• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

যে কোন বিপদে নিজের উপর ভরসা রাখুন!

প্রকাশ:  ১৮ মে ২০১৮, ১৮:৩৩ | আপডেট : ১৮ মে ২০১৮, ১৮:৩৭
খুজিস্তা নূর-ই–নাহারিন (মুন্নি)

মানুষ যখন ভয়ঙ্কর কোন বিপদে পরে, পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যায় তখন সে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, সাহায্য চায়। মনের অগোচরে কোন অন্যায় হয়ে থাকলে অনুতপ্ত হয়, ক্ষমা প্রার্থী হয় আবার প্রশ্নও করে, কেন !

একমাত্র সৃষ্টিকর্তাইতো যার কাছে প্রতিটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। সমস্ত প্রকৃতি বিরূপ হলেও সৃষ্টিকর্তা তাঁর নিজের সৃষ্টিকে নিশ্চয়ই ভালোবাসেন, তিনি অন্তর্যামী মানুষের সীমাবদ্ধতাটুকু বুঝেন।

সম্পর্কিত খবর

    ২০১০ সালে আমার জীবনের হঠাৎ এমন অযাচিত অকল্পনীয় বিপদে আমি সরাসরি সৃষ্টিকর্তার সাথে কথা বলতে চাইলাম, কিন্তু আমি সামান্য একজন মানুষ, এতো ক্ষমতা আধ্যাত্মিকতা কোনটিই নেই আমার ।

    বেশ কয়েক বছর আগে আমি মেডিটেশনের একটি কোর্স করেছিলাম, সেখানে অনেক লম্বা ধার্মিক একজনের কথা মনে পড়লো। শুনেছি তিনি স্বপ্নে অবগত হয়েছিলেন তাঁর বাড়ির উঠোনের একটি গাছ মাটির নীচে শিকড় ছড়াতে পারছিলো না, একটি পাঁথরে বাঁধা গ্রস্ত হয়ে পরছিল বারংবার, অবশেষে তিনি মাটি খুঁড়ে গাছটিকে বেড়ে উঠতে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন । তিনি যেমন সুদর্শন, তেমনই সুন্দর কথা বলেন ।

    তাঁর দ্যুতি ছড়ানো ব্যক্তিত্বের আলোতে স্বল্প সময়ে সবাই ভক্ত হয়ে পরে । ইসলামী লাইনে অনেক শিক্ষিতও তিনি, শুনেছি কোন এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের ''Head of the department'' । তাঁর সুখ্যাতি শুনতে শুনতে গুণমুগ্ধ আমরা সবাই তাঁর প্রতি এক ধরনের চুম্বকীয় শ্রদ্ধা, সম্মান এবং ভালোবাসায় নত হই । তিনি আমাদের সবার মুফতি মামা আমাদের বড় আপনমানুষ ।

    ১০ ই নভেম্বর ২০১০ সাল, সন্ধ্যা রাতে জেনেছি, আমার স্বামীর ''ব্রেইন ক্যান্সার'' । সমস্ত আকাশটাই তো আমার মাথায় ভেঙ্গে পরার উপক্রম । হঠাৎ প্রচণ্ড শকে ক্লান্ত অবসন্ন আমি বাসায় ফিরে কারো সাথে কোন কথা না বলে বিছানায় এলিয়ে পড়লাম, চোখে আমার রাজ্যের ঘুম। ছোট ছোট বাচ্চা দুটো কি বুঝল কে জানে, কেউ আমায় কোন ডিস্টার্ব পর্যন্ত করলো না সেদিন । চারিদিকে নিস্তব্ধতার করুন সুর, ঘুম ভাঙল মাঝ রাতে, সময় কাটে না কিছুতেই। ঘড়িতে সময় তখন রাত তিনটা, আমার খাটের পাশে মেঝেতে পাতা বিছানায় নিষ্পাপ অসহায় বাচ্চা দুটি জোড়াপাল্টা হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে । ওদের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠলো। শিশুরা ভীষণ অবুঝ আর অসহায় হয়, সেই সাথে ভীষণ নাজুক, ওরা জানেও না এই মুহূর্তটিতে ওদের জীবনে কত বড় পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, ওরা কি হারাতে যাচ্ছে।

    ওদের বাবা হাসপাতালের বিছানায়, ওরা আমার মুখ পানে তাকিয়ে বরাবরের মতোই ভাবছে হয়তো, ''আম্মু আছেই তো ''। চারিদিক থেকে অসহায়ত্ব এসে আমায় গিলে খেতে চায়। আর পারি না,কাল সময় সব কিছু উপেক্ষা করে দীপনকে ফোন করে বলি ভোর বেলা নিশ্চয়ই মুফতি মামা ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাবেন, আমি গাড়ী পাঠাচ্ছি, তুমি উনাকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে আসো ।

    মুফতি মামা এলেন, দুয়া পড়লেন, জানতে চাইলেন আমার স্বামীর কি হয়েছে। আমি সব কিছু তাঁকে খুলে বললাম,আরও বললাম '' মামা আপনি আমার সাথে একটু বাসায় চলেন কথা আছে''। বাসায় এসে ৫০,০০০ টাকার বান্ডিল হাতে দিয়ে বললাম, ''মামা আমি চাই আপনি নিজ হাতে অসহায় গরীব মানুষ যাদের নিতান্তই প্রয়োজন তাঁদের মাঝে বিতরণ করেন'' ।

    মিনতি করে করুণ স্বরে বললাম, ''প্লিজ মামা, আমার স্বামীর জন্য কিছু একটা করুন, আপনি বললে নিশ্চয়ই তিনি শুনবেন''। আমি আজই সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি, ওখানেই সমস্ত চিকিৎসা হবে। মামা আমায় অভয় দিলেন বললেন, '' চিন্তা কর না আশা করছি ভাল হয়ে যাবে তবে তুমি কথা দাও আমি যা বলব তোমায় শুনতে হবে, আমার হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা কর''। মুহূর্তের একটুখানি ভরসা আমার জন্য বিশাল পাওয়া।

    ভাবলাম হয়তো পর্দা করতে বলবেন, নামাজ-কালাম আমি এমনিতেই তো পড়ি,দান খয়রাতও করি সাধ্য অনুযায়ী, ধর্মের কোন কিছুই তো অমান্য করি না, সামান্য মিথ্যা কথাও কখনো বলি না তবে আর ভয় কিসের বড়জোর বোরখায় নিজেকে আচ্ছাদিত করতে বলবেন, এ আর এমন কি । কয়েক সেকেন্ড চিন্তার পর অত্যন্ত কৃতজ্ঞ চিত্তে গভীর শ্রদ্ধার সাথে বললাম, '' অবশ্যই রাখবো মামা ''।

    সিঙ্গাপুরে প্রায় প্রতিদিন মামা ফোন করেন, আমায় অভয় দিয়ে বলেন, ''সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা কর না'', আমি আরও বেশী কৃতজ্ঞ হই, কান্না লুকাই । সৃষ্টিকর্তার সাথে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ, যিনি গাছের মনের কথা জানতে পারেন তিনি নিশ্চয়ই আমার স্বামীর ভবিষ্যৎ দেখতে পান। যেই ক্ষণে আমার স্বামী অপারেশন টেবিলে, তিনি ফোন করে জানতে চাইলেন, ৫০,০০০ টাকা থেকে প্রয়োজনে নিজে কিছু নিতে চান। মনে প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়া সত্ত্বেও ভীষণ অবসন্ন আমি ক্লান্ত কণ্ঠে জবাব দিলাম, '' আপনি যা ভাল মনে করেন''।

    ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ডাক্তার স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, পৃথিবীর কোথাও বিরল এই রোগের চিকিৎসা নেই হাতে সময় খুব স্বল্প, বড়জোর ১৫ মাস । রেডিও থেরাপি, কেমো থেরাপি শেষ করে প্রায় তিন মাস পর দেশে ফিরে এলাম। প্রতিটি মুহূর্তে দম বন্ধ করা জমাট কষ্ট, হৃদয়ে লুকনো গুমট কান্না, চারিদিক অন্ধকার কিন্তু হাসি মুখে সবাইকে বলতে হচ্ছে, '' ও' ভালো হয়ে যাবে ''। দম বন্ধ করা বড় কঠিন এক সময় । মিথ্যা জেনেও রোগীকে আশ্বাস দেওয়া, '' আরে ডাক্তার বললেই হল নাকি, তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে দেখে নিও'' ।

    মামা ফোন করে বললেন, '' গাড়ী পাঠাও আমার দোয়ায় তোমার স্বামী সুস্থ হয়ে ফিরেছে আমি আজই দেখতে আসবো রোগীকে''। গোপন দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে বললাম '' জী মামা'', শত ব্যস্ততার মাঝেও আমি গাড়ী পাঠালাম ।

    মামা আসলেন, বসলেন , কথা বললেন ,আজ তাঁকেও ভীষণ খুশী দেখাচ্ছে। কোন ভূমিকা ছাড়াই আমার স্বামীর সামনে বললেন, ''মনে কষ্ট পুষে রেখেন না, এখন থেকে সে আর অন্য পুরুষের সাথে কথা বলবে না ''। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা, কারণ কাজের প্রয়োজনে সারাক্ষণ আমি পুরুষদের সাথেই থাকি। এ নিয়ে আমাদের দুজনের ভেতর স্পষ্ট বুঝাপড়া। ১৮ বছরের জীবনে আমাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া এবং অনেক বিষয়ে মত দ্বৈততা ছিল কিন্তু অন্য পুরুষ নিয়ে সন্দেহ কল্পনাতেও করেনি আমার স্বামী কোনদিন । মামার কেরামতি আমার কাছে প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে পরল নিমিষেই।

    যাবার আগে বললেন , '' তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা কর'' । আমি বললাম, '' জী মামা বলুন '' । তিনি বললেন , ৫০,০০০ টাকা দিয়ে গাজী পুরে জমি কিনেছি, আমার মা-বাবার নামে মসজিদ বানাবো আমায় ২ কোটি টাকা দাও'' । মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ না করে বললাম, '' আপনার আগে আমি আমার বৃদ্ধা শাশুড়ি, নিজের মা', সন্তান ছাড়াও অফিসে কর্মরত অনেকের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ , তাঁদের প্রয়োজন মিটানোর পর আপনারটা'' । কিন্তু মসজিদ জামালপুর অথবা রাওজানে নয় কেন ? ওখানে আমাদের অনেক স্থাপনা আছে, মসজিদ, মাদ্রাসাও আছে । তাছাড়া আপনার মা-বাবার নামে করবো আমাদের বাবা-মা কি দোষ করেছেন ! তিনি আমাকে শাসালেন, সম্মুখ বিপদের কথা জানিয়ে গেলেন। মামাকে নিয়ে ইতিমধ্যে আমার মোহ ভঙ্গ হয়ে গেছে, আমি বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলাম না ।

    ওইদিনই শেষদিন, মামার সাথে দেখা করার প্রয়োজন মনে করিনি আর। কারণ বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনাই কেবল নয় আমার ভরসার জায়গাটিও টলে উঠেছে । টিংকু যাদের উপর ভরসা করতে বলেছিলেন, আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন, সময় প্রমাণ করেছে , প্রতিজন মানুষ ঠক, জোচ্চোর, সুযোগ সন্ধানী, প্রতারক । কিন্তু অলক্ষ্য থেকে অজানা অচেনা অনেকেই কিংবা পরিচিত অনেকে যাদের কাছ থেকে আমি কিছু প্রত্যাশাই করিনি তাঁরাই সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন । স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আমার সাথে না থাকলে টিংকু হীন আমার এতোটা অর্জন হয়তো সম্ভব হতো না।

    এতকিছু বলার একটাই উদ্দেশ্য, ভণ্ড প্রতারক অন্য কারো উপর ভরসা করার চাইতে নিজের উপর ভরসা রাখুন, আপনি সৃষ্টির সেরা জীব, সৃষ্টি কর্তার অবশ্যই প্রিয় একজন, যা কিছু চাইবার নিজেই চান, তাঁর সাথে কথা বলুন, তিনি অন্তর্যামী আপনাকে কখনোই ভুল বুঝবেন না । যদি সম্ভব হয় সবার জন্য ভালো হয়, যা চাইবেন তিনি আপনাকে অবশ্যই তা দিবেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ করে চাওয়ার মাঝে কোন লেনদেন নেই, কোন মানত নেই, তাঁর দয়ার ভাণ্ডার অপরিসীম যা চাইবেন তিনি অনায়াসেই দিবেন, বিনিময়ের প্রয়োজন নেই।

    লেখকঃ সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডি

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close