• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

সম্পর্কের অদৃশ্য শক্তিগুলো খুঁজতে হবে

প্রকাশ:  ২৫ অক্টোবর ২০১৮, ০১:১৩ | আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০১৮, ০১:২২
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

সম্পর্ক হচ্ছে এমন একটি বিষয় যার গভীরে অনেক অদৃশ্য শক্তি কাজ করে । যে শক্তি মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে | সম্পর্ক হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সম্পর্কের এ বন্ধন দেশের সঙ্গে হতে পারে, প্রকৃতির সঙ্গে হতে পারে, মানুষের সঙ্গে হতে পারে। প্রকৃত অর্থে সম্পর্কের কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই। ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি- এ তিনটি সবার জন্য পরম শ্রদ্ধার বস্তু। পাকিস্তানিরা যখন উর্দুকে মাতৃভাষা করার ষড়যন্ত্র করছিল তখন বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা অনেকে। এটা সম্ভব হয়েছিল মাতৃভাষার সঙ্গে বাঙালিদের নিবিড় সম্পর্কের কারণে। ভাষার জন্য যে প্রাণ দিতে হয় এটি দেখিয়েছিল মুক্তিপাগল বাঙালিরা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাঙালি হয়ে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলেন; তবে ইংরেজি সাহিত্য তাকে মর্যাদা দেয়নি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে আছেন। মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যতটা নিবিড় হতে পারে তা অন্য ভাষায় সম্ভব নয়। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্কটা যদি নৈতিক ভিত্তির ওপর না হয়ে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের ওপর হয়, তখন শিক্ষক আর শিক্ষক থাকেন না। তাকে ব্যবসায়ীও বলা যায় না, মানুষও বলা যায় না। তখন তিনি হয়ে যান দুর্বৃত্ত অথবা দুর্নীতিবাজ। আবার যে ছাত্রের সঙ্গে তার আর্থিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে সে তাকে মন থেকে কখনও শ্রদ্ধা করে না, বরং তাকে খারাপ মানুষ হিসেবেই গণ্য করে। আর নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে শিক্ষক ছাত্রদের ব্যবহার করেন, একদিন ছাত্রদের দ্বারা তিনি লাঞ্ছিত হন। এটাই বিধির বিধান।

সম্পর্কিত খবর

    কবির সঙ্গে কবির সম্পর্ক। রফিকুল ইসলাম তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল’ প্রবন্ধে এ সম্পর্কের সমীকরণের কথা বলেছেন। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নজরুলকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেবার নজরুল অবলীলায় গেয়েছিলেন একের পর এক রবীন্দ্রসংগীত, সবক’টিই তার কণ্ঠস্থ। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, তার নিজেরই এখন আর গানের কথা মনে থাকে না। নজরুল তখন জেলে। রবীন্দ্রনাথ বসন্ত নাটকটি উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। যারা উপস্থিত ছিলেন সেখানে তাদের মধ্যে অনেকেই এটি পছন্দ করলেন না। রবীন্দ্রনাথকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন তারা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বললেন, জাতির জীবনে বসন্ত এনেছেন নজরুল, তাই এ নাটকটি তাকেই উৎসর্গ করা হবে। জেলে যখন নজরুল রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে নাটকটি হাতে হাতে পেয়েছিলেন, তার জেলজীবনের যন্ত্রণা কমে ছিল। পরে নজরুল সে কথা লিখেছিলেনও। দু’জন বিখ্যাত মানুষের এ ধরনের সম্পর্ক আমাদের অনুপ্রাণিত করে। কেউ যদি ভালো কিছু করে থাকে তবে তাকে অনুপ্রাণিত করা উচিত, আঘাত দেয়া নয়।

    একজন কবি হতে পারেন জাতির বিবেকের দর্পণ। এ সংস্কৃতির দর্পণ মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে। উদারভাবে দেশ, মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। তবে আজকের দিনে বড় নেতারা কবিদের উপলব্ধি ও দর্শন মেনে নিতে চান না। কবিদের প্রতি বড় বড় মানুষের অবজ্ঞা ও অবহেলা আজকের জীবনের চালচিত্র। সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী থেকে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি যেন আজ বিসর্জিত। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে জীবনে ধারণ করেন। কবির কবিতা যে জাতির পরিবর্তনের দর্শন হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু, নেহরু, গান্ধীজিসহ বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতারা কবির প্রতি তাদের ভালোবাসার যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা, সম্মান ও আন্তরিকতায়। সব কালের ছবিগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল একটি মিল, একটি অর্জন, একটি গৌরব ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। এ সব্যসাচী লেখক নাগরিক সংবর্ধনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশরত্ন ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ছিল একজন কবির প্রধানমন্ত্রীর প্র্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের সর্বজনীন প্রকাশ। এখানে কবি আসলে ছিলেন দেশের সব মানুষের প্রতীক। আর তার ভরসাস্থল ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। না ফেরার দেশে চলে গেছেন কবি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করেন। এটি ছিল একজন কবির মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে মর্যাদা দেয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত। আর মানবিক ও শৈল্পিক মূল্যবোধের সম্পর্কের কারণে যে এমনটি ঘটেছে তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

    এবার একটি অন্য ধরনের সম্পর্কের কথা বলি। জীবের সঙ্গে জড়ের সম্পর্ক। বংশপরম্পরায় রথীন্দ্র একটা কারখানায় চাকরি পেয়েছিল। একটা লেদ মেশিনে সে কাজ করত। প্র্রতিদিন কারখানায় আসার পর সে লেদ মেশিনটার জন্য পূজা-অর্চনা করে কাজ শুরু করত। এখানে প্র্রশ্ন হতে পারে, একটা জড় পদার্থের জন্য কেন সে পূজা করত। তবে রথীন্দ্র এখানে লেদ মেশিনটাকে দেবতার প্র্রতীক বলে ধরে নিয়েছিল। তার রুজি-রোজগার ও সংসার চলত এ মেশিনটার ওপর ভর করে। ফলে সে মেশিনের মধ্যে তার দেবতার অসীম দয়াকে দেখতে পেত। কেননা এ মেশিনটা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে তার জীবন অন্ধকার হয়ে যেত। সত্যি এ সম্পর্কের বিষয়টা আমাদের আলোড়িত করে। ভাবনার জগৎকে প্র্রসারিত করে। কাজের প্র্রতি আমার শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও ভালোবাসা যদি না থাকে, তবে আমি অস্তিত্বের সংকটে পড়ব, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

    মানুষ ও পশুর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক ধনী লোকের বাসায় পাঁচজন ভৃত্য ও একটি কুকুর ছিল। একদিন সন্ত্রাসীরা ধনী লোকটির বাড়িতে হামলা করল। বন্দুকের নলটা সন্ত্রাসীরা হাতে নিলে পাঁচজন ভৃত্য মনিবকে ছেড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে ভয়ে পালিয়ে গেল; কিন্তু সন্ত্রাসীদের গুলি যখন মনিবের বুককে বিদ্ধ করবে তখন কুকুরটি লাফিয়ে উঠে তার বুকে সেই বুলেটকে বরণ করে নিয়ে মনিবের জীবন বাঁচাল। বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় কুকুরটি সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে মনিবের বাড়িছাড়া করল। তারপর একসময় মনিবের পায়ের কাছে এসে তার কৃতজ্ঞ মৃতদেহটা আছড়ে পড়ল। মনিবের চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতার জল পড়তে লাগল। এখানে পশুটা প্রভুভক্ত হলেও মানুষগুলো ছিল অকৃতজ্ঞ। মনিব মনে মনে ভাবলেন- ওরা থাকার চেয়ে একটা কুকুর থাকাও ভালো। কুকুরের প্র্রভুভক্তি আছে আর মানুষের সেটাও নেই। আসলে সবাই সুযোগের জন্য স্বার্থপর হয়ে যায়; কিন্তু ওরা জানে না ওরা ওদের সীমা লংঘন করছে। একমাত্র প্র্রভুই তাদের ক্ষমা করতে পারে, আর কেউ নয়।

    কারও কারও দেশবিরোধী সম্পর্কের কারণে দেশের স্বার্থ বিপন্ন হয়। যেমন, উদাহরণ হিসেবে পদ্মা সেতুর কথা বলা যায়। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যে নাটক সাজিয়ে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ দুর্নীতির অভিযোগ আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নিজের পায়ে যে দাঁড়ানো যায় তা আজ মানুষ শিখেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

    শহীদ দিবস আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা ভাষা আমাদের গৌরব, আমাদের অধিকার। স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে অনেকে নিজেদের সম্পর্কের কথা বলেন; কিন্তু বুকের ভেতরে তা কি লালন করেন? নাকি সবকিছুই লোক দেখানো? এ ধরণের একজনকে এক টিভি সাংবাদিক যখন জিজ্ঞাসা করলেন, শহীদ বেদিতে অনেকে জুতা পায়ে উঠছে এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী? তিনি বললেন, এটা ঠিক হয়নি, তারা পরিবারে বাবা-মায়ের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা পায়নি। কিন্তু ফুটেজে যখন ওই মানুষটিকে জুতা পায়ে শহীদ বেদিতে উঠতে দেখা গেল, তখন তার আগের কথার সঙ্গে পরের কথার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেল না। পরের কথাগুলো আগের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি কথা ঘুরিয়ে বললেন, না, জুতার সঙ্গে শ্রদ্ধার বিষয়টি সম্পর্কিত নয়। শ্রদ্ধার বিষয়টি মানুষের মন থেকে আসে। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো, তবে বিচিত্র কিছু নয়। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! কাজী মোতাহার হোসেন বলেছেন, 'মানুষে মানুষে মিলনই আনন্দের জন্ম দেয়; বিরোধে নয়।' বাস্তব ক্ষেত্রে সম্পর্কের বিষয়গুলো এমনই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সম্পর্কের জটিল সমীকরণ এ ক্ষেত্রে পুরাতন ধ্যান-ধারণার জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ফলে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। যদি দর্শনভিত্তিক সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়, তবে দেখা যায়, বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য ছিলেন অ্যারিস্টোটল এবং অ্যারিস্টোটলের শিষ্য ছিলেন আলেকজান্ডার। দর্শনভিত্তিক এই সম্পর্ক ছিল নৈতিক সম্পর্কেরই প্রতিফলন। আবার গবেষণার ক্ষেত্রে একজন গবেষকের গবেষণাপত্র আরেকজন গবেষককে নতুনভাবে চিন্তা করার খোরাক জোগায়। এভাবে গবেষণাকেন্দ্রিক সম্পর্কের বিষয়টি গড়ে ওঠে। তবে তেমনটি আর আজকাল দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে।

    বাবার দায়িত্বপূর্ণ হাত ধরেই বড় হয়ে উঠছিল তার আদরের সন্তান। মায়ের চোখের মণি ছিল সে। নামকরা স্কুলে তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল। বাবা তার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আর মায়ের সাংসারিক জটিলতার আবর্তে পড়ে তার সন্তানের কাছাকাছি থেকে যে চিরন্তন সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা ছিল, তা হয়ে উঠল না। ফলে বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে ছেলেটি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলল। এক সময় বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ল। বিষয়টি বাবা-মায়ের দৃষ্টিগোচর হলো। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাদকের টাকা না পেলে বাবা-মা, ভাই-বোনদের খুন করে ফেলবে বলে সে হুমকি দেখাল। আরও অনেক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ল সে। বাবা-মা তার অন্য সন্তানদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ছেলেকে তুলে দিলেন। তবে মায়ের মন মানে না। ছেলেকে আবার বাড়িতে আনা হলো। কিন্তু ছেলের কোনো পরিবর্তন হলো না। বাবা-মা এখন তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আবেদন করেছে। এক সময় বলা হতো, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা। কিন্তু আজ বাবা তার সন্তানের মৃত্যু কামনা করছে। মমতাময়ী মা তার সন্তানের মৃত্যু কামনা করছে। সত্যিই, বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো। তবে অবাস্তব নয়। এ জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? মা-বাবা, নাকি বখে যাওয়া সন্তানকে? নাকি আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে? কোনো এক অভিজাত পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিয়েছিল জিসান। বাবা-মার অতি আদরে বড় হয়ে উঠছিল সে। তার যখন ৭ বছর বয়স, তখন তাকে প্রতিদিন টিফিন বাবদ তিন হাজার টাকা দেওয়া হতো। তার কোনো হিসাব বাবা-মা নিতেন না। এর পর তার যখন ১২ বছর বয়স তখন তাকে একটি গাড়ি কিনে দেওয়া হলো। তাকে টাকা দেওয়ার পরিমাণও বাড়তে থাকল। একদিন সে তার এক বন্ধুকে জখম করে হাসপাতালে পাঠাল। বাবা-মা টাকা দিয়ে বিষয়টা দফারফা করলেন। সন্তানকে এ জন্য কোনো শাসন তারা করলেন না। এর পর ছেলের বয়স যখন ১৭, তখন সে বাবা-মার অতি আদরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। এক সময় নাইটক্লাবে ডিজে পার্টিতে গিয়ে তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলো। তার আঘাতে একজন বন্ধু মারা গেল। বাবা-মা ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে তাকে আরও বাহবা দিলেন ও বিষয়টি তার বন্ধুর পরিবারকে ভয় ও অর্থের লোভ দেখিয়ে দফারফা করলেন। ছেলেটির অঢেল টাকার লোভে অনেক মেয়ে বন্ধু তার জুটল। এক সময় ছেলেটি তার চরিত্র হারাল। অবৈধ সম্পর্কের কারণে এক মেয়ে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তাকে খুন করল। এটাও বাবা-মা দফারফা করলেন। কিন্তু আইনের হাত ছিল অনেক লম্বা। অবশেষে ছেলেটিকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। মহামান্য বিচারক ছেলেটির ফাঁসির রায় পড়ে শোনালেন। ছেলেটি আদালতকে কিছু বলতে চাইলে বিচারক তাকে অনুমতি দিলেন। ছেলেটি তখন বলল, নিষ্পাপ হয়ে বিধাতার এ পৃথিবীতে আমি জন্ম নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মা-বাবা আমাকে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লোভী করে তুললেন। ফলে আমার দ্বারা অনেক অপকর্মও ঘটে গেল। কিন্তু তারা কখনও আমাকে আমার খারাপ কাজের জন্য শাসন করেননি। তাহলে আমিই কি প্রকৃত দোষী, নাকি আমার বাবা-মা? আমি মনে করি, আমার ফাঁসি হওয়া উচিত নয়। যে বাবা-মা আমাকে শাসন না করে আমার অন্যায়গুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদেরই ফাঁসি হওয়া উচিত। মহামান্য বিচারক, আপনার কাছে এ ব্যাপারে সুবিচার চাই।

    এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার। তা হলো অতি আদুরে সন্তান কখনও ভালো হয় না। মা-বাবার প্রশ্রয় পেয়ে অনেক সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। যেমন ঐশীর ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলাম। এখানেও সম্পর্কের টানাপড়েন। কে দায়ী ছিল? মা-বাবা, না তার সন্তান?

    যতই দিন যাচ্ছে মানবিক সম্পর্কগুলো কৃত্রিম হয়ে উঠছে। মেকি কান্না দেখিয়ে ফায়দা লুটছে সবাই। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আজ সময় এসেছে সম্পর্কের জটিল সমীকরণগুলো সরল করার। মানবিক আর উদার সম্পর্কগুলো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ও বিশ্বাস তৈরি করে। যা গড়তে অনেক সময় লাগে; কিন্তু ভাঙতে সময় লাগে না। তাই সম্পর্কের ভিত্তিটা শেকড়ের মতো শক্ত হওয়া দরকার। আর আমাদের প্রত্যাশা, একদিন বর্ণবাদের কারণে যে মানুষে মানুষে বিভেদ ছিল; জাত, কুল, মান নিয়ে যে ভেদাভেদ ছিল তা যেমন আজ দূর হয়েছে, তেমনি ধর্ম নিয়ে আর কোনো ভেদাভেদ নয়, বরং দরকার একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আর তা যদি না হয় তবে তথাকথিত ধর্মান্ধদের কারণে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যা কখনোই একজন মানুষ, একটি দেশ আর বিশ্ববাসীর কাঙ্খিত লক্ষ্য হতে পারে না।

    লেখকঃ শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।

    অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close