• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

নওগাঁর ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহার থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ রাজস্ব আদায়

প্রকাশ:  ১৯ জুন ২০১৮, ১৮:৪০ | আপডেট : ১৯ জুন ২০১৮, ১৮:৪৮
আব্দুর রউফ রিপন (নওগাঁ)

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত প্রত্নস্থলগুলোর মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারটিতে ঈদের দিনগুলোতে ছিলো দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। এই ঐতিহাসিক বিহারটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত আর এর আদি নাম সোমপুর বিহার।

এ বিহারটি বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক বিহার হিসাবে পরিচিত। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর বিহারটি আরো আকর্ষনীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। পিকনিক কর্নারসহ নানামূখী উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বরাদ্দকৃত ২৬ কোটি টাকার কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনশীল ও আকর্ষনীয় মূল প্রবেশ দ্বার। প্রবেশ দ্বারের দক্ষিণ পার্শ্বের ১টি কক্ষ রয়েছে সেখানে প্রত্মসামগ্রী ও বই কিনতে পাওয়া যাবে। উত্তর পার্শ্বে রয়েছে টিকিট কাউন্টার ও মহিলা এবং পুরুষ টয়লেট। নির্মান করা হয়েছে একটি মসজিদ, অফিসার্স কোয়ার্টার, সিকিউরিটি ব্যাটালিয়ানদের জন্য আনসার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, এবং দর্শনার্থীদের জন্য ১০টি ছাউনী।

এই ছাউনীগুলিতে পিকনিকসহ দর্শনার্থীরা বসে বিশ্রাম নিতে পারবেন। ছাউনিগুলোর পার্শ্বেই রয়েছে পুরাতন আদলে নির্মিত একটি পুকুর। এছাড়া মনোরম পরিবেশে নির্মান করা হয়েছে একটি বসার স্থান। রয়েছে গাড়ী পার্কিংয়ের জায়গা। আর এই কাজ গুলো সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্র্যাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধিনে এই কাজ বাস্তবায়ন করা হয়।

অপরদিকে আবার একই প্রকল্পের অধিনে আরো ৮ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক ও সংষ্কার কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে পিকনিক কর্নার থেকে সরাসরি বৌদ্ধমন্দির প্রবেশ পথে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি ব্রিজ। বাকী রয়েছে পুরাতন আদলে বৌদ্ধ মন্দিরের চতুর্দিকে ভিক্ষু কক্ষ, পঞ্চবেদীসহ সকল স্ট্রাকচারের সংস্কার কাজ। সংরক্ষনের ফলে বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুর শুধু দর্শনীয় এবং অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই নয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিশেষ স্থান হিসেবেও দেশে-বিদেশে খ্যাতি পেয়েছে এই বিহারের নাম। দেশী-বিদেশী অনেক প্রতœতাত্বিক ছাড়াও এ বিহার পরিদর্শনে এসেছেন স্পেনের রানী সোফিয়া, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা, থাইল্যান্ডের যুবরাজ এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব পেরেজ দ্য কুয়েলার।

বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে এ বিহারটি নির্মান করেছিলেন। এ বিহারটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওযার পুর্বে পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত তদানীন্তন পাহাড় (গোপালের চিতা) নামে এটি পরিচিত ছিল। ১৯২৩-১৯৩৪ সালে প্রতেœাৎখননের ফলে এই ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়। এরপর এ প্রত্নোস্থলে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ (মাঝখানে ১৯৮৬-৮৭ বাদ দিয়ে) সাল পর্যন্ত একাধিক দফা প্রত্নোখনন পরিচালিত হয়। এর ফলে স্থাপত্যিক ধংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়।

স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষটি এমনই জরাজীর্ন অবস্থায় ছিল যে সেটির বৈশিষ্ট নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। পূর্ববর্তী জৈন বিহারটির ধ্বংসাবশেষের উপর একটি বৌদ্ধ মহাবিহার নির্মিত হয়েছিল। এই মহাবিহারটির নির্মান কাজে পুর্ববর্তী ধ্বংসাবশেষটির বহু নির্মান উপকরন পূন:ব্যবহার করা হয়। এসব উপকরনের মধ্যে কয়েকটি ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য। কারন ওইসব ভাস্কর্যে খ্রিষ্টাব্দ ছয়-সাত শতকের প্রচলিত শৈল্পিক ধারা বিদ্যমান ছিল। অথচ বৌদ্ধবিহারটি বরেন্দ্র ভু-খন্ডের পাল বংশীয় দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল বিক্রম শীলের (খ্রিষ্টাব্দ ৭৭১-৮১০) আমলে নির্মিত হয়েছিল। তৎকালে এটির পরিচিতি ছিল সোমপুর বা চাঁদের লোকালয় নামে।

তবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বর্তমানে যেটুকু অংশ টিকে আছে তা কেবল নিচের অংশের অংশবিশেষ মাত্র। এ অংশের উপরের দেওয়াল ও ছাদ বিহারটি আবিস্কারের বহু পূর্বেই ধ্বংস হয়ে গেছে। মূল পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মাঝখানে একটি ছাদবিহীন চত্বর ঘিরে চার বাহুতে একসারি করে ভিক্ষু কোঠার সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছিল এই বিহারটি। এতে মোট ১১৭টি কক্ষ ছিল। সেখানে ভিক্ষুরা বসবাস করতো। চত্বরের মাঝখানে একটি প্রধান মন্দির ছিল। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৩৫০ ফুট এবং উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট।

কালের পরিক্রমায় মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধ্বসে গেছে। বিহারের মূল বেষ্টনির মধ্যে রয়েছে আরেকটি মন্দির। এটি মুল মন্দিরের ধংসস্তুপ বলে ধারনা করা হয়। বিহারের উত্তর বাহুর মাঝমাঝি ছিল বাহিরের দিকে প্রসারিত গাড়ি বারান্দা আকারের সদর তোরন। এ অংশে মুল প্রবেশ নির্গমন গলির দুই প্রান্তে থামযুক্ত দুটি হল ঘর এবং দু’পাশে একাধিক প্রহরি কোঠা ছিল। এর পূর্বদিকে উত্তর কোনের কাছাকাছি একটি অপ্রশস্ত সাধারন প্রবেশ নির্গমন গলি এবং পূর্ব বাহুর মাঝামাঝি আরো অপ্রশস্ত অপর একটি গোপন গলিপথের সংস্থান রাখা হয়েছিল। মাঝখানে ছাদবিহীন চত্বরের সুউচ্চ প্রধান মন্দিরটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর দক্ষিণ কোনের যৎসামান্য অংশ টিকে রয়েছে।

উপরের চতুষ্কোন মেরুদন্ডের প্রত্যেক বাহু ঠেস দিয়ে স্ব-স্ব দিক থেকে যাতায়াত যোগ্য একটি করে পুঁজো ঘর ছিল। প্রতিটি পুঁজোঘর দুই অংশে বিভক্ত। সামনে ছিল থামওয়ালা একটি মন্ডপ এবং পিছনে ছিল একটি গর্ভগৃহ। এগুলোর চারপাশে রয়েছে প্রদক্ষিন পথ। তবে নিচের দুটি ধাপে অনুরূপ প্রদক্ষিণ পথ ব্যতিত কিছু নেই। ছাদবিহীন চত্বরের বাঁকী অংশে বিক্ষিপ্তভাবে অনেক ধরনের বহু ছোট ছোট স্থাপনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে প্রশাসনিক ভবন, নিবেদন স্তুপ, ভোজন শালা, রন্ধনশালা, কুপ, প্রধান মন্দিরের প্রতিকৃতি ও প্রভৃতি।

নিবেদন স্তুপগুলোর মধ্যে একটির পরিচিতি দাঁড়িয়েছে পঞ্চদেবী। এটি বিহার চত্তরের দক্ষিন-পূর্ব কোনের কাছাকছি অবস্থিত। এখানে একটি নিরেট মঞ্চের উপর একত্রে ৫টি স্তুপ রয়েছে। এর পাশে একটি বাধানো কুপও রয়েছে। তবে নিবেদন স্তুপগুলোর কোনটিরই উপরের অংশ পাওয়া যায়নি। বিহারের সচল দিনগুলোতে তীর্থ পর্যটনে আসা বিভিন্ন ভক্তগনের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে পূর্ণকাজ হিসেবে এগুলো নির্মিত হয়েছিল।

ঐতিহ্যবাহী এই বিহারের সকল স্থাপনারই মূল নির্মান উপকরন ছাঁচে তৈরি পোড়া ইট ও কাঁদামাটি দিয়ে তৈরি করা। এছাড়াও পানি নিষ্কাশন নালী, থাম, সরদল, দরজার বাজুবন্ধ, পাদপট্ট প্রভৃতির ক্ষেত্রে বড় বড় সাইজ করা পাথর খন্ড ব্যবহৃত হয়েছে। কারুকাজের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে পিরামিড, শিকল, দন্তপাটি, দাবার ছক, পাকানো দড়ি, বরফি, ফুলের জ্যামিতিক রেখাচিত্র প্রভৃতি। এছাড়া নিচের ধাপের তলপত্তনে ৬৩টি পাথরের মূর্তি ছিল। নিচে ছিল সারিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলক। এসব ফলকে বিবিধ দৃশ্য বিধৃত হয়েছে। দৃশ্যগুলোর মূল উপজীব্য বিহারের সমকালীন লোকায়েত জীবন, জীব-জগৎ, ধর্ম, পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ কাহিনীর খন্ডচিত্র।

নরওয়ে সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ব ও যাদুঘর অধিদপ্তরের তত্বাবধানে এখানে ১৯৯৩ সালে যাদুঘর তৈরি হয়। ১৯৯৫ সালে সবার জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যাদুঘরে দেখা মিলবে প্রাচীন মুদ্রা, সাড়ে ৩ হাজার পোড়া মাটির ফলক চিত্র, সিল মোহর, পাথরের মূর্তি, শিলালিপি ইত্যাদি। বিহারের ১২৫নং কক্ষে খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলের রূপার মুদ্রাসহ বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা কয়েক হাজর পোঁড়ামাটির ফলকচিত্র, পাথরের মূ]র্তি, তাম্রলিপি, শিলালিপি, বাটখাড়া, শিল, নোড়া ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।

১৯৮৩ সালে পাওয়া যায় ব্রোঞ্জের তৈরি একটি আবদ্ধ বৌদ্ধ মূর্তি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের নকশা সবচেয়ে সেরা। কারো কারো মতে এখানে একটি জৈন মন্দির ছিল। আর সেই মন্দিরের উপরেই গড়ে তোলা হয়েছে এ বিহার। এ বিহারের ১৩-১৪ ফুট আকারের মোট ১৭৭টি ঘর রয়েছে। ঘরগুলোর সামনে টানা বারান্দা। উপরে প্রায় ১০ ফুট চওড়া ছাদ। ঐগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন। বিহারের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি মন্দির। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট এবং প্রস্থে প্রায় ৩৫০ ফুট, উচ্চতা ৭০ ফুট। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধ্বসে গেছে। এছাড়া আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন। এখানে এক সময় যে নদী ছিল তার চিহ্ন দেখলেই বোঝা যায়।

নদীর ঘাটটি সম্পর্কে এলাকায় জনশ্রুতি আছে। এই ঘাটে মৈদলন রাজার কন্যা সন্ধ্যাবতী স্নান করতো বলে এ ঘাটের নাম ছিল সন্ধ্যাবতীর ঘাট। একদিন নদীর স্রোতে ভেসে আসা জবা ফুলে ঘ্রান নেয়ার পরে সন্ধ্যাবতী গর্ভবতী হয় এবং পরবর্তীতে ছেলে সন্তান প্রসব করেন।

এ বিষয়ে বদলগাছী উপজেলা ভূমি কমিশনার রওশন আলী বলেন, নওগাঁর বদলগাছী পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারটির সৌন্দর্য্য বর্ধন মূলক অনেক কাজ হয়েছে যা দর্শনার্থীদেরকে মুগ্ধ করছে। পরবর্তীতে আরো সৌন্দর্য বর্ধনকাজ করলে আরো দর্শনার্থীর সমাগম ঘটবে।

ঐতিহাসিক পাহাড়পুর (সোমপুর বিহার) যাদুঘরের কাস্টডিয়ান ছাদেকুজ্জামান বলেন, এবার ঈদে গত বছরের তুলনায় পর্যটকদের ভীড় ছিলো দ্বিগুন পরিমান। তাই এবার গত বছরের তুলনায় দ্বিগুন পরিমাণ রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা দিতে পারবো বলে আশা করছি। বর্তমানে পুরাতন আদলে ও আধুনিকায়নভাবে সংষ্কার করা হয়েছে এই ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহারটি এবং যাদু ঘরে নতুন করে সংস্কার কাজ ও সেই খানে ১৩টি এসি ও ১৬টি ছিছি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এই বৌদ্ধবিহারের ভেতর আর কখনো বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে পাহাড়ের দেওয়াল নষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সংষ্কারের পর বৌদ্ধ বিহারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ঈদের ছুটিতে গত ৩ দিনে প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকা সরকারী কোষাগারে জমা হয়েছে। এখনতো আরও কয়েক দিন ঈদের আমেজ বিরাজ করবে। চলতি সপ্তাহের ছুটি পর্যন্ত এরকমই দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটবে ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ওএফ

রাজস্ব আদায়
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close