• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মোবাইল ফোনে হ্যালো বললেই মিলছে ইয়াবা

প্রকাশ:  ২১ জুন ২০১৮, ১২:০৫
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়ে এগোলে বাম পাশে র‌্যাব ২-এর ২ নম্বর কম্পানি কার্যালয়। আরেকটু সামনে ডান পাশে বাঁশবাড়ি বস্তি। রাস্তার পাশে টং দোকানে বসে কয়েকজন যুবক। তাঁদের কাছে এলাকার পরিস্থিতি জানতে চাইলে দুজন বলেন, ‘আরে ভালো না। দেখেন না ঝামেলা, অভিযান...।’ এলাকায় কি এখন পাওয়া যায়? এমন প্রশ্নে দোকানি চুপ। বেঞ্চিতে বসা রোগা চেহারার একজন এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলেন, ‘কী লাগব?’ এই প্রতিবেদক বলেন, ‘ইয়াবা। দু-তিন পিস হলেই হবে।’ ওই যুবক চোখের ইশারায় দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। কিছুক্ষণ পর কাছে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। পরিচয় গোপন করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জানানো হয়। আস্থা তৈরির পর ওই যুবক জানান, তাঁর নাম জাফর। লেগুনাচালক। নিজের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে ‘লোকজন চায় এ কারণে বাবা (ইয়াবা) বেচি। এখন তো দিনকাল খারাপ। মাল কম। তিন (তিন শ) করে নিতে পারবেন।’ হাঁটতে হাঁটতে বলেন জাফর। প্রতিবেদক কৌশল পাল্টে বলেন, ‘৫০ পিস লাগবে। বিকেলে যোগাযোগ করব।’ তখন জাফর আরেকটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে বলেন, ‘বেশি লাগলে আগে জানাইয়েন। আমার ভাগিনার নম্বর। বোঝেন তো এগুলা একা হয় না।’ অভিযানের মধ্যে কারবার কিভাবে করছেন—জানতে চাইলে জাফর বলেন, ‘পুলিশ ম্যানেজ করেই করতে হয়।

তয় ঝামেলায় পড়লে আর চিনে না। তারাই এখন সাবধানে থাকতে কয়। কারণ অনেক সংস্থা আছে...।’

গতকাল বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে বাঁশবাড়ী বস্তির নূরুল ইসলাম স্টোরের সামনে জাফরের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেখানে ঘুরলে বা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মিলবে ইয়াবা। ওই বস্তিতে গত ৫ জুন অভিযান চালিয়ে ২০০ পিস ইয়াবাসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মাদক সম্রাজ্ঞী মনিরা বেগম মনির বাড়ি থেকে এয়ারকুলার, টিভি, ফ্রিজ উদ্ধার করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। গতকাল সরেজমিনে গেলে কয়েকজন বাসিন্দা জানান, অভিযানের আগেই খবর পেয়ে পালিয়ে যায় মাদক কারবারিরা। ঈদের আগে থেকে আবার সেখানে চলছে মাদক বিক্রি। তবে প্রকাশ্যে নয়, মোবাইল ফোনে ও লুকিয়ে চলছে কারবার।

শিয়া মসজিদের এক কিলোমিটার দূরে জেনেভা ক্যাম্পে গতকাল বুধবারই ফের তিন ঘণ্টার অভিযান চালায় পুলিশ। ঢাকার সবচেয়ে বড় মাদকের এই আখড়ায় অভিযানের সময় পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি তালিকাভুক্ত কোনো বড় মাদক কারবারিকে। গতকাল ৭০০ পিস ইয়াবাসহ সন্দেহভাজন ৫১ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

স্থানীয়রা জানায়, ঈদের আগে কয়েকজন তালিকাভুক্ত কারবারি ক্যাম্পে ফিরে ফের মাদক বিক্রি শুরু করেছে। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মর্ডান স্কুলের গেটে ইয়াবা বিক্রি করে তারা। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ক্যাম্পের পাশে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

কয়েকজন বাসিন্দা দাবি করে, জেনেভা ক্যাম্পে গতকাল বুধবার সকালে অভিযানের আগাম তথ্য পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই সটকে পড়েছে কারবারিরা। জানান দিয়ে দিনের বেলায় অভিযান চালানোর কারণে কারবারিরা ধরা পড়ে না। উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অভিযানে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের কেউই কারবারি নয় বলে দাবি করে তাদের স্বজনরা। গত ২৭ মে ক্যাম্পে র‌্যাবের অভিযানে ১৫৩ জন গ্রেপ্তার হলেও বড় কোনো কারবারি ছিল না।

এদিকে পল্লবীর কালশী, বিহারী ক্যাম্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। মোবাইল ফোনে ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিক্রি করা হচ্ছে ইয়াবা। রাতে দুটি স্পটে ইয়াবা সেবনের তথ্যও পাওয়া গেছে।

গতকাল সকাল ১০টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও কে-৯ ডগ স্কোয়াডের তিন শ সদস্য জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান শুরু করে। ১১টার দিকে পাঁচজনকে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে তুলতে দেখা যায়। ইমরান নামে এক ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই পাঁচজনের মধ্যে দুজনকে আমি চিনি। তারা মাদক ব্যবসা করে না।’

বি ব্লকের বশিরের বাসায় তল্লাশির সময় সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন শাবানা বেগম নামের এক নারী। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী আজগর আলীকে আটক করেছে পুলিশ। আজগর রিকশার গ্যারেজে কাজ করেন। তিনি মাদকের সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি শাবানার। পাশে থেকে এগিয়ে এসে কয়েকজন নারী জানায়, ক্যাম্পে মাদক কারবার যারা করছে তারা খবর পেয়ে রাতেই সরে পড়েছে। র‌্যাবের অভিযানের পর বন্ধ থাকলেও ঈদের আগ থেকে ফের ইয়াবা বিক্রি শুরু হয়েছে। মডার্ন স্কুলের সামনে চায়ের দোকানে ওসমান, আমিন, সুলতান, মনসুরের গলির জুম্মন, জামিল সন্ধ্যা থেকে ইয়াবা বিক্রি করছেন।

ওই নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় দুই যুবককে পুলিশ আটক করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। নারীরা জানায়, তাদের একজন আসাদ, যিনি আগে জরির কাজ করতেন। মাদক কারবারিদের সঙ্গে তাঁর সখ্য আছে বলে জানায় কয়েকজন। ওই সময় শাহাজাদা নামের এক মাদক কারবারির বাসা থেকে একটি এলইডি টিভি জব্দ করে নিতে দেখা যায়। নারীরা জানায়, শাহাজাদাও আগে জরির কাজ করতেন। গত চার বছরে ইয়াবা কারবার করে তিনি গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। র‌্যাবের অভিযানের পরও শাহাজাদা বাসায় ছিলেন। তবে গতকাল তাঁকে পায়নি পুলিশ।

পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন পুরুষ পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানায়, চুয়া সেলিম, কাল্লুসহ কয়েকজন ইয়াবা কারবারিকে ঈদের আগে ও পরে এলাকায় দেখা গেছে। তারা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ঠিকই ইয়াবা কারবার করছে।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে একটি গলি থেকে মাথায় ব্যান্ডেজ করা এক যুবককে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। বাসিন্দারা জানায়, আটক করা সনু জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি নাদিম ওরফে পচিশের ভাই। স্থানীয় যুবকরা হামলা চালিয়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। মাদক কারবারিদের কারণে সবাই হয়রানির শিকার হচ্ছে। ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত কারবারিদের না পেয়ে পুলিশ ও র‌্যাব সাধারণ মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এক যুবক বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে একজন বলছিল, বুধবার সকালে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে অভিযান হবে। তারে আমি চিনি না। পাইলে পুরস্কার দিতাম!’

স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, অভিযানের সময় মাদক কারবারি পাপ্পুর ছেলে সানজুকেও আটক করে পুলিশ। কারবারি রাজুর বাসার তালা ভাঙে পুলিশ। তিনি ঈদের ছুটির মধ্যে বাসা ছেড়েছেন। রাহিদের বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ; যেখানে একসময় মাদক কারবারি দম্পতি পাচু ও পাপিয়া থাকতেন। সম্প্রতি লালবাগ থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জি ব্লকের মাংস বিক্রেতা শাহজাহানের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে কারবারি নাদিম ও কাল্লুকে খোঁজে পুলিশ। তবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।

গতকাল দুপুর ১টার দিকে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, তিন শতাধিক সদস্য নিয়ে তিন ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে তাঁরা ৫১ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করেছেন। উদ্ধার করেছেন ৭০০ পিস ইয়াবা ও কয়েকটি ধারালো ছুরি-চাকু। তথ্য ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, গতকালের অভিযানের ব্যাপারে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানাকেও আগে জানানো হয়নি। অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যদের সকালে ব্রিফিং দেওয়া হয়েছে। রাতে মাদক বিক্রি আর দিনে প্রকাশ্যে অভিযানের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘জায়গাটি স্পর্শকাতর। তবে রাতে অভিযানের বিষয়টিও আমাদের পরিকল্পনায় আছে।’

এদিকে শিয়া মসজিদের পাশে বাঁশবাড়িতে গেলে দুজন বাসিন্দা জানায়, ৫ জুন অভিযানের পর কারবারিরা গা ঢাকা দিলেও ঈদের আগে ফিরে এসেছে। জাফরের মতো কয়েকজন আশপাশে ঘুরে খুচরা ইয়াবা বিক্রি করছে। মনি ও তাঁর সহযোগীরা মোবাইল ফোনে চালান পৌঁছে দিচ্ছে।

অন্যদিকে গত ২ জুন পল্লবীর কালশী, বিহারী কলোনি ও এর আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই এলাকায় গতকাল সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, সেখানে এখনো হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। টেকেরবাড়ীর চান্দুরার টেক এলাকার টুটুলের স্পট থেকে ইয়াবা কেনেন এমন একজন কালের কণ্ঠকে জানান, সন্ধ্যায় বস্তির ওই বাসায় ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থাও আছে। ওই এলাকায় রুবেলও বিক্রি করেন।

১১ নম্বর সেকশনের মিল্লাত ক্যাম্পের ঢাল ও ভাসানী মোড়ে দুজন জানায়, মোস্তাক ও তাঁর ছেলে মিস্টার এখনো মাদক বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে আড্ডু নামে একজনের সিন্ডিকেট আছে। ইরানি ক্যাম্পে সধু ও বধু নামে দুই ভাই এবং তালাত ক্যাম্পে দেলোয়ার ইয়াবা বিক্রি করছেন। দেলোয়ারের বাসায় ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থাও আছে। উত্তর কালশীর লাকি বাবু, গুণ্ডা শাহিন, সোর্স হায়দার, কালীর ছেলে ইব্রাহিম, পারভেজ, রাজীব, ইদ্রিসের টেকের কাল্লু ও ১২/ডি ব্লকের ইয়াবা সুজন রূপনগর পর্যন্ত ইয়াবার কারবার করছেন। সূত্র: কালের কণ্ঠ

/এসএম

ইয়াবা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close