• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পীর হাবিবের শুভ জন্মদিন ও সাহসী সাংবাদিকতার স্বরুপ

প্রকাশ:  ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৩১ | আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ২০:৩৭
ছরওয়ার হোসেন, নিউ ইয়র্ক থেকে

১২ নভেম্বর ২০১৮ ছিলো দেশবরেণ্য সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন। যিনি একাধারে একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিষ্ট, টেলিভিশনের টক'শো উপস্থাপক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং আরো অনেক কিছু। প্রকৃতির নির্মম সত্যের ধারায় দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক এ গুণী ও প্রতিভাধরের ক্ষয়িষ্ণু জীবনকালের যাত্রাপথ থেকে ছিন্ন হলো আরেকটি বছর। অনাবিল সুন্দর ও সফলতায় পূর্ণ ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় নবজীবনের যাত্রা হলো শুরু। তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত সুখকর, আনন্দময় ও কল্যানকর অভিলাষগুলো পূর্ণ হোক। সফলতায় প্রজ্জ্বলিত হোক। নবজীবনে মধ্যাহ্ন গগণের সূর্য হোক দীপ্তিময়। এ প্রত্যাশায় অশেষ শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

দেশ থেকে প্রবাসে আসার সাত বছর হলো। সাত বছর পূর্বেও পত্রিকার কলাম পাঠে আমার কাছে কলামিষ্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, এবিএম মুসা, আবেদ খাঁনের লেখা ছিলো চিত্ত জাগানীয়া। তাঁদের ব্যাপক জনপ্রিয়তার দরুণ আগের দিন পত্রিকার কোনে পরের দিন তাদের কলাম প্রকাশের বিজ্ঞাপনও দেওয়া হতো। পত্রিকাগুলো কেনার বা কোনমতে পড়ে নেওয়ার ঝোঁক কাজ করতো। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠ করতাম। তাঁর নিবন্ধ প্রকাশ করলে পত্রিকাই কিনে নিতাম। কখনো একটি নিবন্ধ পড়ে মনে হতো পত্রিকা কেনাটা সার্থক হয়েছে।

সম্ভবতঃ ২০০৭ সাল। প্রথম পরিচিত হলাম সাংবাদিক পীর হাবিবের লেখার সাথে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হতো। তখন দেশে মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের শাসন চলছে। দেশের বিভিন্ন দলের বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের বিশাল দূর্ণীতির খবরগুলো প্রকাশ হতো। মূলতঃ তখন থেকেই দেশের রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ও আবেগে ভাঙ্গন ধরে। মানুষ ‘নেতা’ শব্দটিকে বিবেকের নিক্তিতে ওজন করতে শুরু করে। তাদের বাহ্যিক চরিত্রের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয়াল জগতের সাথে মানুষের ব্যাপক পরিচয় ঘটে। আমাদের প্রজন্ম প্রথমবারের মতো এ ভয়ানক জগতটাকে চিনতে পারে। আদর্শ, চেতনা আর আবেগময় বুলির বাইরে অনেক সুপ্রসিদ্ধ নেতার দূর্ণীতিগ্রস্থ চরিত্রও পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন ছাপা হতে থাকে, যা দেশব্যাপী মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়। তাদের এই ধিক্কারজনক চরিত্র উদ্ভাসনে আমার মতো অনেকেই তখন থেকে আবেগময় বক্তৃতা অার দেশকল্যানের চেতনাময় ফাঁকা বুলিতে বশীভূত হওয়ার পূর্বে যুক্তির নিক্তিতে পরিস্থিতির বিচারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ভারতবর্ষের রেনেঁসা আন্দোলনে যে দীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান হেনরি লুইস ভিবিয়ান ডিরোজিও। মাত্র বাইশ বছরের জীবনে সতেরো বছর বয়সে কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষকতায় অভিসিক্ত হয়েই যিনি ভারতের তরুণ সমাজকে “যুক্তি ছাড়া কিছু মেনে নিও না”র দীক্ষা দিয়েছিলেন। যার প্রভাব উনিশ শতকের ভারতীয় চিন্তা চেতনার জাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।

যদিও ইতোপূর্বে তাঁর রচিত ‘অফ দ্যা রেকর্ড’ গ্রন্থের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তথাপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকাল ২০০৭সাল থেকেই তাঁকে কলামিষ্ট হিসেবে প্রথম নিয়মিত লিখতে দেখি। আবেগময় লেখনী। তরঙ্গময় শব্দ আর বাক্যের ছন্দময়তা পাঠকদের মোহাচ্ছন্ন করেছিলো। অল্প সময়েই তাঁর লেখার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ি। দিনে দিনে আবিস্কার করি প্রতিকুল পরিবেশে এক সাহসী কলম সৈনিককে।

প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আদর্শ, চেতনা বা বিশ্বাসের প্রতি তাঁর নিজস্ব দুর্বলতা থাকাটা অতি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মন্ত্রীপাড়া বা সচিবালয় থেকে পাড়ার কুড়ে ঘর পর্যন্ত যখন রাজনীতির বিকাশ বাধভাঙ্গা জোয়ারে প্লাবিত, দলে দলে, গ্রুপে গ্রুপে হানাহানী, মারামারী, দলবাজী, গলাবাজী বা বুদ্ধি বিবেচনাহীন দলদাসত্বের অবারিত উর্বর ক্ষেত্র বিদ্যমান, সেখানে রাষ্ট্রের সুচিন্তা ও বুদ্ধি বিবেচনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সাংবাদিকতায় মানুষ একেবারে রাজনৈতিক আদর্শ -চেতনার সাথে অস্পৃশ্য থাকবে, তা সম্ভব নয়। এদেশে একই মায়ের সন্তান ভিন্ন দল ও আদর্শে বিশ্বাসী। সাংবাদিকগণও সে মায়েরই সন্তান। দেশব্যাপী সুপরিচিত খ্যাতিমান সাংবাদিক হোক আর মফস্বলের অখ্যাত হোক একজন সাংবাদিকের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক স্বত্বা থাকবে, আদর্শ চেতনার সাথে সম্মিলন থাকবে, কিন্তু, তাঁর চিন্তা, লেখনি ও রাজনৈতিক ভাষ্যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থাকবে যা জাতির প্রত্যাশা। এর বেততয়ে মানুষ বেদনাহত হয়। সংবাদপত্র বা প্রচার মাধ্যম এদিক দিয়েই জাতির দ্বিতীয় পার্লামেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে। এখানেই সাংবাদিক সমাজের অপরিসীম গুরুত্ব। তাই বিশ্বের ইতিহাস শ্রেষ্ট রাজনীতিক, সমাজকর্মী, সিলেব্রিটিসহ সকল পথের মতের মানুষ সংবাদ মাধ্যমকে সমীহ করেন।

কিন্তু, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপঠে রাজনৈতিক বিভাজন ও সরকারী সুবিধাভোগী-লোভীদের পরাক্রমশীল ঔদ্যত্বে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে দূষিত ও দূর্ণীতিগ্রস্থ ক্ষেত্রগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এ ধারা বছরের পর বছর থেকে যেভাবে চলছে সেভাবে চলমান থাকলে অদুর ভবিষ্যতে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রগতিশীল সমাজে বিদ্যাবুদ্ধিতে বিকশিত অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের প্রথমেই সাংবাদিকতা পেশাকে অবজ্ঞা করতে শিক্ষা দিবেন। যেমন আজকাল অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ছাত্ররাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও যা ঘৃণার চোঁখে দেখে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে চিন্তা, নৈতিকতা ও সৃজনশীলতার দিক দিয়ে একটি অন্ধকার সময় বিরাজমান, তা আমি নির্দ্ধিধায় বলতে পারি। যদিও দেশে আজ সংবাদপত্র, টেলিভিশন, পোর্টাল প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে, কিন্তু, উপরোক্ত কারণেই সংবাদ মাধ্যমের উপর দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, মানুষ চায় দূর্ণীতি ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে সংবাদ মাধ্যমের স্পষ্ট অবস্থান। যা হবে জাতির জন্য অশেষ কল্যানকর।

এরই আলোকে যদিও সাংবাদিক পীর হাবিব ছাত্রাবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ চেতনাকে ধারন করেছিলেন, এর জেরে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে কিছুদিন কারাবাসও করেছিলেন এবং আজও তাঁর আদর্শ ও সাহসের শেষ ঠিকানা হিসেবে হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই হৃদয়ের অন্তস্থলে ধারণ ও লালন করেই যাচ্ছেন তথাপি, তীব্র দলীয়করনে বিভাজিত ও নতজাঁনু সাংবাদিকতা এবং সংবাদমাধ্যমকে ঘিরে জনমনের নিবু নিবু দীপের আলো আধারের প্রত্যাশার মাঝে তিনি একটি আলোকবর্ত্তিকায় উদ্ভাসিত হয়েছেন। তাঁর চিন্তা ও লেখনি প্রতিবাদের ভাষায় স্পষ্টবাদিতাপূর্ণ। রাজনৈতিক ধারাভাষ্যে বা টকশোতে শব্দ ও বাক্যের ভদ্র, বিনয়ী ও স্পন্দিত উচ্চারণ অন্যায়, অসত্য এবং দূর্ণীতির বিরুদ্ধে জনমনকে জাগ্রত ও ঊজ্জীবিত করতে প্রেরণা যোগায়। যার ফলে দলমত নির্বিশেষে দেশব্যাপী তাঁর অসংখ্য গুনগ্রাহী বিদ্যমান। দেশে বিদেশে শুভানুধ্যায়ীদের দ্বারা তিনি সংবর্ধিত হন। কারণ, মানুষ তাঁর লেখা পড়তে ভালোবাসে, রাত জেগে টক’শোতে জনকল্যানমূলক ভালো ও উদ্দীপনাময় কিছু শুনতে ভালোবাসে। এজন্য আমিও তাঁর কর্মের প্রতি প্রেমাসক্ত। আরো ক’জন গুণী সাংবাদিকের প্রতি আমার একই রকমের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা বিদ্যমান, যাদের মধ্যে নিউ এজ’র সম্পাদক নুরুল কবির, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম ও সাংবাদিক, কলামিষ্ট গোলাম মোর্তজা অন্যতম।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন আমেরিকায় খুবই জনপ্রিয়। নিউ ইয়র্কে কোন কোন রেষ্টুরেন্টে কাষ্টমার বা গেষ্ট আকৃষ্ট করতে মার্ক টোয়েনের পানকৃত ওয়াইন, ককটেল বা অন্যান্য বেভারেজকে মেন্যুতে উপস্থাপন করা হয়। লেখালেখির বিষয় ছাড়াও আমেরিকার নারী আন্দোলন, সার্বজনীন ভোটাধিকার আন্দোলন, সিভিল রাইটস বা সমাধিকার আন্দোলনের প্রিয় মুখ ছিলেন মার্ক টোয়েন। তাঁর বক্তৃতা মানুষকে উজ্জীবিত করতো। অনুপ্রেরণা দান করতো। মার্ক টোয়েন রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট উভয়ের কাছেই জনপ্রিয়। আবার তিনি উভয় দলের সরকারের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন। আমেরিকার প্রগতিশীল আন্দোলনে আজও মানুষ মার্ক টোয়েনকে অনুসরণ করে। আজ বাংলাদেশে নীতিহীন ও নৈতিকতাহীন শুধু নয়, যুক্তিহীন বিনয় প্রদর্শনে উদ্ধত দলদাস বা দলবাজদের প্রচন্ড ভীড়ে বিভিন্ন ইস্যুতে যখন দলাদলীর উর্দ্ধে উঠে কিছু মানুষকে প্রতিবাদী হতে দেখি, বলতে দেখি, লিখতে দেখি তখন ভালো লাগে। ব্যস্ততার মাঝেও তাদের কথাগুলো শুনি, লেখাগুলো পড়ি। এরা আবার সরকারদলের সাপোর্টারদের কাছে বিরোধী দলের স্পাই বা বিরোধী দলের সমর্থকদের কাছে সরকারদলের তল্পীবাহক বলে পরিগণিত। সরকারের সমালোচনায় সামান্য পেনস্লিপের দরুণ তাদের চাকুরী যাবার যেমন ভয় থাকে, তেমনি বিরোধী জোটের আগুন সন্ত্রাস বা দূর্ণীতির বরপুত্রদের কুকীর্তির বিরুদ্ধে লিখলে সকালে ঘুম থেকে জেঁগে ঘরের কোনে কাঁফনের কাপড় দেখতে পায় বা পায় নৃসংশ মৃত্যুর পরোয়ানা। তারপরও তারা বলেন, লিখেন, প্রতিবাদ করেন। একটি রাষ্ট্রে যখণ এ ধরণের আলোকিত ও সময়োপযোগী সাহসী মানুষের অতিমাত্রায় অভাব অনুভূত হয় তখন বুঝতে হবে সে রাষ্ট্র শোষক দ্বারা শাসিত হচ্ছে কিংবা রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ সৃজনশীলতা ও মানবিকতা বিবর্জিত। সে রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকে ধাবমান। জাতির সৌভাগ্য যে, এতো রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানীর মধ্যেও কিছু মানুষ নির্ভয়ে বুক চিতিয়ে অসত্য, অন্যায়, দূর্ণীতি ও অন্ধকার কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে দূর্জয় সাহসে জাতিকে সাহসী ও অনুপ্রাণিত করেন। সে যে দলেরই হোক, আমি সর্বদা তাঁদের নত মস্তকে চিত্ত বিগলিত শ্রদ্ধা জানাই।

কিছুদিন পূর্বে নিউ ইয়র্ক সফররত সাংবাদিক পীর হাবিবকে তাঁর অবস্থানস্থল জ্যামাইকার বাসা থেকে নিয়ে ট্যাক্সিতে করে যখন জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত মতবিনিময় সভার যাত্রাপথে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘আপনি যে সরকার বা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এতো স্পষ্ট ভাষায় লেখেন বা বলেন দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে আপনার কি ভয় হয়না? বলুনতো, সাহসের উৎসটি কি? তিনি বললেন, “বঙ্গবন্ধু”। অনেক আলাপ হলো। মতবিনিময় সভায় তিনি বিষয়টি আরো খোলাসা করলেন। বলেছিলেন, আমার ঔদ্যত্বের উৎসও ‘বঙ্গবন্ধু’। আমি মনে করি সৎ সাহসীরা বঙ্গবন্ধুর মতোই হয়। আর লেখনীতে কলমের সঙ্গে খুব বেশী আপোষ করা সম্ভব নয়, যতটুকু রাজনীতি বা সমাজের সাথে করা যায়। কারণ, কলম তার নিজস্ব গতিতে চলে। একে রোধ করতে গেলে লেখকের নিজস্ব স্বত্ত্বা ধুমড়ে মুচড়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাজনীতি তা মানতে চায়না। রাজনীতি চায় জগতের সবকিছু তার আজ্ঞাবহ হোক, সমালোচকরা হোক তিরোহিত, সে যা ইচ্ছা তাই করবে, কেউ সমালোচনা করলে আপন শক্তিময়তায় তাকে গলা টিপে হত্যার কৌশল রাজনীতিকদের ভালোই রপ্ত করা আছে। তাই পীর হাবিবরা দেশে বিদেশে কোথাও নিরাপদ নয়। ওরা বেঁচে থাকে হিংস্রতার ছোবলের মাঝে। তাইতো যেদিন লেখা চলে যায় তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে সেদিন লেখককে কাফনের কাপড় প্রদর্শন করা হয়, আবার যেদিন লেখা হয় সরকারের সমালোচনায় সেদিন চাকুরী হারাবার ভয় জাগে, পত্রিকা বা পোর্টাল যাই হোক তার রেজিষ্ট্রেশন বাতিলের সম্ভাবনা তাড়িয়ে বেড়ায়।

এসব ভয় জয় করেই পীর হাবিব ও সাহসী সাংবাদিকগণ যখন সরকারের মন্ত্রীদের দূর্ণীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, কারো অপরাজনীতি ও কুকীর্তির বিরুদ্ধে লেখেন তখন মানুষ সত্যান্বেষনের প্রবৃত্ত হয়। অনুপ্রেরণা লাভ করে। তিনি সরকারের প্রতি সাংবাদিক সমাজের নতজাঁনুতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, কালো আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের বিরুদ্ধে অনবরত লিখেই যাচ্ছেন, সাংবাদিকদের দলবাজীর প্রতি প্রতিবাদী হন, প্রকাশ্যে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন ব্যক্ত করেন বা শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও তাদের পাশে দাড়ান। আমি এসবের মাঝে তাঁর মধ্যে কোন কপটতা লক্ষ্য করিনা। আমি মনে করি দেশের সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের এরকম সৎসাহসী হওয়াই কাম্য। যা আরো অনেকের বেলায়ও বিদ্যমান।

মজার বিষয় যে,বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবিগণ যেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের নানামূখি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ অথবা তাদের অসাম্প্রদায়িক অবস্থানকে আরো বেশী ক্ষুরধার রুপে উপস্থাপনের কপটতাপূর্ণ নেশায় বুদ হয়ে মাঝে মধ্যে নাস্তিকদের সুরেও কথা বলতে লক্ষ্য করা যায়, সেখানে পীর হাবিব জ্বলন্ত মশালের মতো ধান্ধাবাজ নাস্তিকদের ভন্ডামীর বিরুদ্ধে কথা বলেন, আপন চিন্তার ক্ষুরধার প্রকাশ ঘটান। অন্যদের মতো অসাম্প্রদায়িক স্বত্বা হারানোর অপচিন্তায় কন্ঠকে রুদ্ধ না করে বলেন, “ভন্ড নাস্তিকদের দৃষ্টিতে কি শুধু ইসলাম ধর্ম পড়ে আর কি কোন ধর্ম নেই?” একই সাথে তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাসের প্রতি গুনকীর্তনও করেন। যা বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবি মহলে বিরল।

সাংবাদিক সমাজের নানান গুণকীর্তন ও অসঙ্গতির বিপরিতে আমরা যারা পাবলিক আমাদের কিছু বিদঘুটে বিষয়ও নিবন্ধে উল্লেখ করা যায়। আজ থেকে প্রায় বছরখানেক পূর্বে বাংলাদেশ প্রতিদিনে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের উপর পীর হাবিবুর রহমানের লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী বিএনপি নেতাকর্মীগণ লেখকের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অনেকে তাঁর ফেসবুক তীর্যক ও বিষাক্ত মন্তব্য, ষ্টেটাস প্রদান করেন। এমনকি ক্ষমতায় গেলে তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকী দেন। আমি অবাক হয়েছিলাম। লেখাটি তারেক রহমানের রাজনৈতিক সমালোচনার আলোকে এ যাবত প্রকাশিত শ্রেষ্ট লেখা বলে মনে হয়েছিলো। কেননা লেখার গুনমানের দিক দিয়ে এটি একটি সার্থক সমালোচনা ছিলো। যেখানে তারেক জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন এবং তাঁর কৃতকর্মের খারাপ ও ভালো দুটি দিক ফুটে উঠেছিলো। কিন্তু, দেশব্যাপী বিএনপি নেতাকর্মীগণ কেবল তাদের নেতার গুণগান শুনতে পছন্দ করেছিলেন, তাই মন্দ দিকের প্রকাশেই লেখককে নাস্তিক, মূর্তাদ, ভারতের দালাল বা সরকারের পুতুল বলতে কার্পণ্য করেননি। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগেরও ’খাটি’ নেতাকর্মীদের নিকট তিনি প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে আভির্ভূত হন যখন সরকারের নানারকম ব্যর্থতার সমালোচনা করেন। কয়েকমাস পূর্বে তিনি নিউ ইয়র্ক সফর করেছিলেন। ঐ সময় নিউ ইয়র্কস্থ সিলেটবাসীদের বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের উদ্যোগে পূর্বোল্লেখিত মতবিনিময় সভায় তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কাজী ছহুল হোসাইন। সেখানে বক্তৃতায় দাড়িয়ে পীর হাবিব আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক গুণগানের পাশাপাশি সুন্দর ভাব ও ভাষার সমন্বয়ে কিছু ক্ষেত্রে স্বভাবসিদ্ধ সমালোচনা করলে আমার পাশে থাকা ‘খাটি’ আওয়ামী লীগার ভদ্রলোক আমাকে চুপিচুপি বললেন, “যার যে স্বভাব! এই দেখো সরকারের বিরুদ্ধে না বললে যেন পেঠের ভাত হজম হয় না।” আমি স্মিতহাস্যে বললাম, 'উনিতো ছাত্রলীগ করেছেন, তাই বরং একটু কম বলছেন, নুরুল কবির হলে আরো বেশী বলতেন।' গত কিছুদিন পূর্বে তিনি নিউ ইয়র্ক বেড়াতে আসলে বিয়ানীবাজার বার্তা ২৪ ডট কম’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দানকালে ঠিক একই রকম সরকারের অনেক প্রশংসার পাশাপাশি যখনই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উপর ও শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের উপর বলতে লাগলেন তখন একজন আমাকে বললেন, "সাংবাদিকদের এজন্যই আমি বিশ্বাস করিনা।" অথচ ঐ ব্যক্তিই ( আমার খুবই প্রিয়ভাজন) নিউ ইয়র্কে পীর হাবিবকে নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করার জন্য আমাকে তিনবার কল দিয়েছিলেন। কারণ, উনার কাছে পীর হাবিব একজন 'সাহসী সাংবাদিক'। অর্থাৎ, এটাই প্রমানিত যে, আমরা বাঙালিরা আপন গুনের মাধুর্য্যতায় কাউকে ভালোবাসতে পারি তবে তার কাছ থেকে নিজের মত, পথ ও আদর্শের বিরুদ্ধে কিছু শুনতে পছন্দ করিনা। আর তাই, পরমত সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের প্রচন্ড অভাবই বাঙালির জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসেবে উপণিত হয়েছে। যেখানে সৃজনশীল সাহসী সাংবাদিকতা ছুরির নীচে বাস করে।

দেশে যখন নীতি নৈতিকতাহীন দূর্ণীতিবাজ রাজনীতিকদের ঔদ্ধ্যত্বের মাত্রা বেড়েই চলছে, আদর্শ ও চেতনার নামে স্বার্থান্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল দলবাজদের দৌরাত্ন্য ও রণহুংকারে সমাজ তটস্থ ও প্রকম্পিত, নীতি-নৈতিকতা ও বিবেক বুদ্ধিহীন দলদাসদের উন্মত্ত জোয়ারের নিকট রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে ক্রমশও ধরাশায়ী, তখন দেশব্যাপী সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের সবাই যদি পরিস্থিতির সঙ্গে

আপোষের অন্ধকারে আপন স্বত্ত্বা হারিয়ে স্বার্থের লিপ্সায় আঁতাত করে তবে নানান ঘাত প্রতিঘাত ও অাশা দুরাশার তলানীতে দুদূল্যমান বাংলাদেশকে নিয়ে যতোটুকু সপ্ন দেখা সম্ভব তাও অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবে। যা রোধ করতে প্রয়োজন স্বাধীন, স্বচ্চ ও সাহসী সাংবাদিকতা। যা হতে পারে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জাগরণ শক্তি।

সৎপথে, সৎ উদ্দেশ্যে, রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যানে দলমত নির্বিশেষে সকলের জাগরণ ও অংশগ্রহন অব্যাহত থাকুক। তবেই আমরা দূর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিমন্ডল ভেদ করে একটি আলোকিত, প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি রচনা করতে পারবো। নবজাতকের কাছে যেমন আমাদের দৃঢ় অঙ্গিকার রয়েছে তার জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রচনা করে যাওয়ার, তেমনি তা বাস্তবায়নের জন্য সকলকে সৎ সাহসী ও প্রয়োজনে দলমতের উর্দ্ধে উঠার সংস্কৃতি লালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিবাদ করা মানেই দলবিরোধিতা নয়, প্রতিবাদ করা মানেই বিদ্রোহ নয়। প্রতিবাদ হচ্ছে আমার ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির হাতিয়ার। প্রতিবাদ ব্যতিত রাজনীতি অন্ধ। তাই যে কোন বিষয়ে সমাজের চক্ষু না খোলা পর্যন্ত হোক প্রতিবাদ। এভাবেই জাগ্রত হোক মনূষ্য বিবেক। সাহসী সাংবাদিকতা যার প্রধান অস্ত্র।

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ।

সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close