• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জয়তু উন্নয়নশীল বাংলাদেশ

প্রকাশ:  ১৮ মার্চ ২০১৮, ২২:১১
ড. আতিউর রহমান

জাতির জনকের ৯৯তম জন্মদিনে বাংলাদেশ পেল এক মহা আনন্দের সংবাদ। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। একই সঙ্গে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছেন বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) তার পর্যালোচনা সভায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১২ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশ ২০২৪ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নীত হবে। এ মাস থেকেই বাংলাদেশ পরীক্ষামূলকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হবে। তবে তিন বছর অন্তর অন্তর ২০২১ ও ২০২৪ সালে সিডিপি বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা করবে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের সব সুযোগই বাংলাদেশ পাবে। আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৮ সাল পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত থাকবে। তবে রূপান্তরের এই সময়টায় বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত ঋণের কিছু কিছু অংশের সুদ বাড়তে থাকবে। একটা সংমিশ্রিত সুদ কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশ অবকাঠামোসহ দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুবিধা পেতে থাকবে। প্রতিটি ঋণের ক্ষেত্রে নতুন করে আলাপ-আলোচনা করে তা নির্ধারণের সক্ষমতা বাংলাদেশকে প্রদর্শন করতে হবে। অবশ্য নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এরই মধ্যে এই নয়া ধারার বিদেশি সহযোগিতা গ্রহণের পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত করা হয়। তখন বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবজ্ঞার চোখেই দেখা হতো। তিনটি সূচকের ভিত্তিতেই অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের মতোই বাংলাদেশকে দারিদ্র্যপীড়িত ঝুঁকিপূর্ণ এই গ্রুপে রাখা হয়। যে তিনটি সূচকের বিচারে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেগুলো হচ্ছে: মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি। ২০১৫ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়েছিল। এবারে বসছে দ্বিতীয় পর্যালোচনা সভা। পর্যবেক্ষকদের মতে, তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ এবারের পর্যালোচনায় উতরে গেছে। এই প্রথম একসঙ্গে তিনটি সূচকেই সাফল্য অর্জন করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পরিচয় লাভ করতে যাচ্ছে। এর আগে আর কোনো স্বল্পোন্নত দেশের ভাগ্যে এ ধরনের সাফল্যের তিনটি পালক একযোগে যুক্ত হওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। তিনটি সূচকেই যেহেতু বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে, তাই তাকে আর স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নামানো যাবে না। তবে যুদ্ধ, ভূমিকম্প, সুনামি বা অন্য কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের দ্রুত অধঃপতন হয় সেটা ভিন্ন কথা।

সম্পর্কিত খবর

    বাংলাদেশের দুর্যোগ সহন ক্ষমতা যে বিরাটভাবে বেড়েছে সে তো সবারই জানা। তাই বাংলাদেশকে আর স্বল্পোন্নত দেশের শিরোপা যে পরতে হবে না সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়। যদিও অনেক দেশি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের এই নজরকাড়া সাফল্যকে নানা চ্যালেঞ্জের মোড়কে প্রশ্ন জর্জরিত করার চেষ্টা করে চলেছেন, তবুও এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা চলে যে এই উত্তরণ এক অনন্য ঘটনা। দীর্ঘদিন এই উত্তরণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই উত্তরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদেশি একজন বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল গে কয়েক মাস আগে ‘বুমিং বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই উত্তরণকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশের এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে যে কারণগুলো তিনি উল্লেখ করেছেন, সেগুলো হচ্ছে :

    ক. ছয় বছর ধরে উপর্যুপরি ৬ শতাংশের বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (বাস্তবে তা আরো বেশি সময় ধরে ঘটছে। আট বছর ধরে তা হচ্ছে। শেষ দুই বছর ৭ শতাংশেরও বেশি হারে বাংলাদেশের অর্থনীতি বাড়ছে)।

    খ. ১৯৯৬ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় স্বল্পোন্নত দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। আর সম্প্রতি তা উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয়ের ন্যূনতম সীমানা পেরিয়ে গেছে।

    গ. বস্ত্র ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চোখ ধাঁধানো সাফল্য ছাড়াও রেমিট্যান্স, প্রাকৃতিক গ্যাস, জাহাজ নির্মাণ, সামুদ্রিক মাছ, তথ্য-প্রযুক্তি ও ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশের অর্জনের ফলে বিদেশি মুদ্রার মজুত ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। তাতে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক অনেকটাই কমে গেছে।

    উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু দারিদ্র্য কমেনি। তবে বাংলাদেশের গরিব মানুষও এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল ভোগ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য রেখা টপকে ওপরে উঠতে সক্ষম হয়েছে। আর গত এক দশকে, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে দারিদ্র্য নিরসনের হার আসলেই চোখে পড়ার মতো। ২০০৮ সালে মোট দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৫.১ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা কমে ২২.৩ শতাংশে নেমেছে। এই সময়ের ব্যবধানে অতি দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ থেকে কমে ১২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। সামাজিক অন্যান্য সূচকের এই সময়টায় ব্যাপক সাফল্য লক্ষ করা গেছে। ফলে মানব উন্নয়নেও ব্যাপক সাফল্য ঘটেছে। ২০০৭ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৩৭ শতাংশে। স্বাধীনতা লাভের পরপরই একটি দম্পতির অন্তত গড়ে পাঁচজন সন্তান হতো। আজ তা ২.১ জনে নেমে এসেছে। ২০০৫ সালেও জন্মকালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৫.২ বছর। ২০১৬ সালে সেই গড় ছিল ৭১.৬ বছর। এখন তা ৭২ বছরেরও বেশি। ২০০৫ সালে পাঁচ বছরের কম শিশুদের হাজারে ৬৮ জনেরই মৃত্যু হতো। ২০১৬ সালে সেই হার ৩৫-এ নেমে আসে। ২০০৫ সালে গড় মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল লাখে ৩৪৮ জন। ২০১৬ সালে তা নেমে আসে ১৭৮ জনে। সাত বছরের বেশি বয়সী মানুষের শিক্ষার হার ২০০৭ সালে ছিল ৫৬.১ শতাংশ। ২০১৬ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশ। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার হারও বেড়েছে বিপুলভাবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। নারীশিক্ষার হার আরো ভালো।

    বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, রপ্তানি আয়ের স্থিতিশীলতা ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ভালোভাবেই সামাল নিয়ে এসেছে। সিডিপির ন্যূনতম এই সূচক ২০০৩ সালেই পেরিয়েছে বাংলাদেশ। গত ৯ বছরে বাংলাদেশের মোট অর্থনীতির আকার, রপ্তানি, আমদানি সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয় এ সময়ে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ভোগের পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। বিনিয়োগ বেড়েছে চার গুণ। আর বিদেশি মুদ্রার মজুদ বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। কয়েক বছর ধরে মুডিস বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং ‘বিএ-৩ ও স্থিতিশীল’ দিয়ে যাচ্ছে।

    নিঃসন্দেহে এই উত্তরণ বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় এক নয়া উচ্চতায় নিয়ে যাবে। আর এ অর্জনের পেছনে যে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কুশলী হাত রয়েছে সে কথাও সারা বিশ্বেই উচ্চারিত হবে। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে যে তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছেন তার সুফল বাংলাদেশ এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাপক হারে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে ১০০টির মতো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে সাহসী উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে তার ফলে অনেক বিদেশি উদ্যোক্তাই বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটির জনশক্তির একটি বড় অংশ শিক্ষিত ও তরুণ। ব্যাপক হারে নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অনেকটাই বেড়েছে। তা ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ সরকার প্রযুক্তি পার্ক, স্বয়ংক্রিয় লেনদেন, ই-কমার্স, সফটওয়্যার উন্নয়নে যে পরিমাণে উৎসাহ দিচ্ছে তাতে নয়া অর্থনীতির প্রসারে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আগ্রহ ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে এ কথা ঠিক, উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের ফলে বাংলাদেশকে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

    অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে কম সুদের বিদেশি সহযোগিতার পরিমাণ কমে যেতে পারে। বাস্তবে সরকারের মোট খরচের তুলনায় এখন বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ খুবই সামান্য। তা ছাড়া সুদ সামান্য বাড়লেও ব্যক্তি খাতে বিদেশি তহবিল জোগানের পরিমাণও বাড়বে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবি, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকে নয়া জানালা দিয়ে বরং উন্নয়নশীল দেশে আরো বেশি হারে বিনিয়োগের আভাস দিচ্ছে। হয়তো ভ্রমণসুবিধা, জাতিসংঘের ত্রাণ সাহায্য, বিদেশি বৃত্তির মতো কিছু গ্র্যান্টের সুযোগ কমে আসবে। এমনিতেই এসব সুযোগ কমার দিকে। তাই এসব নিয়ে বাংলাদেশ ততটা উদ্বিগ্ন নয়।

    কেউ কেউ বলছেন, ইউরোপে বস্ত্র ও চামড়া পণ্য রপ্তানির বিনা শুল্কে প্রবেশে বাধা পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যেভাবে তার বস্ত্র কারখানাগুলোর শ্রম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তাতে করে জিএসপি প্লাস সুযোগ গ্রহণ করতে তার পক্ষে অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। যদি সত্যি সত্যি ২০২৪ সালের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুল্ক হার খানিকটা বাড়ায়ও তা কিন্তু রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের মাঝে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ যদি তার রপ্তানি খাতকে বহুমুখী ও সবুজ শিল্পায়নের আওতায় আনতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের বস্ত্রের মূল্য বরং খানিকটা বাড়বে। পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেও বাংলাদেশ ইউরোপীয় বাজার ধরে রাখতে পারবে। পাট একটি সবুজ পণ্য। তাই তার চাহিদা আরো বাড়বে। মনে রাখা চাই, বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে সবুজ শিল্পায়নের দিকেই ঝুঁকছে। সারা বিশ্বের ১০টি শ্রেষ্ঠ সবুজ কারখানার সাতটিই বাংলাদেশে অবস্থিত। সুতরাং অবকাঠামো তথা বিদ্যুৎ, গ্যাস, বন্দর, রাস্তাঘাট ও বিশেষ শিল্পাঞ্চলের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া চীন থেকে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী মূলত কম খরচে উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের মতো দেশে তাদের কারখানা স্থানান্তরের কথা ভাবছেন। অনেকে এরই মধ্যে তাঁদের কারখানা সরিয়েও এনেছেন। আমরা কত দ্রুত এসব বিদেশি বিনিয়োগকারীর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করতে পারব সেটিই দেখার বিষয়। একই সঙ্গে এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ, পানি, সংযোগ সড়ক, গুণ-মানের বন্দর সুবিধা ও নিরাপত্তা দেওয়ার মতো বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাবে। তাই এসব দিকে প্রশাসনকে তীক্ষ নজর দিতে হবে।

    স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের মান-মর্যাদাও বাড়বে। এই মর্যাদাকে পুঁজি করে আমাদের সার্বভৌম ঋণমানকে বিনিয়োগ সহায়ক পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। আমাদের দেশের সার্বভৌম রেটিং এখনো স্থিতিশীল। তবে অবকাঠামো, বিশেষ করে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, ট্রাফিকব্যবস্থা গতিময় ও বিনিয়োগবিষয়ক নিয়ম-কানুন সহজ করে ব্যবসা করার খরচ কমাতে পারলে নিশ্চয়ই মুডিস বা এস অ্যান্ড পি আমাদের সার্বভৌম রেটিংয়ের উত্তরণ ঘটাবে। আর তখন বিদেশে বন্ড ছেড়ে পুঁজি জোগাড় করে আমাদের সরকারি ও ব্যক্তি খাতে বড় বড় বিনিয়োগ প্রকল্প হাতে নেওয়া সহজতর হবে। একই সঙ্গে আমরা সার্বভৌম ওয়েলথ ফান্ড তৈরি করার সুযোগও পাব। কৌশলগত বিনিয়োগের জন্য তৈরি করা এই তহবিল আমাদের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় খুবই কাজে লাগবে। বিদেশ থেকে কম খরচের পুঁজি সমাবেশের সুযোগ আমাদের এভাবেই তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর বিনিয়োগ বাড়িয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা খাতের বিনিয়োগকে আরো প্রযুক্তিনির্ভর ও লক্ষ্যভেদী করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রযুক্তি ভাবনাকে যুক্ত করে এমনভাবে জনশক্তি তৈরি করে যেতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে তারা দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আমাদের নারীশিক্ষাসহ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী সহায়ক শিক্ষার দিকে বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তাদের সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। শুধু চাকরি করার শিক্ষা নয়, উদ্যোক্তা তৈরি ও নেতৃত্ব জোরদার করার শিক্ষার ওপর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলাম পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। জনশক্তিকে যথাযথ জনসম্পদে রূপান্তরের শিক্ষা আমাদের তরুণ-তরুণীদের দেওয়ার জন্য শিক্ষা বাজেটের পুনর্বিন্যাস করতে হবে। ব্যক্তি খাত এখন উচ্চশিক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করছে। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা খুব ভালো করেই জানেন কেমন জনসম্পদ তাঁদের প্রয়োজন। তাই তাঁদের পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম সেভাবেই সাজানোর তাগিদ নীতিনির্ধারকদের দিতে হবে।

    বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারেন। বিশ্বজুড়েই উচ্চশিক্ষার সঙ্গে তাঁরা সম্পৃক্ত। বছরে কিছুটা সময় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার কার্যক্রমে তাঁরা যাতে যুক্ত থাকতে পারেন সে সুযোগ আমাদেরই সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে কর্মরত গবেষক ও শিক্ষককে কয়েক মাসের জন্য ফেলোশিপ দিয়ে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করার উদ্যোগ সরকারই নিতে পারে। সে জন্য একটি আলাদা তহবিল সরকার গঠন করতে পারে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধ তহবিল সংগ্রহ করে এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগোতে হবে। এর অন্যতম একটি হচ্ছে স্থানীয় সম্পদ সমাবেশের সীমাদ্ধতা। আমরা এখনো প্রত্যেক নাগরিককে স্বদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় কর প্রদানে পুরোপুরি উদ্বুদ্ধ করে উঠতে পারিনি। তাই আমাদের দেশে কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। দক্ষিণ কোরিয়া তাদের জনগণকে দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে আয়কর দেওয়ার আহ্বান করে খুব ভালো ফল পেয়েছে। আমরা কেন তেমন আহ্বান ও ব্যবস্থা নিতে পারব না? কৃষির দ্রুত আধুনিকায়ন, সমুদ্রসম্পদসহ প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারেও আমাদের সুদূরপ্রসারী নীতি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। রিনিউয়েবল এনার্জি (মূলত সোলারশক্তি) আহরণ, তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াতে নয়া অংশীদার খুঁজে নেওয়ার মতো নীতিকৌশলে আমাদের অগ্রাধিকার বজায় রাখতে হবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় নয়া ধাঁচের উন্নয়ন প্রকল্প, সবুজ অর্থায়ন, সামাজিক উদ্যোগ ও ব্যক্তি উদ্যোগকে প্রয়োজনীয় প্রেরণা দিয়ে আগামী দিনের টেকসই বাংলাদেশ গড়ার নীতিকৌশলকে সর্বদাই অগ্রাধিকার দিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো হঠাৎ আসা ঝুঁকি মোকাবেলার মতো শক্তিও আমাদের অর্জন করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে এরই মধ্যে আমরা সাহসী উদ্যোগ নিতে পিছপা হইনি। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে আমাদের নেতৃত্বের মানবিক অগ্রাধিকার অবলোকন করেছে।

    সবশেষে বলব আমরা এখনো খুব বেশি বিদেশি পুঁজি আহরণ করিনি। তাই নতুন করে ব্যক্তি ও সরকারি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ সমাবেশ করার মতো সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। আমরা বিদেশি ঋণ পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হইনি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও উল্লেখ করার মতো। তাই আমাদের এই সুনাম ধরে রাখতে হবে এবং তা কাজে লাগিয়ে অবকাঠামো খাতে বিদেশি পুঁজির সমাবেশ করে যেতে হবে। এ জন্য আমাদের কৌশলগত অংশীদার জোগাড় করতে হবে। ব্যক্তি খাতের সঙ্গে, এনজিওর সঙ্গে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এই কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে আমাদের সরকার সদা তৎপর থাকবে, সেটিই প্রত্যাশা করছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রায়ই বিদেশে অনুষ্ঠান করছেন। এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হচ্ছে।

    আমরা স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয় পেছনে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হয়েছি—এটিই আমাদের সাফল্যের গল্পের সবটুকু নয়, বরং তা এক নয়া মাইলফলক। এটা বরং নয়া পথনকশার শুরু। আমাদের ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্নের আদলে নিজেদের তৈরি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশ উন্নত সোনার বাংলা হওয়ার মহাসড়কে উঠে যাবে এবং সেই পথে আরো অনেক দূর আমরা এগিয়ে যাব। স্বপ্নিল এই ভাবনা থেকে যেন আমরা কখনো বিচ্যুত না হই। একুশ শতকের এই স্বপ্নপূরণ শেষে আমরা ২২ শতকের স্বপ্নে বিভোর হতে চাই। মহাশূন্যে আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠাতে যাচ্ছি। একদিন মহাশূন্যও জয় করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নয়া মাইলফলক স্থাপন করব—সেই স্বপ্নও যেন সবার মনে যুক্ত হয় সেই প্রত্যাশাই করছি। আমাদের যেতে হবে বহুদূর। তাই নিরাশ হওয়ার সুযোগ নেই। ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।’

    লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

    সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close