ফুল বাগানে সাপ
একটা আবেগময় বিস্ফোরণ। পুরো জাতীকে নাড়া দিয়ে যায়। অন্যায় আর নৈরাজ্যের পাহাড় হঠাৎ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো উর্ধ্বমূখী লাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল। ৪৭/৪৮ বছরের ময়লা আবর্জনায় কি এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে গেলো সমাজে রাষ্ট্রে। ট্রাফিক কন্সটেবল থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত কম্পিত হলো। সাধারন একটু সচেতনতা ইচ্ছে করলে সবাই করতে পারতাম। কিন্তু করা হয়নি। পুলিশ ভায়েরা নিজের লাইসেন্স বাসায় রেখে অপরের লাইসেন্স চেক করতাম। আমরা কোনদিন ঘুনাক্ষরেও ভাবি নাই এটা একদিন চ্যালেঞ্জ হতে পারে। ট্রেনিং স্কুলে আমার ছাত্রদের প্রায়ই আমি এই কথাটি বলতাম। একদিন এমন এক সময় আসবে পুলিশের প্রত্যেকটি স্টেপ জবাবদিহিতায় আসবে। আজকে শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক হচ্ছে। সেদিন দূরে নয় যেদিন আমাদের আইডি কার্ড চেক করবে মানুষ। জানতে চাইবে আমার কর্মস্থলের কমান্ড সার্টিফিকেট সাথে আছে কিনা। বিনা পরোয়ানায় যা ইচ্ছে তাই আমরা করতে পারবো না। সিভিল মাইক্রোতে যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে এনে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকিয়ে রেখে ক্ষমতার বাহাদুরি দেখাতে পারবো না। আইনি ক্ষমতার চেয়েও নেতাদের প্রিয়ভাজন হবার ক্ষমতা, এলাকার ক্ষমতা, কিংবা যেরকম ক্ষমতাই ভোগ করি না কেন? তারও একটা শেষ আছে। এই ছোট্ট কথাটা আমরা কেউ মানতে চাইতাম না।
আমাদের ভিআইপি থেকে শুরু করে সাধারন একজন সরকারি কর্মকর্তা পর্যন্ত সরকারী গাড়ীতে উঠার আগে একবারও জানতে চাই না ড্রাইভারের লাইসেন্স আছে কি না। এইদিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু ব্যতিক্রম।
সম্পর্কিত খবর
এই ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো আমাদের ভ্রম, আমাদের অন্যায়, আমাদের অপরাধ। কিভাবে সড়কে নৈরাজ্যের সিন্ডিকেট দানব হয়ে উঠেছে। পরিবহনের ফ্রাংকেনস্টাইনের কাছে কিভাবে অসহায় হয়ে পড়ে খোদ রাষ্ট্র। সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান তো প্রায়ই জিম্মি হয়ে পড়ে। পুলিশ হাতের পুতুল। অনেক কর্মকর্তা লোভে তাদের হাতের পুতুল হয়। অনেকে ইচ্ছা অনিচ্ছায় তাদের কাছে নির্লজ্জ সারেন্ডার করে। যে কারনে আজ পর্যন্ত বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের শাস্তি, কিংবা প্রমাণিত হলে নরহত্যার শাস্তির মেয়াদ পরিবর্তন করা যাচ্ছে।
তাই এই ফ্রাঙ্কেইন্সটাইনের হাত থেকে, নিজের জীবন, সন্তানের জীবন বাঁচাতে, অনাগত ভবিষ্যত বাঁচাতে দলমত নির্বিশেষে আজ বাচ্চাদের পাশে সবাই দাঁড়িয়েছেন। এই আন্দোলনের সাথে কারো কোন বিরোধ নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই ওই আন্দোলনে নৈতিক সনর্থন দিয়েছেন। এই আন্দোলনের সাথে বসন্তের সুভাষ পাওয়া যাচ্ছিল। ফাগুনের পরিবর্তিনের হাওয়া বইছিল। যেন আরেক ফেব্রুয়ারি। বাচ্চা বাচ্চা ফুলের মতো শিশুরা যখন আমদেরকে ট্রাফিকিং শিখাচ্ছিল তখন চারিদিকে একটা ফুলের সৌরত ছড়াচ্ছিল। আমরাও লজ্জিত হচ্ছি আমাদের সন্তানদের কাছে। ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েগুলিকে মনে হচ্ছিল স্বর্গীয়। দেবশিশু।
কিন্তু এই শিশুদেরকে কতোদিন দেবালয়ের দায়িত্ব দেয়া যায়? মাঝে মাঝে দেখি কিছু কিছু গার্ডিয়ান তাদের টিফিন তুলে দিচ্ছেন মূখে, পাশে দাঁড়িয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন মা-বাবা। তখন পর্যন্ত শংকার কিছু ছিল না। আবেগের আতিশয্যে আমরাও ছেলেমেয়েদেরকে দিয়েছি যাও, প্রতিবাদ করো।
কিন্তু কতো দিন। এই ছেলেমেয়েদের যদি এখন কেউ বলে যাও সচিবালয়ে, ফাইল চালাও, যাও হাসপাতালে অপারেশন করো, যাও বিমানবন্দরে সিস্টেমলস দূর করো, যাও নৌবন্দরে মাল খালাস করো, যাও বিদ্যুতে, বিদ্যুৎ দাও, ওয়াসায় পানি দাও, যাও প্রেসে দুর করো হলুদ সাংবাদিকতা, যাও আদালতে দূর করো বিচারিক জটিলতা দীর্ঘসূত্রীতা। রাস্ট্রের দায়িত্ব নাও। তাহলে কি হবে? আসলেই কি হবে? চিন্তা করার সময় নয় কি?
শুধু কি তাই? ব্যর্থতার গ্লানিতে যারা প্রতিনিয়ত দংশিত তারা কি বসে আছেন? যারা পরাজিত, ফাঁসির রশিতে দন্ডিত যারা, তাদের আত্বীয়স্বজন কি বসে আছেন? তারা কি সুযোগ নিতে চাইবেন না?
আজ যখন দেখি, স্কুলপোষাকের বিক্রি হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে, যখন দেখি বাঁশের কেল্লার মতো আইডি গুলু গুজব রটাতে সক্রিয় , গণজাগরণ বিরোধী মহল রাজপথের বাচ্চাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে, ধানমণ্ডির আওয়ামীলীগ অফিসে হামলা হচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নারী কর্মীরা ছেলেমেয়েদের পাশে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন তো ভয় হয়। তাদের অতৃপ্ত রাজনৈতিক খায়েস পূর্ন করতে ফুলের মতো বাচ্চাদের না ঘুঁটি বানায়। লাশের রাজনীতির অভিলাষে কার মায়ের না বুক খালি হয়।
কখন কোন অঘটন ঘটায় ওই বিষধর নাগিনীরা। বিষের ফনা নিয়ে ফুলের বাগানে ঘুরছে কালসাপের দল।
সাবধান হবার সময় নয় কি? বাচ্চাদের ঘরে নেবার সময় নয় কি?
লেখকঃ পুলিশ কর্মকর্তা, টিডিএস, ঢাকা।