• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘নারীকে বলতে হবে আমি পারি এবং পারব’

প্রকাশ:  ১২ মার্চ ২০১৮, ১৩:২৬
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে হবে মনে করলে সে লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্থির থাকতে পারেন না। ছোটবেলা থেকেই এমন ছিলেন। অসম্ভব রকমের জেদি আর সাহসী এ নারীর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। সেই আত্মবিশ্বাস তাকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নারী উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন এরই মধ্যে। বিশেষত কাজ করছেন দারিদ্র্য, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, লিঙ্গ সমতা, নারী নির্যাতন, নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়নে এনজিওর ভূমিকা, সাংগঠনিক আচরণ, সামাজিক পুঁজিসহ বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে। আগ্রহের জায়গা থেকেই এতসব বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বলছিলাম বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী এক সফল নারীর গল্প। তিনি হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারাহা নওয়াজ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাবার ঘরে জন্ম তার। বাবার মহান পেশাটি তাকে বেশ টানত। তাই দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষ করার পর পরই প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন নিজ বিভাগে। ড. ফারাহা নওয়াজ ২০১০ সালের ওই সময় থেকেই সামাজিক বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা নিয়ে স্বতন্ত্র গবেষণা শুরু করেন।

সম্পর্কিত খবর

    জানতে চাইলাম গবেষণার বিষয় হিসেবে দারিদ্র্য, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, লিঙ্গ সমতা, নারী নির্যাতন, নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়নে এনজিওর ভূমিকা, সাংগঠনিক আচরণ, সামাজিক পুঁজিসহ বেশ কয়েকটি বিষয় কেন গুরুত্ব দিলেন? ড. ফারাহা নওয়াজ বললেন, বাবার সুন্দর ঘর আর অসম্ভব সুন্দর ক্যাম্পাসেই বড় হয়েছি। অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি। তবে চলতে-ফিরতে দেখেছি সুবিধাবঞ্চিত মেয়েটির বিকাশের পথটাকে খুব ছোট মানসিকতা দিয়ে দেখা হচ্ছে। শুরুতেই একজন মা মেয়েকে বিয়ে দেবেন বলে যৌতুকের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন আমাদের দেশে। আয়ার কাজ করা মানুষটিও অল্প আয় জমিয়ে রাখেন মেয়ের বিয়ের সময় যৌতুক দেবেন বলে। এই বিষয়গুলো কষ্টের, যা নারীর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। সমপরিমাণ মেধাবী হয়েও একজন নারী এগিয়ে যেতে পারেন না। এগুলো মানবাধিকারের বিষয়ও।

    ড. ফারাহার বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. নওয়াজ আলী। ১৯৮২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই জন্ম ড. ফারাহার। নিজেকে সবসময় চিন্তা করতেন একজন আন্তর্জাতিক নাগরিক হিসেবে। নারী হিসেবে বেঁধে দেয়া গণ্ডির বাইরে যেতে চাইতেন। তার এ চাওয়াই হয়তো তাকে বহু বন্ধুর পথ সফলভাবে অতিক্রম করার সাহস দিয়েছে।

    শুধু গবেষক আর শিক্ষক হিসেবেই সুনাম কুড়িয়েছেন বিষয়টি এমন নয়। তাকে বলা যেতে পারে শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক। বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত নূর জানান, ড. ফারাহা নওয়াজের পড়ানোর সহজ, সাবলীল ও সুন্দর পদ্ধতিটি আমাদের একাডেমিক কঠিন বিষয়গুলো বুঝতে অত্যন্ত সাহায্য করে। তার মতো একজন আন্তর্জাতিক মানের গবেষককে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত।

    এ নারীই নারীদের অবস্থান তুলে ধরছেন বিশ্ব অঙ্গনে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান উপস্থাপনের পারদর্শিতা তাকে দিয়েছে অনন্য সম্মাননা। অসামান্য পারদর্শিতায় সফলতার এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছেন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে খ্যাতি লাভ করেছেন।

    মেধাবী এ গবেষক অস্ট্রেলিয়ার সরকারি বৃত্তি পেয়ে ফ্লিন্ডারস ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সোস্যাল অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ বিভাগ থেকে ২০১৫ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ‘মাইক্রোফিন্যান্স অ্যান্ড উইমেন্স এমপাওয়ারমেন্ট’ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

    এর আগে ২০০৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত স্বর্ণপদক লাভ করেন। লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার এবং স্নাতকেও একই বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক ও ইউজিসি থেকে বৃত্তি তারই দখলে।

    ১৯৯৯ সালে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও ২০০১ সালে হায়ার সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পাস যেখানে সম্মিলিত মেধা তালিকায় এসএসসিতে ১১তম এবং মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ স্থান দখল করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। এইচএসসিতেও কৃতিত্বের সঙ্গে শীর্ষস্থানে চলে আসেন। সম্মিলিত তালিকায় সপ্তম এবং মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করে এগিয়ে যাওয়ার পথকে আরো মসৃণ করে নেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

    এরই মধ্যে ড. ফারাহা নওয়াজের প্রায় ২০টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী পত্রিকা, জার্নালে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রবন্ধ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তিনি লিখেছেন, ‘Strengthening Awareness among Rural Adolescent Girls in Bangladesh: A Case Study on Adolescent Development Program of BRAC’ নামক বই। ২০১১ সালে বইটি জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়।

    এখন শুরু হয়েছে অক্সফোর্ডের ‘School of Interdisciplinary area Studies’ এর হয়ে ‘The Role of working women at the interface of the household economy and external labour market’ নিয়ে গবেষণার কাজ। মূলত এ কাজটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন শীর্ষক একটি গবেষণা। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান— এ তিন দেশের ওপর গবেষণাটি করা হবে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, পালগ্রেভ ম্যাকমিলান, যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত হবে গবেষণার বইটি।

    শুধু শিক্ষকতা আর গবেষণা নয়, পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছে ড, ফারাহার অবদান। কাজ করছেন নেটওয়ার্ক অব এশিয়া প্যাসিফিক স্কুল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটস অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড গভর্নেন্স (এনএপিএসআইপিএজি), ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর থার্ড সেক্টর রিসার্চ (আইএসটিআর), নিউজিল্যান্ডের উন্নয়ন শিক্ষায় নেটওয়ার্কভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ নেটওয়ার্ক (ডেব নেট), নিউজিল্যান্ড সাউথ এশিয়া সেন্টার (এনজেডএসএসি), নারী অধিকারবিষয়ক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর উইমেনস রাইটস ইন ডেভেলপমেন্ট (এডব্লিউআইডি), ইস্টার্ন রিজিওনাল অর্গানাইজেশন ফর পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ (ইআরওপিএ) প্রায় ১০টি অলাভজনক সংগঠনের সঙ্গে।

    একই সঙ্গে শিক্ষকতা, গবেষণা ও স্বেচ্ছাশ্রমের এতসব কাজে অংশগ্রহণ করেও পরিবারকে সময় দিতে কষ্ট হয় না বলে জানান ড. ফারাহা নওয়াজ। তিনি বলেন, পরিবার ও আমার প্রফেশনকে কোয়ালিটি টাইম দিতে চাই। এবং সবসময়ই দিয়ে থাকি। আমার পরিবারও আমাকে বেশ সহযোগিতা করে।

    পিছিয়ে পড়া নারীদের উদ্দেশে ড. ফারাহা বলেন, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, বেশ পরিবর্তন আসছে, তবে আরো অনেক বেশি এগোনো প্রয়োজন। নিজের স্পৃহা, আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস, আত্মোপলব্ধি অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন নানামুখী কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ বাড়ানো। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি। শুধু নারী নয়, পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাদের পথটাকে প্রশস্ত করে দিয়ে সুযোগ দেয়া জরুরি।

    তিনি আরো উল্লেখ করেন, নারীর একটা ভীতি কাজ করে, নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ করে রাখে। ধারাবাহিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। নারীকে বলতে হবে আমি পারি এবং পারব।’

    সূত্র: বণিক বার্তা

    /এসএম

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close