• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সারা জীবন আওয়ামী লীগ করেছি, এখন করি না

প্রকাশ:  ০৫ জুন ২০১৮, ০১:০৩
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বেশ কদিন কোনো শান্তি ও স্বস্তি পাচ্ছি না। মনটা খুবই খারাপ। দেশের ভালো হলে, নাম হলে অল্পবিস্তর যাই হোক তার ভাগিদার আমরাও কিছু মানুষ হই। আবার দেশটা রসাতলে গেলে, বদনাম হলে তাও আমাদের কিছু মানুষের ওপর বর্তায়। কাকের মতো চোখ-কান বন্ধ করে থাকতে পারি না, তাই যত যন্ত্রণা। বেশ কিছুদিন মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। এমন আচরণ কোনো রাষ্ট্র করতে পারে, রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করতে পারে, ভাবা যায় না। একরামকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে এখন তা সবাই জানে। মন্ত্রীরা বলছেন তদন্ত হবে। কেউ বলছেন, বড় কাজ করতে গেলে দু-একটা ভুল হতেই পারে। ভুল তাও আবার মানুষের জীবন নিয়ে— এটা ভাবা যায়? আমরা একটা পিঁপড়ার জীবন দিতে পারি না অথচ আল্লাহর সব থেকে প্রিয় মানুষের জীবন নষ্ট করি। খুনিরা খুন করে, কিন্তু রাষ্ট্রই যদি খুনি হয় তাহলে তো পেশাদার খুনিরা বেকার হয়ে পড়বে। অবিরাম মানুষের জীবন নষ্ট হচ্ছে। মনে হয় বড় বেশি আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়িনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আমাকে আলোড়িত করেছে, তা ছাড়া চোখের সামনে নিরীহ মানুষকে হত্যা ও মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়ায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আজ তেমন কিছু করতে পারছি না। তাই কোথাও কোনো শান্তি পাচ্ছি না।

আজ সাড়ে তিন মাস বেগম খালেদা জিয়া জেলখানায়। যারা রাজনীতি করেন তারা জেলখানায় যাবেন— এটা কোনো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো তাকে ন্যায়, না অন্যায়ভাবে জেলে রাখা হয়েছে। তাকে যে মামলায় জেল দেওয়া হয়েছে মামলাটি যদি মেনে নিতে পারতাম, ঘটনাটি সত্য বলে মনে হতো তাহলে কোনো জ্বলন থাকত না। আর একসময় যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছি। সেজন্য এখন কাউকে কোনো পরামর্শ দিলে কেউ যদি কিছুই না শোনে সামান্য হলেও খারাপ লাগে। সেদিন জেল থেকে শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী জোসেফকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখালচন্দ্র নাহার জেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন বছর পরও ছাড়া হচ্ছে না। এগুলো পীড়া দেয়। সারা জীবন আওয়ামী লীগ করেছি, এখন করি না। বিএনপি করি না। নিজের দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ করি। তার পরও খালেদা জিয়ার জন্য খারাপ লাগে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, সন্তানহারা বেগম খালেদা জিয়া আজ সাড়ে তিন মাস কারাগারে। পাঁচ বছর কেন, বেঁচে থাকলে ৫০ বছর কারাগারে থাকবেন যদি তিনি অপরাধী হন। কিন্তু তার জামিনের বিরুদ্ধে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আপিল এটা কেন যেন খুবই দৃষ্টিকটু ও হীনমন্যতার কাজ বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে কম নির্যাতন-নিপীড়ন, নাজেহাল করেনি।

সম্পর্কিত খবর

    কিন্তু তার জামিনের বিরুদ্ধে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে যায়নি। আর বঙ্গবন্ধুকে হাই কোর্ট থেকে তেমন জামিন নিতে হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট জামিন দেয়নি, জজ কোর্টে আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে জামিন পেয়েছেন। অথচ বর্তমান সরকার হাই কোর্টের জামিনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করছে। যে যাই বলুন ভাবীকাল এসব খুব সম্মানের চোখে দেখবে না। সামনে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সরকার ও সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ, আদালত জেল দিয়েছে, আদালত জামিন দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে আপিল করায় জামিন স্থগিত রয়েছে। দেশবাসীর আন্দাজ, নির্বাচনের আগে বেগম জিয়াকে ছাড়া হচ্ছে না। প্রতিহিংসা ভালো কিছুর জন্ম দেয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ— ’৭০-এর ওপর বয়সী বেগম খালেদা জিয়াকে ঈদের এক সপ্তাহ আগে এবং ঈদের এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত দুই সপ্তাহের জন্য প্যারোলে মুক্তি দিন। এতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশবাসীর কাছে বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে পারবেন এবং তা আগামী নির্বাচনে আপনার জন্য অনেক ভালো হবে। আমি আন্তরিকভাবেই আশা করব, বেগম খালেদা জিয়াকে আসন্ন ঈদ উপলক্ষে প্যারোলে মুক্তি দেবেন।

    বহুদিন পর ৩০ মে আমার টাঙ্গাইলের বাড়িতে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিলাম। আওয়ামী লীগের কিছু লোক ছাড়া ছোট-বড় বহু মানুষ এসেছিলেন। তাতে আনন্দে মন ভরে গিয়েছিল। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা, রিকশাওয়ালা, সাধারণ মানুষ থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ী, উকিল, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার সর্বস্তরের লোকজন দয়া করে এসেছিলেন। আওয়ামী লীগ ছিল না তাও বলতে পারি না। টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক আলমগীর খান মেনু এসেছিলেন। তার আসায় আমার বড় ভালো লেগেছে। বহুদিন পর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সবুর বীরবিক্রম, আবুল কালাম বীরবিক্রম, ফজলুল হক বীরপ্রতীক, খোরশেদ আলম বীরপ্রতীক, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকের সমভিব্যহারে অভিভূত হয়েছি। এসেছিলেন এনায়েত করিম, হামিদুল হক মোহন, জহিরুল হক ডিপটি, জাকেরুল মওলা, মাহমুদ কামাল, নাসির উদ্দিন, শামিমুল আক্তার, অধ্যক্ষ এনামুল করিম শহিদ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ওয়াহিদুজ্জামান মতি, ফারুক কোরেসি, অ্যাডভোকেট সালাম চাকলাদার, অ্যাডভোকেট এম এ রশিদ, ইকবাল হোসেন, খন্দকার নাজিম উদ্দিন, আবদুল হামিদ মিয়া, ইসমাইল হোসেন, জাহাঙ্গীর তালুকদার, মুন্সী শহিদুল ইসলাম।

    টাঙ্গাইলে ছিলাম বলে পয়লা জুন ডিসির ইফতার মাহফিলে গিয়েছিলাম। বছরখানেক হলো তিনি এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে ছিলেন। কাজকর্ম কতটা কী করেন বলতে পারব না। কারণ এখনকার ডিসি-এসপিদের সরকারি দলের লোকজন সামাল দিতেই চলে যায়। তবু লোকটি যে চেষ্টা করেন তা এই এক বছরে উপলব্ধি করেছি। তাই হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, সোহেল, আলমগীর ও মোস্তাফিজকে নিয়ে ইফতারিতে গিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন স্বাগত জানিয়েছিলেন। একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইফতারস্থলে নিয়ে গিয়েছিলেন। বসতে চেয়েছিলাম সাধারণ টেবিলে। কিন্তু জোর করেই মূল টেবিলে বসিয়ে ছিলেন। যেখানে এমপিরা ছিলেন, সরকারি কর্মকর্তারা ছিলেন। মূল টেবিলে খন্দকার আসাদুজ্জামান বসেছিলেন। তিনি আমাদের দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই। খন্দকার আসাদুজ্জামান মঞ্জু ভাইর হাত ধরে আমি কাদের বলতেই বললেন, ‘ও তুমি এসেছ? আমি তো দেখতে পাই না।’ চমকে উঠেছিলাম, কী বলেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন আমাদের চোখের মণি, আজ তারই চোখে মণি নেই, আলো নেই। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। বসেছিলাম তার ডান পাশে। ইফতারের সময় পেছনে দাঁড়ানো একজন তাকে যখন ইফতারি মুখে তুলে দিচ্ছিলেন আমার কেমন লাগছিল তা লিখে বোঝাতে পারব না।

    মঞ্জু ভাই একজন নামকরা সিএসপি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে রাজশাহীর ডিসি ছিলেন। যুদ্ধের কদিন আগে বাড়ি এসেছিলেন। চাকরিতে থাকলে কী হতো জানি না। টাঙ্গাইলে এসে আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে সরকারি অফিসাররা বিরোধী রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। খন্দকার আসাদুজ্জামানও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু ’৭০-এর নির্বাচনের পর অবস্থা অনেক বদলে গিয়েছিল। প্রায় সব বাঙালি এমনকি যেসব বাঙালি পুলিশ অফিসার বিরোধী নেতাদের ওপর অত্যাচার করতে পারলে, যে পুলিশ দুটা বাড়ি বেশি দিতে পারলে খুশি হতো তারাও আমাদের পিছে পিছে ঘোরা শুরু করেছিল। আর তখন একটা জেলার ডিসি মারাত্মক ব্যাপার। এখন তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রীদেরও সম্মান নেই।

    টাঙ্গাইলের ডিসি জালাল উদ্দিন, এসপির নাম ভুলে গেছি। তারা হাইকমান্ড অফিসে এসে যখন আসাদুজ্জামানকে ‘স্যার স্যার’ করত আমাদের তখন বেশ গর্ব হতো। সংগ্রাম পরিষদের নেতারাও আসাদুজ্জামানকে বেশ গুরুত্ব দিতেন, সমীহ করতেন। ২৬ মার্চ যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তার উপদেষ্টা করা হয়েছিল খন্দকার আসাদুজ্জামানকে। তিনি চোখে দেখেন না, ভাবতেই কেমন লাগছিল। কথাটা বলছি এজন্য, একসময় সংগ্রাম পরিষদ ব্যাংকের টাকা শহর থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। সবাই একমত হলেও একমাত্র আসাদুজ্জামান দ্বিমত করেন। তার কথা, প্রয়োজনীয় টাকা স্লিপ দিয়ে ব্যাংক থেকে নিয়ে নিতে পারেন। যতক্ষণ পাকিস্তানিরা টাঙ্গাইল দখলে না নিচ্ছে ততক্ষণ ব্যাংক থেকে টাকা বাইরে নেওয়া ঠিক হবে না। বাইরে নিয়ে ভালোভাবে রাখা যাবে না। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া-ফ্যাসাদ হতে পারে। তাই যখন যত টাকা দরকার ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিলেই হবে। কথাটি অনেকের পছন্দ হয়নি। কিন্তু তবু খন্দকার আসাদুজ্জামানের পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেনি। টাকা ব্যাংকেই থেকে যায়। ২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলা গণমুক্তি পরিষদ ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করেছিল। তা থেকে আমাকেও দেওয়া হয়েছিল সাড়ে ৬ হাজার।

    পরবর্তীতে মাসখানেক ওই সাড়ে ৬ হাজার টাকাই আমার জন্য বোঝার মতো ছিল। কে রাখে কে দেখে। আস্তে আস্তে খরচ হয়ে সব যখন শেষ হয়ে গেল, সম্বল মাত্র ৩০০ টাকা তখন বেশ হালকাবোধ করছিলাম। পরে বুঝেছি, ব্যাংকের ১০-১২ কোটি টাকা বাইরে বের করলে টাকাগুলো কোথায় থাকত, কার কাছে থাকত তাতে আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যে জড়িয়ে পড়ত তাদের কী যে হতো। ১০-১২ কোটির ২-১ লাখ হয়তো আমার হাতেও দেওয়া হতো। আমি তখন টাকা সামলাতেই ব্যস্ত থাকতাম, আদৌ যুদ্ধ করতে পারতাম কিনা কে জানে। মুক্তিযুদ্ধে পাই পাই হিসাব রেখেছি। আমার স্যান্ডেল বহনকারীরা এখন হাজার কোটির মালিক। তার পরও আমাদের নিয়ে কত কথা। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে টাঙ্গাইলের ডিসি ছিলেন রংপুরের অধিবাসী। সেনা ক্যাম্প ছিল নতুন জেলা সদরে।

    সব ব্যাংক ছিল পুরান শহরে। পাকিস্তানিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুরান শহরের দিকে ফিরেও তাকাতে পারেনি। টাঙ্গাইল যেদিন মুক্ত হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতায় সেদিন ৫২ লাখ টাকা ছিল। কিন্তু তার তিন দিন আগে টাকা ছিল ৮ কোটি। টাকা সরিয়ে ফেলতে হবে বলে জেলা প্রশাসক ফোর্সসহ পিকআপ পাঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সময় ৭-৮ কোটি এখন হাজার কোটিরও বেশি। এখন সেই জেলা প্রশাসকের বেসুমার টাকা। ব্যাংকের মালিক। আওয়ামী লীগের নেতা।

    আমাদের নিয়ে বেয়াদবি করে। যেহেতু আমার প্রিয় বোন জননেত্রী শেখ হাসিনা কিছু বলেন না, তাই সবাই চুপ। ডিসির ইফতার মাহফিলে মঞ্জু ভাইকে ওভাবে দেখে বড় আহত হয়েছি। একজন মানুষ টাঙ্গাইলের জন্য অন্ততপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের জন্য জ্ঞানে হোক অথবা অজ্ঞানে অনেক বড় কাজ করেছিলেন অন্য কেউ উপলব্ধি না করলেও আমি মরমে মরমে উপলব্ধি করি।

    লেখক : রাজনীতিক। সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

    বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close