• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

যে শিল্পায়ন আমাদের বদলে দিতে পারে

প্রকাশ:  ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:০৩
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আমরা নতুন পণ্য উৎপাদনের কথা কি ভাবছি | হয়তো ভাবছি | কিন্তু সেটাকে এগিয়ে নেবার জন্য যে উদ্যোগ আর আত্মবিশ্বাস দরকার সেখানটাতে কাজ করার অনেকগুলো বিষয় রয়েছে | নতুন শিল্পভাবনা থেকেই শিল্পায়নের যাত্রা | প্রকৃত অর্থে একটি রাষ্ট্রের শিল্পায়নের অগ্রগতির ওপর সে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে। আর শিল্পায়ন একটি সম্প্রসারণশীল প্রক্রিয়া। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানে যে প্রকৃতির শিল্প-কারখানা রয়েছে, সেগুলোর যেমন উত্কর্ষের প্রয়োজন আছে, তেমনি উন্নত রাষ্ট্রের ধারণা এগিয়ে নেয়ার জন্য নতুন শিল্পপণ্য খুঁজে বের করে তাতে বিনিয়োগ করা দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, এ নতুন শিল্পপণ্যের ধারণা সৃষ্টি করবে কারা? আবার কীভাবে এ ধারণা সৃষ্টি করতে হবে, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। কারণ গতানুগতিক কাজের বাইরে যে চিন্তার একটি ক্ষেত্র রয়েছে, সে ধরনের মানসিকতা অনেকের মধ্যে নেই। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এটাকে স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোভাবের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেখানে দেশপ্রেম গৌণ আর ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। তার পরও ভাবনার বিষয়টি থেকে যাচ্ছে। কারণ দেশ উন্নত হলে তার সুফল ভোগ করবে সবাই। আর শিল্পায়নের নতুন ধারণা তারই একটি প্রতিফলন হতে পারে। কারণ সময় বদলাচ্ছে, প্রযুক্তি বদলাচ্ছে। কাজেই সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তিকে নিয়ে চলতে হলে সৃষ্টির ভাবনা, পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দরকার। এক্ষেত্রে উদ্যোগটা নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিল্পপণ্যের নতুন ধারণা প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করা স্বাভাবিক। কারণ উৎপাদনমুখী প্রতিটি শিল্প-কারখানার প্রধান লক্ষ্য হলো ব্যবসাকে লাভজনক পর্যায়ে উপনীত করা। সেক্ষেত্রে নতুন পণ্যের দেশী ও বিদেশী বাজারের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে মার্কেট সার্ভে ও মার্কেট রিসার্চের আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে পণ্যের চাহিদা বের করা সম্ভব।

সম্পর্কিত খবর

    নতুন শিল্প হিসেবে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানার কথা ভাবা যেতে পারে। কেননা উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে জানা দরকার এর নাম কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল হলো কেন? এর কারণ হলো এখানে কতগুলো লেয়ার থাকে। আর এ লেয়ারগুলো শক্তভাবে একে অন্যকে ধরে রাখে। সাধারণভাবে এখানে ম্যাট্রিক্স ম্যাটেরিয়াল ও রেইনফোর্সিং ফাইবার থাকে। এ ফাইবারগুলো রেইনফোর্সিং উপাদান হিসেবে ম্যাট্রিক্স ম্যাটেরিয়ালের ওপর রেসিনের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে সাজিয়ে এ ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা হয়। তবে প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ ও মানুষের সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তৈরি করা হচ্ছে। মূলত তিন ধরনের কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল শিল্প-কারখানাগুলোয় উৎপাদন হচ্ছে। এগুলো হলো— মেটাল ম্যাট্রিক্স কম্পোজিট, সিরামিক কম্পোজিট, পলিমার কম্পোজিট। এছাড়া পরিবেশবান্ধব অনেক ধরনের কম্পোজিট বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। আর গবেষণাও চলছে প্রচুর। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, রিসার্চ সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণাকর্ম কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা সৃষ্টি এবং তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে সমর্থ হচ্ছে। যেসব জায়গায় প্রচলিত ম্যাটেরিয়ালগুলো ব্যবহার করা সম্ভব নয়, সেখানে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে এর ব্যবহার বেড়েছে। এমনকি আমাদের দেশেও বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ ধরনের ম্যাটেরিয়াল সম্পর্কে শিল্পোদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষের ধারণা না থাকায় একে শিল্পে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। এর চাহিদা যে শুধু দেশে তা-ই নয়, উন্নত রাষ্ট্রেও রয়েছে। ফলে এটি টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিয়ালের মতো রফতানিযোগ্য একটি শিল্প হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাধ্যমে যেমন দেশের অর্থনীতি গতি পাবে, তেমনি অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে।

    যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বিবেচনায় আনা হয়, তবে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। ১৯৬০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে কম্পোজিট শিল্পটি ২৫ গুণ বেড়েছে। সেক্ষেত্রে ইস্পাত শিল্প ১ দশমিক ৫ গুণ ও অ্যালুমিনিয়াম শিল্প তিন গুণ বেড়েছে। কিন্তু সে দেশের গবেষকরা বলছেন, এটা কম্পোজিট শিল্পের জন্য একটি ভালো খবর, কিন্তু এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রবণতা ও ভবিষ্যতে তা যেন ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ২০১৬ সালে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ৭ গুণ বেড়ে যায়, যা অর্থের হিসাবে ৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এ ধরনের প্রবণতা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালে অর্থের হিসাবে এর চাহিদা ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে, যাতে সমষ্টিগত বার্ষিক বৃদ্ধির হার (সিএজিআর) ৪ দশমিক ৯ শতাংশের অংকে পৌঁছবে। গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল পূর্বাভাসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের বাজার ২০১৬-এর ২৭ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে, যা ২০১৭ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে সমষ্টিগত বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৩-তে উন্নীত করবে। বিশ্বায়নের ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য কম্পোজিট শিল্পের ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছে ইউকে কম্পোজিট লিডারশিপ ফোরাম। এগুলোর মধ্যে মহাকাশ, অটোমোটিভ (স্বয়ংক্রিয়তা), সামুদ্রিক, তেল ও গ্যাস, রেল, নবায়নযোগ্য শিল্পক্ষেত্রে এর ব্যাপক ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এছাড়া যেকোনো ক্ষেত্রে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এ নিরিখে একটা বিষয় খুব জোরেশোরে বলা হচ্ছে, তা হলো— বর্তমান ও আগামী পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল। কারণ এর ওজন কম কিন্তু স্পেসিফিক ও ইমপ্যাক্ট স্ট্রেংথ বেশি হওয়ায় এটি আধুনিক উড়োজাহাজ, গাড়ি ও জলযান তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে এগুলোর ওজন কম হওয়ায় জ্বালানিমূল্য কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালে ইউকে কম্পোজিটস সাপ্লাই চেইন রিপোর্ট অনুসারে বলা হয়েছে, আনুমানিক দেড় হাজার ইউকে কম্পোজিট সেক্টর উৎপাদন কোম্পানি প্রায় ১ দশমিক ১ বিলিয়ন পাউন্ড অর্থ অর্থনীতিতে যোগ করেছে। বর্তমান ইউকে কম্পোজিট সেক্টরের অবদান ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালের মধ্যে তা ৪ বিলিয়ন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ থেকে ১২ বিলিয়নে উন্নীত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনে কার্বন বিবের কম্পোজিট বাজার অর্থনীতিতে ২০১৬ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে সমষ্টিগত বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১-এ উন্নীত করবে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। গোটা বিশ্ব যেখানে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে, সেখানে এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি নিয়ে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব! এর কারণ বিশ্লেষণ করা কঠিন। তবে উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির প্রয়োগ ও নতুন আইডিয়া তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের এক ধরনের অবহেলাকে এখানে দায়ী করা যায়। এজন্য নতুন শিল্পের ভাবনা নিয়ে মেলা আয়োজন করা যেতে পারে। বিদেশে এ ধরনের সংস্কৃতি প্রচলিত। জাতীয় ইনোভেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইডিয়া ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা যেতে পারে। যেখানে ইনোভেটিভ আইডিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প ধারণা তৈরি করে তা কীভাবে আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রয়োগ করা যায়, সেটি বিশ্লেষণ করতে হবে। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন শিল্পের ধারণা পাবেন। আর এ ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলবেন। এছাড়া জাতীয় কম্পোজিট রিসার্চ সেন্টার ও সোসাইটি গড়ে তোলা দরকার।

    অবশ্য আনন্দের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের গবেষকরা কীভাবে স্বল্পমূল্যে ও বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা যায় তা জানেন। সম্প্রতি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিসহ কয়েকজন গবেষক প্রায় ১০০ ধরনের নতুন ধারণা প্রয়োগ করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এখানে ড. ওয়াসিম দেওয়ান ও ড. শারমিনের নেতৃত্বে আরেকটি গবেষক দল কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের ওপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ দুই গবেষক দলের উদ্দেশ্য হলো, এ ধরনের কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করে আমাদের দেশে এ ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে এ ধরনের গবেষণা চলছে এবং তা সাফল্য লাভ করেছে। কারণ বাণিজ্যিক বিবেচনায় এটি একটি লাভজনক শিল্প। এটি যেমন দেশের চাহিদা মেটাবে, তেমনি বিদেশে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল রফতানি করে প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব। এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। বাংলাদেশে যে প্রকৃতির শিল্প-কারখানা রয়েছে, তাদের কেউ কেউ নিজ সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বঙ্গবন্ধু পাটকে সোনালি আঁশ বলেছিলেন, কথাটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। পাটের ফাইবার ব্যবহার করে বর্তমানে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি হয়েছে। এছাড়া দেশজ উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া কার্বন ফাইবার, গ্লাস ফাইবার, কেভলারসহ বিভিন্ন ফাইবার ব্যবহার করে এটি বানানো যায়। এছাড়া টাইটেনিয়াম অক্সাইড, সিলিকন কারবাইড, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড ন্যানো পার্টিক্যাল ও পাউডার বিভিন্ন পরিমাণে ব্যবহার করে হাইব্রিড কম্পোজিট তৈরি করে এর গুণগত মান বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরিজীবীদের শুধু রুটিনওয়ার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন না করে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শুধু রুটিন দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আরো কী কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয়, সেটা চিন্তা করে সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সে অঞ্চলগুলোয় একটি করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে।

    এক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমাদের দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে এ ধরনের লাভজনক শিল্পের আইডিয়া শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই অর্থনৈতিক ও শিল্পভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। উন্নত রাষ্ট্রে রোবোটিক্স শিল্প একটি ধারণায় পরিণত হলেও আমাদের দেশে একে এখন পর্যন্ত শিল্পে রূপান্তর করা যায়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জাতীয় রোবোটিক্স রিসার্চ সোসাইটির মতো এখনও কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রোবোটিক্সের ওপর তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই। এখন প্রশ্ন হতে পারে- তরুণরা যে রোবট বানাচ্ছে তার কি কোনো মূল্য নেই? একটা সাধারণ পরিসরের মধ্যে হয়তো এর মূল্য আছে, কিন্তু গবেষণালব্ধ ফলের মাধ্যমে রোবোটিক্সের যে প্রকৃত বিশ্বজনীন কাজ হওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে না। আমরা জানি, গবেষণা মূলত দুই ধরনের। এর মধ্যে একটি মৌলিক গবেষণা, অন্যটি ফলিত গবেষণা। মৌলিক গবেষণা হলো নতুন কোনো একটি বিষয় ও ধারণা গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরা, যা আগে ভাবা হয়নি বা করা হয়নি। আর ফলিত গবেষণা হলো অনেক আগে থেকেই কোনো একটি বিষয়ে গবেষণা চলছে কিন্তু এখনও এর ওপর গবেষণা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। রোবটের ওপর এখন যেসব গবেষণা হচ্ছে তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কার্যকারিতা, গতিশীলতা, সেন্সর শনাক্তকরণ বিশেষ করে রোবোটিক দৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি রোবটের ব্যবহার শিল্প-কারখানা, ওষুধ শিল্প, সামরিক, মহাকাশ অনুসন্ধান, সমুদ্রের নিচে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং ব্যক্তিগত কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। নিউরো সায়েন্স বিষয়েও রোবোটিক্স ধারণা প্রয়োগ করা হচ্ছে। ব্রেন মেশিন ইন্টারফেসের মাধ্যমে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির অচেতন অংশে উত্তেজনা সৃষ্টি করে তাকে কর্মক্ষম করা হচ্ছে। গবেষকরা একটি রোবট তৈরি করেছেন, যা এসফজাল অট্রেসিয়া চিকিৎসায় শরীরের মধ্যে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শিশুর জন্মগত ত্রুটি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। হামবুর্গের মার্টিনি ক্লিনিকে প্রফেসর আলেক্সান্ডার হ্যেজে প্রস্টেট অপারেশনের স্পেশালিস্ট হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রস্টেট অপারেশন করেছেন। তার সহকারী হলো একটি রোবট। এই রোবটই প্রফেসর হ্যেজেকে শরীরের ক্যান্সারগ্রস্ত অংশ কেটে বাদ দিতে সহায়তা করে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নয়তো আবার নতুন করে মেটাস্টাসেস তৈরি হতে পারে।

    আমাদের দেশে রোবটের ওপর গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর গবেষণাকেন্দ্রে বিভিন্ন বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে গ্রুপ তৈরি করে ফলিত ও মৌলিক গবেষণায় অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে। রোবোটিক্স-সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা নেচার ও সায়েন্সের মতো উঁচুমানের জার্নালে প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ফলিত ও মৌলিক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাগাজিন ও অন্যান্য জার্নালে প্রকাশ করে রোবোটিক্স গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া নতুন ধারণা পেটেন্ট করার মাধ্যমে মালিকানা স্বত্ব সংরক্ষণ করা যায়, যেটি প্রকৃত অর্থেই সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ।

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের বিক্রয় সংখ্যা এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ৩০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ৪ বছর আগের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশের বেশি রোবট বিক্রি হয়েছে বলে রোবোটিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন তাদের তথ্য-উপাত্ত থেকে বলেছে। এ ধরনের একটি আধুনিক, লাভজনক ও বর্ধনশীল শিল্প ধারণাকে শিল্প-কারখানায় রূপান্তরের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট ইন্ডাস্ট্রি নীতিমালা দ্রুত তৈরি করে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে নীতিমালার পরিকল্পনার মধ্যেই থাকলে চলবে না বরং এর বাস্তবায়ন ও ফিডব্যাক নিয়ে এ শিল্পকে অর্থনৈতিক গতিধারার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আজকাল যেসব রোবট আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে, তা নিছক ব্যক্তি আগ্রহ ও প্রচেষ্টার প্রতিফলন। কিন্তু এগুলোর বাণিজ্যিক উৎপাদনের তেমন কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। অনেকেই কৌতূহলবশত রোবটের প্রোটোটাইপ বা মডেল তৈরি করছেন। সেখানে সব ধরনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও তাতে নতুন কোনো গবেষণার উপাদান আছে কি-না, সে বিষয়টিও কেউ বিবেচনায় নিচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে ইউটিউবের ডাউনলোড করা টিউটোরিয়ালগুলো অনুসরণ করে রোবটের কপি করা হচ্ছে। তবে পার্থক্য শুধু এটুকুই; দেশের তৈরি রোবটগুলোতে দামি যন্ত্রাংশ ব্যবহার না করে স্বল্পমূল্যের দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা হচ্ছে।

    সম্প্র্রতি বাংলাদেশে 'রোবট রেস্টুরেন্ট' খোলা হয়েছে। এখানকার রোবটগুলো বিদেশ থেকে আনা। চীনে তৈরি এই রোবট দুটির একটি নারী, অন্যটি পুরুষের আদলে গড়া। প্রতিটি রোবট একনাগাড়ে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে সক্ষম। প্রতিটি রোবট বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় আট লাখ টাকা। দুই চীনা প্রকৌশলীর উপলব্ধি, বাংলাদেশ যে এখন তথ্যপ্রযুক্তিতেও উন্নতির পথে রয়েছে, খাবার পরিবেশনে রোবটের ব্যবহার এর একটি উদাহরণ। ধীরে ধীরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও রোবটের ব্যবহার বাড়বে বলে তাদের আশা। বাংলাদেশের তরুণরাই এ ধরনের রোবট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যারা রোবট আমদানি করে হোটেল বা শপিং মল চালানোর কথা ভাবছেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের এ দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এটি যদি তারা দিতে পারেন তবে বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে এর চেয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ ধরনের রোবট বানাতে সক্ষম। এতে যেমন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা হবে, তেমনি দেশের কল্যাণও সম্ভব হবে। কারণ অসম্ভবকে সম্ভব করার দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আর সেই সফল দিনের নতুন ধারার শিল্পায়নের পথে আমাদের দেশের যাত্রা শুরু হবে- এটিই প্রত্যাশিত।

    লেখকঃ শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।

    অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close