সুনামগঞ্জ-৪: ভোটের মাঠে এগিয়ে মহাজোটের পীর মিসবাহ, বিএনপি-জোটের আছপিয়া
সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলানিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৪ সংসদীয় আসন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় ডজনখানেক মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী এ আসনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ভোটের মাঠে মূল আলোচনা জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ও বিএনপির সাবেক হুইপ অ্যাডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়াকে ঘিরে।
সম্পর্কিত খবর
এবারও মহাজোট থেকে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন পীর মিসবাহ, আর ২০-দলীয় জোট থেকে অ্যাডভোকেট আছপিয়াই শক্তিশালি প্রার্থী। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ভোটের হাওয়া বড় দুই জোটের জনপ্রিয় এ দুই প্রার্থীকে ঘিরে আবর্তিত হবে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা।
নিম্নাঞ্চল অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নানা কারণেই উন্নয়নের সূচকে ছিল অনাগ্রসর।এই দুই উপজেলার তৃণমূলে উন্নয়নের সূচনা করেন বিএনপির তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফজলুল হক আছপিয়া। রাজনৈতিক বৈপরীত্য থাকলেও তার সূচিত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ষোলোকলা বিগত পাঁচ বছরে পূর্ণতা পায় বর্তমান তরুণ সংসদ সদস্য পীর মিসবাহর নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায়। দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটির রাস্তঘাট, সেতু-কালভার্ট, অবকাঠামো, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসহ নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করায় এবং দুঃস্থ মানুষের পাশে সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ও ব্যক্তি ইমেজের বিশাল ভোটব্যাংক গড়েছেন পীর মিসবাহ এমপি।
বড় দুই জোটের দুই নেতারই রয়েছে বিশাল কর্মী-সমর্থকবাহিনী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত জাতীয় পার্টির নেতা পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ
মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেলেও তাকে ভোটের মাঠে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে বিএনপি নেতা ডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়ার সঙ্গে। লড়াইটা হবে হাড্ডাহাড্ডি। এরশাদ মহাজোটে গেলে মহাজোট থেকে পীর ফজলুর রহমান মিসবাহর মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত হলেও বিএনপি জোটের কে তা নিশ্চিত নয়।
এদিকে, এ আসনে তৃণমূলে জনপ্রিয় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত পৌর মেয়র আয়ুব বখত জগলুল। অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী জগলুল স্থানীয় রাজনীতিতে ‘চারা থেকে মহিরুহ’ হয়ে উঠে ভোটের রাজনীতির দৌড়ে তার দলীয় প্রতিপক্ষদের অনেক পেছনে ফেলে দেন। সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করতে না করতেই গত ফেব্রুয়ারিতে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
এদিকে সুনামগঞ্জ সদর আসনে গত সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এনামুল কবির ইমনকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু তৃণমূলে জাতীয় পার্টির ভালো অবস্থান থাকায় শেষ পর্যন্ত মহাজোটের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন জাপার পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ।
চরম দ্বিধাভিবক্ত আওয়ামী লীগ এককভাবে এ আসনে বিজয়ী হওয়ার অবস্থানে না থাকায় জোটবদ্ধ হওয়ার পর থেকে এ আসনটি বার বার পেয়ে আসছে এরশাদের জাপা। এদিকে ‘আপনাদের শাসক নয়, সেবক হতে এসেছি’— এমপি হবার পর এমন ইতিবাচক বার্তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন পীর মিসবাহ।
গত পাঁচ বছর নিজের নিরাভরণ, সরল জীবনযাপন ও সততার সঙ্গে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে এই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটাতে নানা উদ্যোগ নেন তিনি। একদিকে সকল অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনতাকে নিয়ে সাহসী প্রতিবাদ অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেন উন্নয়ন পরিকল্পনা। সাধারণভাবে সরকারি টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন প্রভৃতি সরকারি বরাদ্দ ‘কর্মী পোষায়’ ব্যবহার করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে এমনসব সরকারি বরাদ্দের যথাযথ স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি কঠোর হন। সুনামগঞ্জের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা সুরমা নদীতে সেতু নির্মাণ বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। এতে এলাকার উন্নয়নে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটে।
ব্যক্তিগত সিন্ডিকেট করে জনগণের অধিকার সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, প্রশাসনে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষকে ঘায়েলের অপরাজনীতি থেকেও এ পাঁচ বছর দূরে ছিলেন পীর মিসবাহ। তিনি তার বাড়ির দরজা যেমন মানুষের জন্য দিনরাত খোলা রাখেন তেমনি নিয়ত ছুটে যেতে থাকেন মানুষের মাঝে।
অন্যদিকে নিজস্ব ক্যাডার, সিন্ডিকেট যেমন গড়েননি তেমনি তার বা পরিবারের কেউ কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের টিকাদারি বা তদবিরে জড়াননি। প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করা হয়নি। প্রতিপক্ষদের দমনের অপসংস্কৃতিতেও জড়াননি। দলমতনির্বিশেষে সবার সঙ্গে বিনয়ী ব্যবহারে জয় করেছেন মানুষের হৃদয়। হয়েছেন গণমানুষের প্রার্থী। গড়েছেন পুরো নির্বাচনী এলাকায় ভোটব্যাংক। আর কমিটি! কি নারী, কি বৃদ্ধ, কি তরুণ তিনি এক ঘণ্টার নোটিসে ডাকলেই তারা ছুটে এসে গণজোয়ার তৈরি করেন। এতে আগামী নির্বাচনে পীর মিসবাহকে ভোটের মাঠের একজন তুমুল জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত তিনি ব্যাপক জনসংযোগের মাঝেই আছেন।
এদিকে পীর মিসবাহ এসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাঝেও বসে নেই মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মর্যাদার আসনটি নিজেদের অনুকূলে আনার দাবি তুলছেন তারা। তবে অতীতের বিভিন্ন নেতাবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে দাবি তোলা অন্যতম দুই সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছেন ইমেজ সংকটে। তার একজন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান জাপার বেগম মমতাজ ইকবালের মৃত্যুর পর ১০ম সংসদের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় সিন্ডিকেট পরিবেষ্টিত হয়ে যারপরনাই সমালোচিত হয়েছিলেন। যে কারণে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় নাম পর্যন্ত ছিল না সাবেক এই সংসদ সদস্যের।
এছাড়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ মতিউর রহমান আগামীতে ভোটের মাঠে কতখানি পেরে উঠতে পারবেন এ নিয়েও নেতা-কর্মীদের মাঝে রয়েছে সংশয়। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নূরুল হুদা মুকুট দলীয় মনোনয়ন চাইবেন— এমনটা শোনা গেলেও গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ পদটি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবেন কিনা, এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও দলের কর্মীদের বড় অংশই তার সঙ্গে।
এ আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন নির্বাচন করতে চাইলেও জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েও বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে শোচনীয় ভরাডুবি হওয়ায় চরম ইমেজ সংকটে পড়েন তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হঠাৎ নেতা হওয়া ইমনের দল বা মানুষের মাঝে নির্বাচন করার মতোন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জ সদর আসনে বিরোধী দল বিএনপিতে ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আলহাজ ফজলুল হক আছপিয়াই নানা কারণে ২০-দলীয় জোটের শক্তিশালী প্রার্থী। সংসদ সদস্য হিসেবে এ আসনে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করায় প্রতিটি এলাকায় রয়েছে তার বিপুলসংখ্যাক কর্মী-সমর্থক আর ব্যক্তিগত ইমেজ। অতীত উন্নয়নের জন্যও সাধারণ ভোটারদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
দ্বিধাবিভক্ত জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বড় অংশ রয়েছে আছপিয়ার অনুকূলে। নির্বাচনে প্রার্থী হলে এসব নিয়ামক ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে আছপিয়ার পক্ষে। এদিকে ভোটের মাঠে আছপিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন চারবার উপজেলা চেয়ারম্যান ও একবার পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন।
জাকেরীনেরও ক্লিন ইমেজ যেমন আছে তেমনি পারিবারিক প্রভাব আছে। তবে নেই গণসম্পৃক্ততা। এ ছাড়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলয় সৃষ্টি করে দীর্ঘ রাজনীতি করে আসা জাকেরীনের সঙ্গে দলের বৃহত্তর অংশের নেতা-কর্মীদের যোজন দূরত্ব দীর্ঘদিনের। বিএনপির রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তাদের ‘আপনজন’ কোনো দিনই ছিলেন না তিনি। দলের সঙ্গে এমন দূরত্ব নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে তার পক্ষে কতটা সাফল্য নিয়ে আসা সম্ভব— এ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। বিগত উপজেলা নির্বাচনে তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে আছপিয়াসহ নেতাকর্মিদের দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়েছে। এদিকে বিএনপি থেকে এ আসনে আরও মনোনয়ন চাইতে পারেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল লতিফ জেপি, নাদির আহমদ, সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নূরুল ও জেলা যুবদল সভাপতি আবুল মনসুর শওকত।