অথচ গ্যালারিটা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে আমাদের জন্য!
ভাই, আপনি কোন দল? প্রশ্ন করতেই একটুও ভাবলেন না। বরং মনে হলো উত্তরটা কম্পিউটার যন্ত্রের মতো মুখে তাঁর ফিট করা ছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ব্রাজিল...কেন ব্রাজিলকে সাপোর্ট করেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে একটু যেন হোঁচট খেলেন। আমতা আমতা সুরে বললেন, না মানে ইয়ে... ব্রাজিল ভালো ফুটবল খেলে, ব্রাজিল ভালো দল... তাই ব্রাজিলকে সাপোর্ট করি। তা ছাড়া আমার এক বন্ধু ব্রাজিলের সাপোর্টার। তাই আমিও...। আচ্ছা, ব্রাজিল ফুটবল দলে আপনার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় কে? প্রশ্ন করতেই তাঁকে বেশ সপ্রতিভ দেখা গেল। অনেকটা গর্বের ভঙ্গিতে বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড়... ওয়ান অ্যান্ড অনলি মেসি...! অবাক হয়ে তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম—আপনি কি ঠিক বলছেন? আপনার প্রিয় খেলোয়াড়ের নাম মেসি? ভদ্রলোক এবার যেন একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে ভাই, ফুটবল দুনিয়ায় এই মুহূর্তে মেসি ছাড়া আর কোনো ফুটবলার আছে নাকি? ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট মেসি ইজ দ্য বেস্ট! ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন। তাঁকে ডাক দিলাম—ভাই, যাবেন না। আপনার সঙ্গে কথা শেষ হয় নাই। আপনি বললেন ব্রাজিল দলকে সাপোর্ট করেন। আবার বলছেন, মেসি আপনার প্রিয় খেলোয়াড়। কোথায় যেন একটা ঝামেলা মনে হচ্ছে... ভদ্রলোক আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘ভাই, এইখানে তো ঝামেলার কিছু নাই। ব্রাজিল দলের মেসিই হলো এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা ফুটবলার। মেসির কোনো বিকল্প নাই।’
ভদ্রলোকের কথা শুনে যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন। একবার ভাবলাম চলে যাচ্ছে যাক। পরক্ষণেই কেন যেন মনে হলো তাঁকে ডেকে নিয়ে ‘মেসি’বিষয়ক গরমিলটা দূর করা দরকার। ভদ্রলোককে ডাক দিলাম। তিনি আগের চেয়েও বিরক্ত সুরে বললেন—ভাই, কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন। আমার জরুরি কাজ আছে... ভদ্রলোক ‘যাই যাই’ ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। তিনি যতই তাড়া দেখাচ্ছেন আমি ততই নির্জীব। ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলাম—ভাই, আপনি কি সত্যি সত্যি ব্রাজিলের সাপোর্টার? ভদ্রলোক এবার রেগে উঠলেন। আপনি এইটা কী ধরনের প্রশ্ন করতেছেন? আমার মতো ব্রাজিলের সাপোর্টার আর কে আছে? আমার আস্তা একটা বাড়ি ব্রাজিলের পতাকার রঙে রং করাইছি। ২০ হাজার টাকা দিয়া ব্রাজিলের জার্সি কিনছি। ব্রাজিলের জন্য মিয়া জান দিয়া ফালাইলাম আর আপনি প্রশ্ন করতেছেন আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার কি না...। ভদ্রলোক এবার সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছিলেন। তাঁকে আবার থামালাম। এবার সরাসরি প্রশ্ন করলাম—আপনি ব্রাজিলের সাপোর্টার। অথচ আপনার প্রিয় খেলোয়াড় হলেন মেসি। ব্যাপারটা কেমন জানি হয়ে গেল না? আপনার কি ধারণা মেসি ব্রাজিলের খেলোয়াড়? প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক এবার জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, মেসি তো ব্রাজিলের প্লেয়ার। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি ভুল বললেন। মেসি ব্রাজিলের প্লেয়ার নন। মেসি হলেন আর্জেন্টিনার প্লেয়ার। যিনি এবার পেনাল্টি গোল মিস করেছেন। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক লজ্জা ঢাকার জন্য হৈচৈ করে উঠলেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি আসলে নেইমারের কথা বলতে চাইছিলাম। নেইমারের জায়গায় মেসির নাম বইল্যা ফালাইছি। মেসি একটা প্লেয়ার হইল নাকি? প্লেয়ার হইল ভাই আমাদের নেইমার। ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট নেইমার ইজ দ্য বেস্ট।
সম্পর্কিত খবর
ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করে এমনভাবে চলে গেলেন যে তাঁর নাম-ঠিকানা নেওয়া হলো না। অবশ্য নাম-ঠিকানার খুব যে দরকার পড়বে তাও মনে হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে না খেললেও বাংলাদেশের সর্বত্র বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়েই চলছে অসম্ভব মাতামাতি। দেশের রাজনীতির মতোই ফুটবল সমর্থকরাও মূলত দুই দলে বিভক্ত। এক দল আর্জেন্টিনা আরেক দল ব্রাজিল। সে কারণে একজন ফুটবলভক্তের নাম-ঠিকানা সংগ্রহে রাখার কোনো মানে হয় না। এই যে বাংলাদেশে ফুটবলের দুটি ভাগ এর কি কোনো কারণ আছে? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে না কোনো কারণ নাই। মূলত একজনের দেখাদেখি অন্যজন হয় ব্রাজিল, না হয় আর্জেন্টিনার ভক্ত হয়ে উঠছে। এটা একধরনের ঝোঁক বা ফ্যাশনও বলা যায়। গত কয়েক দিনে প্রায় ৫০ জন ফুটবল ভক্তের সঙ্গে কথা বলেছি। এর মধ্যে ছাত্র-ছাত্রী, রিকশাচালক, অটোরিকশাচালক, চায়ের দোকানদার, সবজি বিক্রেতার পাশাপাশি গৃহিণীও রয়েছেন। ৫০ জনের বেশির ভাগই ঝোঁকের বশে অথবা একজনের দেখাদেখি অন্যজন আর্জেন্টিনা অথবা ব্রাজিলের সাপোর্টার হয়েছেন। ৫০ জনের কেউই দেশ হিসেবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সম্পর্কে তেমন অবগত নন। দুটি দেশ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাও নেই তাঁদের। অথচ দুই দেশের ফুটবলের জন্য তাঁদের অপার আগ্রহ। পারলে জান দিয়ে দেন এমন অবস্থা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নিজ দেশের ফুটবল সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। ৫০ জনের মধ্যে ৪৩ জনই বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের কোনো ফুটবল তারকার নাম বলতে পারেননি। বাংলাদেশের পাঁচটি ফুটবল ক্লাবের নাম জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। অনেকেই আবাহনী আর মোহামেডান ছাড়া আর কোনো ফুটবল ক্লাবের নাম বলতে পারেননি। মাত্র তিনজন ব্রাদার্স ইউনিয়নের নাম বলেছেন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ফুটবল তারকার নাম উল্লেখ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সালাহউদ্দিন ও সালাম মুর্শেদির নাম বলেছেন। ৫০ জনের কারোরই দেশের মাটিতে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখার স্মৃতি নেই। কেন মাঠে খেলা দেখতে যাননি? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সবাই অভিন্ন সুরে বলেছেন, বাংলাদেশের ফুটবলে কোনো ‘গতি’ নাই। তাই তাঁদের বাংলাদেশের ফুটবল তেমন টানে না। এই ‘গতি’ শব্দটার মাধ্যমে তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবল দর্শকের মাঝে কোনো আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই দেশের ফুটবল নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই।
এ কথা সত্য, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ৫০ জন মানুষের মতামতের কোনো গুরুত্ব নাই। আসলে কি কোনোই গুরুত্ব নাই? যে দেশের মানুষ ফুটবলকে এত ভালোবাসে সেই দেশে ফুটবলের এত করুণ অবস্থা কেন? আমরা কি বছরের পর বছর ধরে বিশ্ব ফুটবল উৎসবের দর্শক হয়েই থাকব? অতি ক্ষুদ্র একটা দেশ পানামা বিশ্বকাপ ফুটবলে জায়গা করে নিয়েছে। যে দেশের জনসংখ্যা আমাদের ঢাকার মিরপুরের জনসংখ্যার চেয়েও কম। ওরা পারলে আমরা কেন পিছিয়ে আছি?
অতি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার শুরু হওয়া দেশের ফুটবল ঘিরে একটি বিজ্ঞাপন অন্তর ছুঁয়ে গেছে সবার। বসুন্ধরা কিংসের এই বিজ্ঞাপনের শুরুতে দেখা যায় ঢাকার বিভিন্ন বাড়ির দেয়ালে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা আঁকা হচ্ছে। শুরু হয় ধারা বর্ণনা। ‘চার বছর পর শুরু হয় ভালোবাসার এই উৎপাত। কবেকার প্রায় মরে যাওয়া ভালোবাসা। কেমন বেহায়া বানিয়ে দেয় আমাদের। আমাদের সব ভালোবাসা উপচে পড়ে। উপচে পড়ে সব দূর দেশের নায়কদের জন্য। অথচ নিজের দেশের গ্যালারিটা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে আমাদের জন্য। বুড়ো হয়ে যায় প্রিয় ফুটবল। আর যারা নায়ক হতে পারত তারা আশা হারিয়ে হয়ে যায় মামুলি পার্শ্বচরিত্র। আসুন না, দেশের ফুটবলকে আবারও ভালোবাসি। সত্যি সত্যি মন থেকে। ভালোবাসা প্রতিদান দেয়। দেবেই একদিন...।
প্রিয় পাঠক, আসুন, দেশের ফুটবল নিয়ে ভাবি একবার, প্লিজ... সূত্র: কালের কণ্ঠ
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক, আনন্দ আলো
/এসএম