় জীবনের একটি বড় দিকনির্দেশক নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সে জন্য এই নির্বাচন সব ধরনের কারসাজিমুক্ত এবং সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া প্রয়োজন। তাহলে এই নির্বাচনের ফলাফল দেখে বোঝা যাবে, মানুষের মনমানসিকতার ঘড়ির কাঁটা কোন দিকে ঘুরছে? একটি গণতান্ত্রিক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে, না অন্ধকার অতীতের দিকে? নির্বাচনী প্রচারণা শুধু বিপক্ষের সমালোচনা নয়, জনগণের মনমানসিকতাকেও সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা। গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করবে, আওয়ামী লীগ দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় জনগণের এই মনমানসিকতা তৈরিতে কতটা সক্ষম হয়েছে।

    সূত্রঃ কালের কন্ঠ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close