• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন

বিধিমালা চূড়ান্ত করতে দুদকের ২১ প্রস্তাব

নিজস্ব বিধির আলোকেই কাজ করতে চায় সংস্থাটি * বিধিমালায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা নির্ধারণ

প্রকাশ:  ২১ জুন ২০১৮, ১১:৫৬
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

মানি লন্ডারিং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তাবিত বিধিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে ২১ জায়গায় সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের পক্ষ থেকে খসড়া বিধিমালায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (দুদকসহ যে ৫টি সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে) সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

এতে বলা হয় ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে এই আইনের অধীন তদন্তকারী সংস্থাকে বুঝাবে।’ দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে সব সংস্থা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ তদন্ত করবে তারা শুধু তদন্তের সময়ই নয়, অনুসন্ধানের সময়ও যৌথভাবে কাজ করতে পারবে।

দুদক কিভাবে এবং কোন বিধিতে মানি লন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে মতামতে তারও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘এই বিধিতে যা কিছু থাকুক না কেন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এবং ওই আইনের অধীন প্রণীত বিধিমালা অনুসরণ করা যাবে।’

এ বিষয়ে দুদকের যুক্তি হচ্ছে- তাদের আইনের অধীন পর্যাপ্ত বিধিমালা আছে। এ ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং বিধিমালা অনুসরণের বাধ্যবাধকতা থাকলে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিং আইনের একটি খসড়া বিধিমালা প্রস্তুত করে। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এপ্রিলে দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ অংশীজনের মত চেয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে খসড়া বিধিমালায় তার নিজস্ব অভিমত তুলে ধরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের আইন বিভাগের মহাপরিচালক মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কী মতামত দিয়েছি স্মরণ করতে পারছি না। তবে প্রস্তাবিত বিধির কিছু জায়গায় স্পষ্টীকরণ দরকার ছিল। আমরা সেটা করে দিয়েছি। তার কতটুকু রাখা হবে কতটুকু হবে না সেটা কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।’

আইন সংশোধনের তিন বছর পর মানি লন্ডারিং আইনের বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৫ সালের নভেম্বরে আইনটি সংশোধন করে তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে দুদকের পাশাপাশি সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হলেও বিধির অভাবে এসব সংস্থার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এমনকি সংশোধিত আইনের কারণে দুদকও মানি লন্ডারিং তথা অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে শক্ত কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কেন না, আইনে দুদককে শুধু ‘ঘুষ দুর্নীতি’ শিরোনামে একটি অপরাধের তদন্তের এখতিয়ার দেয়া হয়। অন্যদিকে সিআইডি ও এনবিআরসহ চারটি সংস্থার তদন্ত শেষে অর্থ পাচারসংক্রান্ত অপরাধের মামলার চার্জশিট অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ কে হবেন তাও নির্ধারণ করা হয়নি। এ বাস্তবতায় সরকার ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৮’ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাপরিচালক আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান রোববার বলেন, আমরা যে বিধি করতে যাচ্ছি তাতে তদন্ত সংস্থাগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্তসংক্রান্ত দায়িত্ব বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকবে। বিধি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে অংশীজনের মতামতসহ এটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রধানের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি থাকবে- যা সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত হবে। এ কমিটি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে।

খসড়া বিধিমালায় বলা হয়, তদন্তকারী সংস্থার নিজস্ব সংস্থায় বিদ্যমান পদ্ধতি অনুসরণ করে তদন্ত কর্মকর্তা ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করবেন। তদন্ত শেষে তিনি নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। যদি ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারেন তবে তদন্ত কর্মকর্তা যুক্তি সঙ্গত কারণ উল্লেখ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে তিনি আরও ৪৫ কার্যদিবস পর্যন্ত সময় পাবেন। এরপর তাকে আর সময় দেয়া হবে না। বরং তিনি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্তে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন তবে তার বিরুদ্ধে চাকরি বিধির আওতায় বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে।

প্রস্তাবিত বিধিমালার একাদশ অধ্যায়ে তদন্তকারী সংস্থার দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা হয়। এতে তদন্ত কর্মকর্তা মনোনয়ন কিভাবে হবে তা তুলে ধরে হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা অনুসন্ধান শেষে নিজস্ব সংস্থার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করবে। তবে কোনো তদন্ত যৌথ তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউকে তা লিখিতভাবে অনুরোধ করবে।

তদন্ত শেষে তদন্তকারী সংস্থা অভিযোগনামা পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের জন্য নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল বা পিপির পরামর্শ নেবে। তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা কেস ডায়েরি প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করবেন। তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত কার্যক্রম তদারকির জন্য জাতীয় বেতন স্কেলে ৮ম ধাপে বেতন উত্তোলন করেন এ পর্যায়ের নিচে নন এমন একজন তদারককারী কর্মকর্তাও নিয়োগ করতে হবে।

মানি লন্ডারিং অপরাধের তদন্ত চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির বক্তব্য নেয়া দরকার তাহলে তাকে নোটিশ দিয়ে মৌখিক বা লিখিত বক্তব্য নেয়া যাবে। তার ওই বক্তব্য নথিতে অন্তর্ভুক্ত হবে।

আদালতে অভিযোগনামা (চার্জশিট) দায়েরে অনুমোদন পদ্ধতির বিষয়ে বিধিতে বলা হয়, মানি লন্ডারিং অপরাধের অভিযোগ তদন্তের পর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচার সুপারিশ করে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী তদন্তকারী সংস্থার নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।

এরূপ অনুমোদনের একটি কপি আদালতে দাখিল করা না হলে আদালত অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করবেন না। মানি লন্ডারিংয়ের কোনো অপরাধে যৌথ তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্তের প্রয়োজন হলে বিএফআইইউ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করবে। যৌথ তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্ত দলের প্রধানের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা দায়েরের অনুমোদন প্রদান করবে।

মানি লন্ডারিং অপরাধের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে স্ব স্ব সংস্থা তার নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করবে। দুদক তার নিজস্ব (কমিশন) সিদ্ধান্তে এবং অন্য সংস্থার ক্ষেত্রে সংস্থার প্রধানসহ দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি চার্জশিটের অনুমোদন দিতে পারবে। যৌথ সংস্থার তদন্ত তদারক করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

বিধিমালার বিভিন্ন ধারা ও উপধারা উদ্ধৃত করে দুদকের মতামতে বলা হয়, বিধির বিভিন্ন স্থানে ‘সন্ত্রাসী কার্যের অর্থায়নকেও মানি লন্ডারিং আইনে রাখা হয়েছে। এটি বিলুপ্ত করা দরকার। কারণ সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়নের বিষয়টি ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে উল্লেখ রয়েছে। এটি এ বিধিতে থাকলে ওই আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। দরকার হচ্ছে ওই আইনে (সন্ত্রাসবিরোধী আইন) বিধিমালা প্রণয়ন।

বিধিমালায় সম্পদ বাজেয়াফতের বিষয়ে কোনো বিধান না রাখায় দুদক বলেছে, ‘আদালত কোনো সম্পত্তি বাজেয়াফত করার নির্দেশ দিলে তা কার্যকর করবে সম্পত্তিটি যে জেলায় অবস্থিত সে জেলার ডিসি (ডেপুটি কমিশনার)।’ প্রস্তাবিত বিধিমালায় অবরুদ্ধ, ক্রোক কিংবা জব্দকৃত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কোনো বিধান না রাখায় দুদক এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব রেখেছে। এতে বলা হয়, ‘ব্যবস্থাপক বা তত্ত্বাবধায়ক ‘সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাতে আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করে আদালতে দাখিল করতে হবে।’ সূত্র: যুগান্তর

/এসএম

দুদক,মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close