• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জীবনের ভাবনা পলে পলে বদলে যায়

প্রকাশ:  ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ০১:৪১
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আমাদের ভাবনাগুলো খুব বিচিত্র হয় | নিজের চিন্তাকে এক জায়গায় ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে যায় | মনে হয় অচেনা রাজপথে এসে পথ হারানো মানুষদের মিছিল | বাস্তবতার মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করতে আমাদের যেন অনেক ভয় | তখন টেনে আনি কল্পনাকে | সেটাও মন্দ নয় | কল্পনা আর বাস্তবতাকে হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখাটাই বুঝি জীবন | এই জীবন তৈরী করে অভিজ্ঞতা | প্রতিদিন ঘুম ভেঙে দেখি পৃথিবী একটা নতুন খবর দেবার জন্য বসে আছে | সময় স্বপ্নকে এসে জানিয়ে দেয় জীবন একটা কঠিন তপস্যার নাম, যা প্রতিটি মুহূর্তে রং বদলায় |

১ .

সম্পর্কিত খবর

    আজ অনেকটা বছর পর বুঝতে পারছি গবেষণা একটা বিরাট শক্তি। যেটার জন্ম হয় উদ্ভাবন থেকে। উদ্ভাবন মানে আমি একটা নতুন, ফালতুও বলা যায়, এমন আইডিয়া চিন্তা করছি। সেটা কাল্পনিক হতে পারে আবার বাস্তব ধারণা থেকেও হতে পারে। সায়েন্স ফিকশন গল্পগুলো ছোটবেলায় খুব বেশি পড়তাম। তখন মনে হতো এটা কি কখনও সম্ভব। লেখক নিশ্চিতভাবে অসম্ভব কিছু ভাবছে। এখন বুঝি, লেখক বিজ্ঞান জানত না, গবেষণা বুঝত না; কিন্তু তার মধ্যে এমন সব অদ্ভুত ধারণা ছিল, যেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভেবেছে। ভাবতে হয়েছে। তার মানে লেখক বিজ্ঞানকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীদের ব্যস্ত রেখেছে। একটু একটু করে লেখকের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করেছে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার, লেখকের উদ্ভাবনকে বিজ্ঞানের জাদু লাগিয়ে গবেষকরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এটা এখন আমি মেনে নিই, লেখকরা বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞানের নতুন ধারণা দিয়ে তারা প্রমাণ করেছে তারা যেমন অতীতকে দেখে, তেমনি বর্তমান আর ভবিষ্যৎকেও দেখতে পায়। আরেকটা অদ্ভুত বিষয়, কবিরা আকাশের চাঁদকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। কাগজের পর কাগজ ছিঁড়ে চাঁদের অপূর্ব রূপকে বর্ণনা করেছে। চাঁদকে ধরতে চেয়েছে, চাঁদে গিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার, আমেরিকার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট কেনেডি ১৯৬২ সালে কবির ভাবনার কথা বলে ফেললেন। আমেরিকা চাঁদে যাবে। সবাই ভাবছে নিছক কল্পকাহিনি। কিন্তু ১৯৬৯ সালে আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখলেন। এত সহজ বিষয় এটা ছিল না। কবি ভেবেছেন, কেনেডি ভেবেছেন, বিজ্ঞানীরাও ভেবেছেন আর স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে। ভাবা যায়, এটাও সম্ভব। এরপর রাশিয়াসহ পাল্লা দিয়ে অনেক দেশের মহাশূন্য অভিযান। এখন তো মহাকাশে তারকা যুদ্ধসহ কত ধরনের গবেষণা আর তার বাস্তবায়ন ঘটছে। হয়তো বলে শেষ করা সম্ভব নয়। একটু অবাক মনে হলেও কল্পনার রূপকথা এখন সত্য। ভাবা যায়, প্রকৃতি মানুষকে বিজ্ঞানের ধারণা দেয়। যদিও অনেকে বলেন এগুলো গল্প ছাড়া কিছু নয়। তারপরও তো সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে বসিনি, যা শুনেছি তাই বলছি। আপেল পড়া দেখে নিউটন আর চৌবাচ্চায় গোসল করতে গিয়ে আর্কিমিডিস এরা দুজন এমন কিছু আবিষ্কার করলেন, যা মানুষ আগে কখনও ভাবেনি। অনেক কিছু আমরা দেখি। সেখান থেকে সৌন্দর্য নিলেই চলবে না, বরং সেখান থেকে ধারণা তৈরি করা যায় কি না, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। কারণ আনন্দের মধ্যেই সৃষ্টি লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় আমরা গালগল্প, এটা-ওটা করে, সময় গুনতে গিয়ে দেখি আরে জীবনটা তো শেষ হয়ে এলো। টগবগে সকালের সূর্যটা পড়ন্ত বিকেলে যেমন হেলে পড়ে, মানুষের বয়সের ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটে যায়। কী দরকার এত কিছুর। নিজে সৃষ্টি করি, সৃজনশীল হই, তেমনি অন্যকেও সৃষ্টি করতে আর সৃজনশীল হতে অনুপ্রাণিত করি। হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, লালসা বস্তাবন্দি করি। অন্যের অনিষ্ট করা, দুর্নাম করা বন্ধ করি।

    মানুষের ছোট একটি ভাবনাকেও বড় করে দেখি, তাকে স্বপ্ন দেখাই। আলোড়িত শিহরিত করি। কারণ ছোট ভাবনা থেকেই একদিন বড় বড় ভাবনা মাথা থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীকে চমকে দেয়। সময় সৃষ্টির রাস্তা দিয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে হেঁটে নতুন সভ্যতা গড়ার দিকে অগ্রসর হয়। জীবনের ভাবনা আর সৃষ্টিগুলো ছড়িয়ে দিই সময় থেকে সময়ে, সভ্যতা থেকে সভ্যতায়। তবেই না আমরা মানুষ। তবেই না বিশ্ব জয়ের আনন্দ। শুভদিন, সম্ভাবনা আর অমিত মাহেন্দ্রক্ষণ। কারণ মানুষকে কখনও হারতে নেই। কঠিন একটা দিনের পরই আসে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার দিন। সেটা যারা পারে তাদের কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। সবার ইতিবাচক ভি-চিহ্নের প্রতীক্ষায় বসে থাকে সময়, নদী, পাহাড় আর আকাশের অজানা নক্ষত্র।

    ২ .

    মানুষের জীবন যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সময় মানুষকে আনন্দিত করে, আবার সময় মানুষকে বেদনার্ত করে। সব দোষ যেন সময়ের। সময়ের ঘাড়ে দোষ চাপানো মানুষের স্বভাব। এ দোষ চাপানোটা এখন আমাদের এক ধরনের কালচার হয়ে গেছে। ভাবটা- সবার এরকম, আমি একমাত্র পৃথিবীতে মহাপুরুষ; নীতিবান আর সাধু। আর দুনিয়ার সবাই বিপথগামী।

    আমরা যখন একটা ভুল করে ফেলি, তখন একটাই চিন্তা- কীভাবে এ দোষটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে বিপদমুক্ত রাখা যায়। কোনো ভালো কিছুর ক্রেডিট নিতে আমাদের মতো ওস্তাদ আর দুনিয়ায় নেই। কিন্তু কাজটা যখন খারাপ হয়, তখন একে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বেমালুম বিষয়টা থেকে সটকে পড়া আমাদের চিরায়ত স্বভাব। ভালো কাজের ক্রেডিট নেব আর মন্দ হলে নিজেকে সাধু বানিয়ে অন্যকে চোর বানাব, সেটা তো হয় না।

    ভালো কাজ করলে বিনীত হতে হয় আর মন্দ কাজ করলে সেটার দায়িত্ব নেয়ার সাহস থাকতে হয়। কিন্তু সেখানেই আমাদের সাহসের কোনো চিহ্ন নেই বরং এ জাগাটায় আমরা সবাই একেকজন কাপুরুষ।

    ভারতে একজন রেলমন্ত্রী ছিলেন। নামটা হয়তো সবাই জানেন। তার নাম লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। আপনি হয়তো বলবেন, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভুল বলেননি। কিন্তু তিনি কি এত সহজে প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন? না। তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন রেল দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি রেলমন্ত্রী- তাই রেল নিয়ে পরিকল্পনা আর উন্নয়ন করবেন। তিনি তো রেলগাড়ি চালাবেন না! একদম ঠিক, তিনি রেল চালাননি। কিন্তু দুর্ঘটনার দায়ভার নেয়ার সাহস দেখিয়েছেন। যেটা ভীরুরা পারে না, বীররাই পারে। মানে নিজে বিনীত হয়েছেন। এতে তার সুনাম বেড়েছে। সব মানুষের আস্থা আর গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় পরিণত হয়েছেন। তার প্রতিদানে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই মহতী কথাটা মনে পড়ে- ‘মহাঅর্জনের জন্য মহাত্যাগ দরকার।’ এর প্রমাণ লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।

    কেউ ভালো করলে আমরা নাক সিটকাই। কীভাবে সেখান থেকে খুঁত বের করে সমালোচনা করা যায়, সেটাই যেন মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অর্জনটা বিসর্জন হয় আর সমালোচনাটা মানুষের সময় নষ্টের একটা উপাদান হয়ে যায়। ফলে সেখান থেকে শোরগোল আর শোরগোল থেকে গণ্ডগোল শুরু হয়। ভালোও করা যাবে না, খারাপও করা যাবে না। তাহলে মানুষ কী করবে! মোদ্দাকথা, কোনোকিছু না করে কীভাবে একজনের অনুপস্থিতিতে তার দুর্নামের বেলুন ফুলিয়ে সেটাকে সবাই মিলে ফাটানো যায়, সেটাই যেন মহা আনন্দের বিষয় হয়ে থমকে যায়।

    আরেকটা জিনিস মানুষ খুব পারে- সেটা হল নিজেকে বিদ্বান বানিয়ে অন্যকে কীভাবে হেয় করা যায়। যেন দুনিয়ার সব একাই সে বোঝে আর বাকি সবাই অপদার্থ ও মহামূর্খের দল। তার জাদুকরী চতুর কথায় রথী-মহারথীরা পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়।

    মহারথীরা ভাবে, একটা হীরকখণ্ড তার হাতে এসেছে। এ পরশ পাথর দিয়ে তারা দুনিয়া পাল্টে ফেলবে। না মশাই, এমনটা না ভাবাই ভালো। বরং উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ যত গর্জে তত বর্ষে না। মানুষকে সম্মান করতে শিখুন। যাকে যতটুকু মর্যাদা দেয়া দরকার, সেটা দিন। এটাতে কোনো পরাজয় বা গ্লানি নেই বরং আনন্দ আছে।

    ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেদকরকে চিনেন? তিনি ভারতের সংবিধানপ্রণেতা ছিলেন। আরও অনেক কিছু ছিলেন তিনি। যেমন- রাজনৈতিক নেতা, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত ও সম্পাদক। এ মানুষটাকে একদিন অভিজাত বংশের মানুষরা অবজ্ঞা করেছিল। মানুষটা যে খুব নিচু বংশের ছিল এ জন্য! কিন্তু লেখাপড়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে একটা স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেন। কিন্তু বড় বংশের মানুষ এ নিচু বংশের মানুষটার সঙ্গে বসবে না। ফলে স্কুলের দরজার বাইরে মাটিতে বসে তাকে ক্লাস করতে হতো।

    পানির পিপাসা যখন লাগত, কে দেবে তাকে পানি? তাকে পানি দিতে গিয়ে গায়ে যদি ছোঁয়া লাগে, তাহলে তো জাত চলে যাবে। দেখুন, এর সঙ্গে ভাবুনও- যে মানুষটাকে সবাই অবহেলা করেছে, সেই মানুষটাই আসল মানুষে পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টিভি-১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা এ লোকটাই শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নির্বাচিত হন। আর যারা অবহেলা করেছিল মানুষটাকে, তাদের কিন্তু পৃথিবী মনে রাখেনি।

    এটাই হয়তো প্রকৃতির বিচার। তাহলে অহংকার ধরে রাখার জন্য মানুষকে কখনও অবহেলা করবেন না; বরং বিনীত হন। মানুষ হিসেবে মানুষকে স্বীকৃতি আর মর্যাদা দিন। কারণ বড় যদি হতে চান, ছোট হন তবে। এতেই মঙ্গল। এটাই ইতিবাচক মানসিকতা। এ জন্য আমি সবসময় বলি, আমাদের নিজেদের পাল্টানো দরকার। যদি নিজেরা না পাল্টাই, তবে সমাজ পাল্টাবে না। আর আমরা নিজেদের মানুষ বলার দাবিটুকুও হারাব।

    ৩ .

    গতানুগতিকভাবে আমরা জেনে এসেছি যে, একসময় ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন থাকায় মানুষের কাছে মানুষ বিক্রি হতো। সেই পেছনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমরা কখনও চাই না।

    তবে সম্প্রতি আধুনিক দাসপ্রথার গবেষণার বিষয় ও ফলাফল আমাদের হাতে এসেছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংস্থা ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স-২০১৮-তে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪ কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে আধুনিক দাসত্বের শিকারে পরিণত হচ্ছে।

    আধুনিক দাস প্রথায় কৌশলগতভাবে মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কোনো না কোনোভাবে দাসত্বের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমাদের আধুনিক ও সভ্য সমাজে এখনও নারীদের কেনাবেচা হয়। তবে এ ধরনের দাসত্ব থেকে ভিন্ন এক ধরনের দাসত্ব সমাজে সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো আমরা বুঝতে পারছি না কীভাবে আমরা নিজেদের অগোচরে অন্যের দাসে পরিণত হচ্ছি। জীব ও জড়- দুই ধরনের দাসত্বের শিকারে নিজেদের পরিণত করছে মানুষ। যেমন মাদক জড় পর্দাথ। কিন্তু এ জড় পদার্থও মানুষের মতো প্রাণীদের তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।

    মানুষ মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও অন্যের দাসত্ব গ্রহণ করছে। ১৯৯৭ সালে ‘মাদকের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা মডেল’ এর একটি ব্যাখ্যা দেন গুডি, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- মাদকাসক্তরা মাদক সেবনের ফলে মাদকের দাস হয়ে যান এবং তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তারা মাদকের পেছনে এত বেশি পরিমাণ অর্থ খরচ করেন যে, সাধারণ বৈধ পেশা দ্বারা তাদের মাদক সেবনের অভ্যাস বজায় রাখতে অর্থায়ন সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ফলস্বরূপ তাদের অবশ্যই অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে হবে। আমেরিকান ঔপন্যাসিক ফিলিপ কে ডিকের বর্ণনায়, ‘মাদকের অপব্যবহার কোনো রোগ নয়, এটা একটা সিদ্ধান্ত। এটা একটা চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো। এটাকে আপনি রোগ বলতে পারেন না, বলতে পারেন চরম একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের দাসত্বের ঘটনাগুলো ঘটছে।

    প্রযুক্তির দাসত্ব নিজের অগোচরে করে যাচ্ছে অনেক মানুষ। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকটি মানুষকে প্রভাবিত না করে এর আসক্তির দিকটি প্রভাবিত করছে। বর্তমানে ইন্টারনেট দুনিয়ার এক ভয়ংকর নাম ‘ব্লু-হোয়েল’। এ সুইসাইড গেম বা মরণ নেশার ফাঁদে পড়ে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না। কী আছে এই গেমের মধ্যে? ফিলিপ বুদেকিন কেনই বা তৈরি করলেন এ গেম, তাই এখন আলোচনার অন্যতম ইস্যু। কে এ ফিলিপ বুদেকিন? ফিলিপ বুদেকিন রাশিয়ার নাগরিক। তার ডাকনাম ফিলিপ ফক্স। তার পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে দেখা যায়নি। ফিলিপ ১৮ বছর বয়সে ২০১৩ সালে প্রথমে ব্লু-হোয়েল নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি সামাজিক মাধ্যমে ‘এফ-৫৭’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর ৫ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা করেন। ৫ বছরের মধ্যে যেসব মানুষ সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় (তার মতে) তাদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। ফিলিপ যখন এ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন তিনি রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়াশোনার পর ব্লু-হোয়েলের বিষয়টি প্রকাশ হলে ২০১৬ সালে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ওই সময়ে তাকে গ্রেফতার করে রাশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফিলিপ কিশোর বয়সে তার মা ও বড় ভাইয়ের হাতে প্রচুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন। তবে সে নিজেও মানসিকভাবে অসুস্থ বলে তদন্তকারীরা সংবাদমাধ্যমকে জানান। ফিলিপ ও তার সঙ্গীরা প্রথমে রাশিয়ার সামাজিক মাধ্যম ‘ভিকে’ ব্যবহার করেন। সেখানে তারা একটি গ্রুপ করেন। ভয়ের ভিডিও গ্রুপে ছড়ানোর মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। ভয়ের ভিডিও ছড়ানোর ফলে ওই গ্রুপে প্রচুর তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়। সেখান থেকে বুদেকিনের সঙ্গীরা মিলে এমন সব তরুণ-তরুণীকে বাছাই করতে থাকেন, যাদের সহজে ঘায়েল করা সম্ভব হবে। সেন্ট পিটার্সবার্গ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপ বলেন, ‘যেখানে মানুষ আছে সেখানে কিছু জীবন্ত বর্জ্যও (মানুষ) আছে। সমাজে ওইসব মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা হয় নিজেরা সমাজের জন্য ক্ষতিকর, না হয় তারা সমাজের ক্ষতির কারণ। আমি সমাজের ওইসব বর্জ্য পরিষ্কার করতে চাই।’

    তবে তিনি সরাসরি আত্মহত্যার নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি আত্মহত্যার জন্য অনুপ্রাণিত করিনি। কিন্তু গেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা নিজেরাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত মে মাসে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফিলিপকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। এখানে দুটো বিষয় বিশ্লেষণ করা যায় । একটি হল- তার ওপর পরিবারের নিপীড়ন। যেটি তার মানসিকতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। সে পরিবারের অশুভ চিন্তার দাসে পরিণত হয়েছে। আরেকটি বিষয় হল, একটা নেতিবাচক সৃষ্টির মাধ্যমে বুদেকিন অসংখ্য মানুষকে তার সৃষ্টির দাসে পরিণত করেছে। এর মাধ্যমে অশুভ চিন্তার মাধ্যমে মানুষ মানুষের কাছে ও তার সৃষ্টির কাছে বিক্রি হয়েছে। মানুষ অনেক সময় দুর্নীতির দাসে পরিণত হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যের দাসে পরিণত হচ্ছে। যেমন- কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করে, তবে নৈতিকভাবে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার অবস্থান অনুযায়ী যে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। প্রথমত, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় পরিবারের সদস্যদের কাছে তার দুর্নীতির বিষয়টি পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায়। ফলে পারিবারিকভাবে তার যে মর্যাদা ও সম্মান পাওয়ার কথা সেটি পাওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া সমাজের মানুষের মধ্যেও তার সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা গড়ে ওঠে। যে অফিসের প্রধানের দায়িত্ব সে পালন করছে, সে অফিসের অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর তার কর্তৃত্ব থাকে না। আবার তার দুর্নীতির দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত হওয়ায় তাদের মধ্যেও দুর্নীতি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানে যে তাদের অফিসপ্রধান ঘুষ খায়, বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সঙ্গে যুক্ত আছে, তখন আইন অনুযায়ী অফিসপ্রধানের যে শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার কথা, সেটি আর পায় না। এখানে উল্লেখ্য, মানুষ শুধু আইনের দ্বারাই মর্যাদাবান হয় না, বরং মানুষের স্বচ্ছ ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়ে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ, সততা, মহত্ব ও কাজের ক্ষেত্রে অবদানের মাধ্যমেও সম্মানিত হন। এর আরেকটি নেতিবাচক দিক আছে সেটি হল যখন অফিসের সবাই জানতে পারে যে, তার অফিসপ্রধান বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তখন তারা বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক দাবি নিয়ে অফিস প্রধানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। যেমন- কোনো একজন নিুপদের কর্মচারী তার অফিসপ্রধানকে চাপ দিয়ে বলতে পারে আমার আত্মীয়কে আপনার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে। যদি অফিসপ্রধান নিয়োগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তবে সে নিম্ন পদধারী কর্মচারী তার দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রকাশ করবে বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করার সাহস অর্জন করে। অফিসপ্রধান যেহেতু নিজেই নৈতিকভাবে দুর্বল সে কারণে তার আইনগতভাবে কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগ করতে পারে না; বরং নিু পদধারী কর্মচারীর অনৈতিক দাবি মেনে নিতে হয়। এভাবে অফিসপ্রধান তার অধস্তনের দাসে পরিণত হয়, প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা হাতের পুতুল বলি। এ কারণে অফিসপ্রধানের মাধ্যমে একটি অফিসের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি বাড়তে থাকে। যার প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে মানুষ তার বিশুদ্ধ বিবেক হারিয়ে অন্য মানুষের কাছে বিক্রি হয়ে যায়।

    ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এ অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা, সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ এই আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে দুর্নীতি দমন করতে হলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডের দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টি আমাদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের ইনক্লুসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে অগ্রসরমান কয়েকটি অর্থনীতির কথা বলেছে, যারা দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এ দেশগুলো হচ্ছে : নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। কিন্তু ফিনল্যান্ডের আজকের যে দুর্নীতিমুক্ত অবস্থান, তা কিন্তু ৫০ বছর আগেও ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার নিজেকে বিক্রি করার তথা পরিণত হওয়ার মানসিকতা পরিহার করে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করা।

    লেখকঃ শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।

    অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close