• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এমপি মিতার নির্দেশে পাঁচ কাউন্সিলর সন্দ্বীপ ছাড়া!

প্রকাশ:  ২১ মার্চ ২০১৮, ১৩:৩১
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

দুর্গম উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ গত ১১ মার্চ এক আতঙ্কের সকাল দেখেছে। একের পর এক পাঁচ কাউন্সিলরের বাসভবনে হামলা চালানো হয়েছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে ঘরের চাল ও বেড়া, পড়েছে রামদায়ের কোপ। সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কাউন্সিলরদের বলেছে, প্রাণ বাঁচাতে হলে তাদের সন্দ্বীপ ছাড়তে হবে—এটি এমপি মিতার নির্দেশ! পাঁচ কাউন্সিলরের একজনকে সামনে পেয়ে তারা বাধ্য করে তাৎক্ষণিক মাইক্রোবাস ডেকে আনতে। কাউন্সিলর মাইক্রোবাস আনিয়ে স্ত্রী ও শিশুসন্তানদের নিয়ে প্রথমে উপকূলীয় ঘাট, সেখান থেকে স্পিডবোটে করে চট্টগ্রাম পালিয়ে আসেন। বাকি তিন কাউন্সিলরও অল্প সময়ে সন্দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। একজন ঘটনার দিন বাইরে ছিলেন। এখন তিনি বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। তাদের কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ এর সহযোগী সংগঠনের নেতা। এই ঘটনায় তাদের অভিযোগের আঙুল আওয়ামী লীগের দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার দিকে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আত্মগোপনে থাকা কাউন্সিলররা বলছেন, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন বাগাতে এমপি মিতা দলের নেতাদের এলাকাছাড়া করছেন। পুলিশ এমপির ঘনিষ্ঠ বলে কাউন্সিলররা থানা থেকেও সহায়তা পাচ্ছেন না।

হামলার মুখে সন্দ্বীপছাড়া হওয়া কাউন্সিলররা হলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সালাউদ্দিন (ওয়ার্ড ৬), পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোবারক মাহমুদ (ওয়ার্ড ৮), এ বি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন (ওয়ার্ড ৭), পৌর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মো. মাঈন উদ্দিন মাহি (ওয়ার্ড ৯) এবং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুর হোসেন শাখাওয়াত (ওয়ার্ড ২)। কাউন্সিলররা জানান, হামলার সময় তারাসহ বাড়ির লোকজন কেউ সিলিংয়ের ওপরে, কেউ খাটের নিচেও লুকান।

সম্পর্কিত খবর

    কাউন্সিলর মো. সালাউদ্দিন অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনে বলেন, “এমপির সন্ত্রাসীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এ হামলা করা হয়েছে। তারা বলে, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে তোকে এলাকা ছাড়তে হবে, নইলে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব, এটা এমপির নির্দেশ।’ সন্ত্রাসীরা থাকতেই মাইক্রোবাস আনিয়ে দুই কন্যাসহ পরিবার নিয়ে গুপ্তছড়া ঘাট, সেখান থেকে স্পিডবোটে চট্টগ্রাম আসি।”

    কাউন্সিলররা বলেছেন, এমপির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কালা মনির, ইয়াবা শাহাদাত, ভিডিও সুমন, লোহা বাবলু, গো মনছুর, গো বাহার, মান্নানসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায় এবং সন্দ্বীপ ছাড়ার ‘হুকুম’ জারি করে। তাদের শটগানের গুলিতে কয়েকজনের বাড়ির চাল, টিনের বেড়া ফুটো হয়ে গেছে। রামদা দিয়ে ঘরও কোপানো হয়েছে।

    যেভাবে হামলা : সূত্র মতে, প্রথম হামলাটি হয় কাউন্সিলর নুর হোসেন শাখাওয়াতের বাড়িতে। শাখাওয়াত ওই রাতে বাড়ি ছিলেন না। সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়িতে ঢোকে, তারপর রামদা দিয়ে বাড়িঘর কোপাতে থাকে। শাখাওয়াতের মা তাহেরা বেগম বেরিয়ে কারণ জানতে চাইলে তাঁকে গালি দিয়ে একজন বলে, ‘তোর ছেলে কই, বের হতে বল।’ শাখাওয়াত চট্টগ্রাম গেছে জানানো হলে এক ক্যাডার বলে, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছাড়বি, নইলে আজরাইল আসবে।’ কাউন্সিলরের মা তাহেরা বেগম এই প্রতিবেদককে ফোনে বলেন, ‘তিন দিন আগেও হামলাকারীরা এসে হুমকি দিয়ে গেছে, যেন আমরাও এলাকা ছেড়ে দেই।’ তিনি জানান, গুলি ও চিৎকারের শব্দে এলাকাবাসী ছুটে আসে। তাদের সামনে দিয়েই হামলাকারীরা ফিরে যায়। শাখাওয়াতের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ‘বাচ্চারা ভয়ে ঘুমাতে পারছে না। বাচ্চার বাবা আমাদের নিতে আসারও সাহস পাচ্ছেন না।’

    সময় মিলিয়ে দেখা গেছে, দ্বিতীয় হামলাটি হয় কাউন্সিলর মাঈন উদ্দিন মাহির বাড়িতে। মাহি বলেন, ‘ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। আমার স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে আগের দিন বেড়াতে গিয়েছিল। ঘরে থাকা ছোট ভাই সন্তানদের নিয়ে খাটের নিচে লুকায়। আমি সিলিংয়ের ওপরে লুকাই। সেখান থেকেই শুনছিলাম হুমকি, ‘মাহি, এক ঘণ্টার মধ্যে তোকে সন্দ্বীপ ছাড়তে হবে, এমপির নির্দেশ। আবার এসে দেখতে পেলে জানে শেষ করে দিব। মা নিজ কক্ষে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন। তাঁর কক্ষে অসংখ্য গুলির চিহ্ন রয়ে গেছে।’ এমপির কারণে পুলিশ মামলা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন মাহি।

    খাদেমুল ইসলাম মাদরাসার পাশে কাউন্সিলর মোবারক মাহমুদের বাড়িতে হামলা হয় সকাল ৭টা থেকে সোয়া ৭টার দিকে। মোবারক বলেন, ‘গুলি ও বাচ্চার কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙে। জানালা দিয়ে তাকিয়েই দেখি কালা মনির, ভিডিও সুমন, লোহা বাবলু, কসাই শাহাদাতসহ ২০ থেকে ৩০ জন অস্ত্র হাতে গালাগালি করছে। আমি পাশের রুমে গিয়ে লুকাই। মা জানালা দিয়ে জানতে চান, কী হয়েছে। ওরা বলে, ‘আপনার ছেলে কোথায়? এমপির নির্দেশ, এক ঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছাড়তে হবে।’ মোবারক জানান, এর পরই তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সন্দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসেছেন। বাড়িতে এখন তাঁর মা একা। ফোন নম্বর দিয়ে কথা বললে কাউন্সিলরের মা জাহানারা বেগম বলেন, বিএনপি আমলেও তাঁদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। মোবারক হামলার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘এখানে আগামী নির্বাচনেরও হিসাব-নিকাশ আছে। আমরা পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পক্ষে অবস্থান করায় এমপি ক্ষুব্ধ হয়ে এসব করাচ্ছেন।’ এমপির ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’র অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও আরেকটি কারণ বলে তিনি মনে করছেন। কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের একটাই অপরাধ, আমরা এমপির সন্ত্রাসী ও ক্যাডারদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করি।’

    জানা যায়, চট্টগ্রাম-৩ সন্দ্বীপ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। আগামী সংসদ নির্বাচনে বর্তমান এমপির পাশাপাশি নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার মো. শাহজাহান, সন্দ্বীপ পৌর মেয়র জাফরউল্লাহ টিটু, উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আফতাব খান অমিসহ ছয় থেকে সাতজন। মিতা ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চাইলেও নৌকার টিকিট পান ডাক্তার জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তাকে হারাতে মিতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। সেই নির্বাচনে নৌকার পক্ষে যেসব স্থানীয় নেতা মাঠে ছিলেন তাঁদের দমনপীড়নে নেমেছেন এমপি মিতা—এমনই অভিযোগ এই কাউন্সিলরদের।

    এমপির ভাষ্য ‘প্রমাণ কই’ : ফোনে যোগাযোগ করলে এমপি মিতা বলেন, ‘পাঁচ কাউন্সিলরের বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠাই। হামলার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। কাউন্সিলরদের প্রমাণ দিতে বলেন।’ কাউন্সিলরদের এলাকাছাড়া হওয়ার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘উনারা কেন আসে না সেটা আমি কিভাবে বলব? আর আপনার সঙ্গে যদি যোগাযোগ থাকে তাহলে উনাদের বলেন এলাকায় আসতে, আমরা দেখব। উনাদের কে যেতে নিষেধ করেছেন? ভিডিও সুমন একজন মার্ডার মামলার আসামি। তাকে আমরাও খুঁজতেছি। আমি সন্ত্রাসী লালন-পালন করি না।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষের কর্মীদের হয়রানি করা প্রসঙ্গে এমপির ভাষ্য হচ্ছে, ‘আমি তো ভাই নৌকার মানুষ। আমি যখন এমপি তারা কাউন্সিলর হয়েছেন। আমি কেন তাদের বিরুদ্ধে যাব?... সামনে ইলেকশন আসছে তো! আমাদের মেয়র সাহেবও তো এমপি ইলেকশন করতে চান। এ জন্য আমাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে।’

    এদিকে কাউন্সিলরদের অভিযোগ, হামলার খবর তত্ক্ষণাৎ সন্দ্বীপ থানার ওসি সাইফুল ইসলামকে জানানো হলেও তিনি ব্যবস্থা নেননি। পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশে চট্টগ্রাম থেকে আসেন এএসপি সার্কেল। ওসিকে তাৎক্ষণিক লোহাগাড়ায় বদলি করা হয়। মামলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে নবাগত ওসি মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। তবে ঘটনাটি শুনেছি। পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত করছে।’ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেডকোয়ার্টার্স) রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘আমাদের একজন সার্কেল এএসপি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে এসেছেন। মামলাও হয়েছে।’ এখনো মামলা হয়নি জানালে রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘মামলা তো হওয়ার কথা। ওসি বদলি হয়ে নতুন ওসি এসেছেন। সেই কারণেই হয়তো একটু গ্যাপ হয়েছে।’ ঘটনাস্থল ঘুরে যাওয়া এএসপি সার্কেল শম্পা রানী সাহাকে থেকে ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে চাননি। কাউন্সিলর মোবারক মাহমুদ বলেন, ‘সেদিন এএসপি শম্পা রানী সাহা আমার বাড়িও সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।’

    বদলি হওয়া ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ গিয়েছিল। কে বা কারা বাড়ির বাইরে থেকে গালাগালি করে গেছে। ওই ঘটনায় একটি অভিযোগ থানায় দিয়েছিল। আমি বদলি হয়ে যাওয়ায় আর কিছু বলতে পারি নাই।’ তবে সন্দ্বীপ থানার একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওসি সাইফুলের সঙ্গে এমপির খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাই পুলিশ কাউন্সিলরদের রক্ষায় কিছু করেনি।

    উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফোরকান উদ্দিন সিনার বলেন, ‘বিতাড়িত পাঁচ কাউন্সিলরই আওয়ামী লীগের দুর্দিনের নেতা। নিজ দলের সংগঠনের নেতাদের এমপি মূল্যায়ন করতে জানেন না, পারেন আধিপত্য বিস্তার করতে।’ চট্টগ্রাম উত্তর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক ও সন্দ্বীপ পৌর মেয়র জাফরউল্লাহ টিটুও মনে করেন, এমপি তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করতেই ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়েছেন কাউন্সিলরদের বাড়িতে হামলা করতে। তিনি নিজেও প্রাণভয়ে এলাকাছাড়া বলে জানান। সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক শাহাদাত বিল্লাহ খান মোহসিন বলেন, কী কারণে হামলা হয়েছে, এলাকাবাসী সবই জানে। হামলাকারীরা হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন মামলার আসামি বলেও জানান কাউন্সিলররা। কাউন্সিলর সালাউদ্দিনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘শেখ মুজিবের ডাকে যুদ্ধে গেলাম। দেশ স্বাধীন করলাম। নেতার মেয়ে যখন ক্ষমতায়, আমার ছেলেকে সপরিবারে বাড়িছাড়া হতে হয়েছে।’

    এদিকে নবাগত ওসি গত রবিবার চার এসআইসহ ২০ জনের একটি পুলিশের দল পাঠিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী খসরুর বাড়ি তছনছ করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিবাদে মানববন্ধনও হয়েছে। তবে ওসি বলেন, ‘একজন আসামি আছে শুনেই পুলিশ গিয়েছিল, না পেয়ে চলে আসে।’ মুক্তিযোদ্ধা খসরু বলেন, ‘পুলিশের আচরণ দেখে মনে হয়েছে আমি একজন ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী।’ তাঁর ধারণা ওপরের কারোর ইশারায় এসব হচ্ছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ

    /এসএম

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close