• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে তরুণীরা

প্রকাশ:  ০৭ জুন ২০১৮, ১১:৫৪ | আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:৩৫
সাজ্জাদ হোসাইন
ফাইল ছবি

প্রতিনিয়তই সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে পড়ে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে বহু নারীর জীবন। লোকলজ্জা ভয়ে কেউ নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে আড়াল করছে তো কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। সাইবার অপরাধে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে ফেসবুক। এ ছাড়া টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও সাইবার অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। দিন দিন দেশে বেড়েই চলছে সাইবার অপরাধ। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ অপরাধের শিকার হচ্ছে নারীরা। নিম্নে একটা প্রতারণার ফাঁত তুলে ধরা হলো।

মেয়েটির কাছে বিষয়টি ছিল অকল্পনীয়। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন সে আসলে প্রতারক। দিদার মুন্সীর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মেয়েটির। কৌশলে বন্ধুত্ব, প্রেম। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও চিত্র ধারণ। মেয়েটির তা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়।

ভিডিও ভাইরালের হুমকি দেয় প্রতারক প্রেমিক। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি আশ্রয় নেয় সাইবার ক্রাইম ইউনিটের। গ্রেপ্তার করা হয় দিদার মুন্সীকে। শুধু এই মেয়েটিই নয়, দিদার মুন্সীর প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন আরো অনেকে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বখতিয়ারের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এক ছাত্রীর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ওই ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয়ের এক পর্যায়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সে। ওই ছাত্রীকে দিয়েই তার নগ্ন ছবি তোলায় বখতিয়ার। পরে ওই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ১২ ভরি স্বর্ণ। ছাত্রীর অভিভাবকের অভিযোগের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বখতিয়ারকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তার ল্যাপটপ থেকে এরকম একাধিক মেয়ের নগ্ন ছবি উদ্ধার করা হয়।

বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর গত ৩ মাস আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয় মেয়েটির। আগে থেকেই ফেসবুকে একটি একাউন্ট ছিল। বিয়ের এক সপ্তাহ পর মেয়েটির নামে আরেকটি একাউন্ট খুলে নানা ধরনের অশ্লীল ছবি পোস্ট করা শুরু হয়। পরিচিতদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে মেয়েটি মুষড়ে পড়ে। ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয় সংসার। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে স্বামীকে কোনোভাবে রাজি করিয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হয়। দেড় মাসেরও বেশি সময় চেষ্টা করে পুলিশ ভুয়া আইডি বানানো ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। তিনি ওই মেয়েটির বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। এসব করার কারণ হিসেবে তার দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাকে অনেক পছন্দ করে, কখনো বলতে পারেনি। কিন্তু বিয়ে হওয়ার খবর জানার পর সে মেনে নিতে পারছে না। তাই সে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছিল।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে নারীরা শিকার হচ্ছেন এমন অসংখ্য সাইবার ক্রাইমের। যার একটি বড় অংশই প্রকাশ্যে আসছে না। ২০১৭ সালে রাজধানীতে সাইবার অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৬টি। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ২২১; ২০১৫ সালে ১৬৯টি। ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার যত বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলোয় এই অপরাধের প্রবণতা বেশি। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা। সাইবার অপরাধের শিকার হওয়াদের ৪৪ শতাংশই মনে করেন-সাইবার অপরাধীদের তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেয়া গেলে দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাকিদের মধ্যে ২৯ শতাংশের পরামর্শ হলো আইনের প্রয়োগ বড়ানো। ২৭ শতাংশ সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ আইনি সহায়তা নেন না। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২ বছর ধরে ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দক্ষ পর্যালোচনা এবং তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে ১৩৩ জন ভুক্তভোগীকে ৯টি প্রশ্ন করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১৫ ভাগ। এই ব্যবহারকারীদের বিশাল অংশ তরুণ, যাদের বয়স ১৮-২৪ বছর। ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী। তবে অসচেতনতার কারণে সাম্প্রতি এই মাধ্যমটি ব্যবহারকারীদের সাবচেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ফলে এদের একটি বড় অংশ সহজেই দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে সাইবার হামলার শিকার হচ্ছেন। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ বছরের কম ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ, ১৮ থেকে ৩০ বছরের কম ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ, ৩০ থেকে ৪৫ বছর ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের বেশি ৩ শতাংশ। অ্যাকাউন্ট জাল ও হ্যাক করে তথ্য চুরির মাধ্যমে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ বাংলাদেশের নারীরা। অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে অপপ্রচারের শিকার হন ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ নারী। একই ধরনের অপরাধের শিকার হন ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২১ শতাংশের মধ্যে ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নালিশ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আর ২৩ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির ভয়ে পুরো বিষয়টিই চেপে যান। অন্যদিকে সামাজিক ভাব মর্যাদা রক্ষায় পুরো বিষয়টি গোপন রাখেন ১৭ শতাংশ এবং প্রভাবশালীদের ভয়ে নিশ্চুপ থাকেন ৫ শতাংশ ভুক্তভোগী। তবে শঙ্কার কথা হচ্ছে অভিযোগ করেও আশানুরূপ ফল পাননি ৫৪ শতাংশ ভুক্তভোগী। অবশ্য ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী ফল পেলেও ৩৯ শতাংশই এ বিষয়ে নীরবতা পালন করেছেন। আর ৩৭ দশমিক ৬১ শতাংশ ভুক্তভোগী প্রতিকারের জন্য প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি আইন সাম্পর্কে জানেনই না।

গবেষণায় বলা হয়, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই ধরনের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধের ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের সামাজিক দক্ষতা বড়ানো গেলে এ ধরণের অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক ফাহমিদুল হক বলেন, সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত পুরুষদের সাধারণ টার্গেট হয় ২০ বা তার আগে থেকে শুরু করে ৩০ বছর বয়সী নারীরা। এই বয়সী অধিকাংশ নারীরা ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে নারীরা যে ভুলটি করে থাকে সেটা হচ্ছে তারা ফেসবুকের যে কোন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের প্রোফাইল ভালোমতো চেকআউট না করে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে থাকে। আইডিটা রিয়েল নাকি ফেইক সেটা তারা যাচাই বাচাই করার প্রয়োজন মনে করে না।

কারণ, তাদের টার্গেট ৫ হাজার ফেসবুক ফ্রেন্ড পূরণ করতে হবে। না হলে তাদের প্রেস্ট্রিজ থাকে না। এছাড়া ফেসবুক ব্যবহারকারী অধিকাংশ নারীই তাদের ফেসবুক বা ব্যক্তিগত ইমেলের প্রাইভেসি বা সিকিউরিটির বিষয়ে খুব একটা সচেতন না। ফলে ফেসবুক ব্যবহারকারী কোনো পুরুষ চাইলেই তার ছবি ডাউনলোড করে ওই ছবি দিয়ে নানান ধরনে অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। এছাড়া ফেসবুক এখন অনেকটা ওপেন বুকের মতো। ফলে ওপেন বুক পেলে সবাই যেমন কাটাকুটি করতে চায়। একইভাবে ওপেন বা কম প্রাইভেসি সম্পন্ন ফেসবুক পেলে যে কেউ সেটাতে ঢুঁ মারতে চাইবে। কাজেই ভার্চুয়াল প্রেস্ট্রিজের কথা না ভেবে, অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাকে নির্ভরযোগ্য মনে হবে কেবল তাকেই বন্ধু হিসেবে রিসিভ করতে হবে। সাইবার ক্রাইম রোধে বিটিআরসি, সাইবার ক্রাইম ইউনিটসহ সরকারকে বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, মেয়েরা ফেসবুকে কে আসল কে নকল সেটা যাচাই বাচাই না করে খুব বেশি খোলামেলা ভাবে ভার্চুয়ালি মিশে থাকে। এভাবেই একটু একটু করে তারা ফাদে পা দেয়। একজন টিনএজার গার্মেন্ট কর্মীও আজকাল স্মার্ট ফোন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। অথচ ফেসবুকের সিকিউরিটি বা প্রাইভেসির বিষয়ে সে কিন্তু মোটেও সচেতন নয়। একই সঙ্গে বর্তমান যুগের বাবা মা এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে তাদের সন্তান কি করছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ও অতি আহলাদের জায়গা থেকে সন্তানদের হাতে এই বয়সেই একটি আইফোন ধরিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হয়। অথচ ১৮ বছর বয়সের নিচে সন্তানের হাতে যে ফোন দেয়া ঠিক না সেটা তারা একবারও ভেবে দেখে না। এক্ষেত্রে মা বাবাকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। একইসঙ্গে সাইবার ক্রাইমের শিকার নারীরা কোথায় মামলা করতে বা অভিযোগ করতে হবে সেটাও জানে না। ফলে তারা থানা, পুলিশ সর্বত্রই হয়রানির শিকার হয়। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মেয়েদের আরও বেশি সাবধান ও সচেতন হতে হবে। স্কুল কলেজ পর্যায়ে সচেতনা তৈরি করতে হবে।

লিগ্যাল এইড সার্ভিস (ব্লাস্ট) এ কর্মরত আইনজীবী শারমিন আক্তার বলেন, এই বয়সের মেয়েদের পরিপক্বতা কম থাকায় তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারে ইমোশনালি ফেক আইডির ট্রাপে পড়ে যায়। তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিওসহ অনেক কিছুই না বুঝেই শেয়ার করে থাকে। এমনকি তারা ফেসবুক, টুইটার বা ই-মেইলের প্রপার সিকিউরিটি সম্পর্কে জানে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পারিবারিক সচেতনতা। বিশেষ করে বাবা মাকে বেশি সচেতন হতে হবে। প্রত্যেক বাবা মা কে তার নিজ সন্তানের প্রতি অনেক বেশি শেয়ারিং এবং কেয়ারিং হতে হবে।

এসএইচ/এসএম

তরুণী,সাইবার,ক্রাইম,সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে তরুণীরা,হুমকির মুখে ব্যক্তি গোপনীয়তা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close