• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

যেভাবে নিজে নিজে বড় হলাম

প্রকাশ:  ২৯ মে ২০১৮, ০২:১৬
শাহনেওয়াজ কাকলী

আমাদের বাড়িটি ছিল পাড়ায় সর্বপ্রথম দোতলা বাড়ি। প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো প্রায় সব ভাইবোনেরই প্রিয় খেলা ছিল। আমাদের বিশ কাঠার উপরে বাড়িটির চতুর্দিকে প্রাচীরে ঘেরা আর দেয়ালের বাহিরে-ভেতরে অনেক ফলের গাছ। এখন আর আগের মত গাছ নেই। বাড়িটা এখন কেমন নিস্প্রাণ। ছোটবেলার কত স্মৃতি বাড়িটির দেয়ালের ইটে ইটে, প্লাস্টারের সবুজ শ্যাওলায়। শৈশবে নিজেদের বাড়ির অনেক গল্পই মানুষের বেড়ে উঠা এবং বিশুদ্ধ স্মৃতি।

একটা বড় খাম্বা বা প্রধান ফটকের পিলার থেকে শুরু হতো দেয়ালে দেয়ালে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা। আমি ভাইদের পিছনে পিছনে হাঁটছি পাঁচ ইঞ্চি, দশ ইঞ্চি এমনকি তিন ইঞ্চি দেয়ালের উপর দিয়ে। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন দেয়াল প্রয়োজন অনুসারে। আবার যে দেয়ালে কাঁচের টুকরা সেঁটে দেয়া সেগুলোর পাশ দিয়েও যেতে পারতাম। লাল নীল, সাদা বোতল ভাঙ্গা, প্লেট ভাঙা কাঁচ দিয়ে দিত দেয়ালের উপর যাতে বাড়িতে চোর আসতে না পারে। আমরা সেই কাঁচগুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে তুলে ফেলতাম। তারপরও সেই দেয়ালের উপর দিয়েও হেঁটে যেতে পারতাম। যেখানে পারতাম না দেয়াল ছেঁচড়ে জামাকাপড় ছিঁড়ে কখনো কখনো নেমে পড়ে আবার শুরু করতাম। সে এক দুর্দান্ত শৈশব!

সম্পর্কিত খবর

    তিন ভাইবোন দেয়ালের উপর দিয়ে যেতে যেতে কখনো গ্যারেজের টিনের চাল, রান্না ঘরের চাল,গোয়ালঘরের চাল, ভেতর বাড়ির গেট এগুলো ছিল স্টপেজ। এর মাঝে যে ফুল ও ফল হাতের কাছে পড়ে সেটা পেরে ফেলাও খেলার একটা অংশ। সবচেয়ে বিপদগামী দেয়ালের নাম ছিল কুয়োর পাড়ের প্রাচীর। তিন ইঞ্চি গাঁথুনিতে সর্ব উঁচু দেয়ালটা হঠাত সামনে পরলে একটু ভয়ই লাগতো। সেই দেয়াল ১৪/১৬ ফিট পার করলেই গোয়ালঘরের চালে উঠা যেতো। ওটাই দৌড় খেলার সাফল্য।

    আমার দুইভাই দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চালে উঠে গেলে আমি যখন অতি সাবধানে গুটি গুটি পায়ে পার হচ্ছি আচমকা ভাইরা বলে উঠে “ঐ কাপড়ে পা দিসনা”।-পা দিলে কি হবে? আমি চেঁচিয়ে বলি। ভাইয়া বলে “পা পচি(পচে)যাবে তোর। ওগুলা কাপড়ে পা দেয়া যায় না। না আসতে পারলে নামি পড়”।আমার মাথাটা ঝিম করে উঠে। আমি কিভাবে পাড় হবো।‘না আমি চালে উঠবো”।

    নীচে তাকাতেই কূয়ো,দেয়ালের একদিকে-অন্যদিকে জংলা ডোবা। যদি পড়ে যাইতো…,ধপ করে বসে পড়ি দেয়ালের উপর দুইদিকে পা দিয়ে। ঝিম কেটে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্রোকজামাটা হাফ প্যান্টের ভেতর ঢুকিয়ে নেই। সাবধানী পায়ে কাপড় ছাড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পাড় হয়ে যাই।

    কিন্তু মনের মধ্যে যে গেঁথে গেলো ‘ঐ কাপড়ে পা দিলে পা পচে যাবে’। কিন্তু কেন? কাপড়গুলো ছিল পুরান শাড়ি বা লুঙ্গির টুকরা। আমার ভাইরাই বা কেমনে জানলো যে ঐ কাপড়ে পা দেয়া যাবে না? নিশ্চয়ই বড় কেউ ওদের শিখিয়ে দিয়েছে। আমার ভাইদের কাছে থেকে তাই আমিও শিখলাম ওগুলো নাকি ‘নাপাক কাপড়’’।

    এই নাপাক কাপড়গুলো কার? এগুলো দিয়ে কি করে? এখানে এগুলো কে রাখে? নানান প্রশ্নে মাথায় রহস্য ঘুরপাক করে।

    একে একে দিন যায়। বড়দের(নারী) অনুসন্ধানী চোখ জনশূন্য আঙ্গিনা খুঁজে দৌড়ে সূর্য্য ডোবার আগে সে কাপড়গুলো পোশাকের ‍আড়ালে লুকিয়ে আনে। মনে হয় যেন কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে আর এসব কিন্তু ছোটদের চোখেই বেশী ধরা পড়ে।“ছোট বলিয়া উহাদের অবহেলা করিবেন না উহারা অতিশয় মারাত্মক প্রাণী” উত্তমকুমারের বিখ্যাত সেই সংলাপটার মতই ছিলাম আমি। আমার চোখ ঠিক খুঁজে পায় ভাঁজকরা কাপড় বাথরুমের সানশেডের উপরে কিংবা ভেন্টিলেটরে।

    ছোটরা যতই খেলায় মনোযোগিই হোকনা কেন ঠিক কানটা থাকে বড়দের কথায়। এমন যৌন রসাত্মক আড্ডায় মেতে উঠতো প্রায়শ বেড়াতে আসা ভাবী, চাচী,খালারাসহ বড়বোনেরাও। ওঁরা ভাবতো আমরা কিছুই বুঝি না; কিন্তু কত শব্দ চয়ন যে আমাদের মস্তিস্কের সূত্রপাত মিলাতো;টেরই পায়নি। বুঝতেই পারেনি তাদের গল্পের সূত্র ধরে আমরাও ভেতরে ভেতরে বড় হচ্ছি।

    নামাজ পড়ে না, রোজার দিনে রোজা ভেঙ্গে ফেলে, চুপ চুপ করে খেয়ে উঠে। পিছনের কোন দাগ দেখে ফেললেই বলে, চুপ ! এগুলো থেকে কি আমরা কিছু্ই ভেবে নিতে সক্ষম হইনি? হয়েছি তো!

    মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়লে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে বলতো-তুই আমার পিছন পিছন আসবি যেন কেউ এই দাগ টের না পায়। আমরা ভয়ের অভিনয় করে পিছনের কাপড় খামচে ধরি, তারপর ভয়ে ভয়ে গায়ের সাথে লেপটে পাড় হই।

    ক্লাস সিক্স শেষ করে সেভেনে উঠবো, একটা বড় বড় ভাব মনে আসছে; ক’দিন পরেরই ওড়না পড়বো,আহ! এবার তো একটু শিশুতোষ বই ছেড়ে উপন্যাস পড়তেই পারি। প্রথম উপন্যাস ফাল্গুনী মুখোপধ্যায়ের ‘কন্যা কুমারী’ পড়ছি। সেখানেই শব্দটা পেলাম ঋতুস্রাব। একে তো কঠিন বানান তার ওপর উচ্চারণ। বইয়ে লিখা ছিল চারমাস ঋতুস্রাব বন্ধ সে এখন অন্তসত্ত্বা। দুটো শব্দ মাথার ঘুরপাক করতে করতে প্যাঁচ খুলে দেয় নিজের অজান্তেই।

    আমার হাতে এই বই দেখেই মুন্নি আপা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। আম্মাকে গিয়ে নালিশ দেয় এই বলে যে, আপনি চোখ রাখতে পারেন না কে কি বই পড়ছে? ও আম্মার উপরেও একশো ডিগ্রি।, সবকিছুতেই বেশী বেশী ছিল। যেন ওই আমাদের মা। এত এত শাসন করতো বলার বাহিরে। ওর ভয়ে যে বই পড়ার অভ্যাসটা নষ্ট হলো এখনো মনে হলে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে মন চায়। জনমের কুটনি। তাতে কী! বড় হওয়া কি ও আটকাতে পারবে?

    সেভেন থেকে এইটে উঠছি স্কুলে বন্ধুরা। কিন্তু একে একে সবাই রক্তপাতের রুগী হয়ে যাচ্ছি। কেউ কেউ যখন স্কুলে আসে না দুই-তিন দিন;তাকে ঝেঁপে ধরা হতো। বল, বল কেন স্কুলে আসিস নাই? কোথায় বেড়াতে গেছিস বল, বল! সে লজ্জ্বায় কিছু উত্তর দেয় না। বলে পড়ে বলবো টিফিন পিরিয়ডে বা লাইনের শেষে।

    এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আপাদের কানে কানে কথা বলে দেখি লাইন না করে ক্লাশে বসে থাকে। কী আজব! জ্বর নেই, কিছু নেই, হাত পা কাঁটা না। পিটি-প্যারেড না করার ভয়ে ক্লাশে বসে পড়ে। যারা আগে আগে ম্যাচিউর হয়ে যায় তারা তারা কেমন যেন কয়েকদিনে গভীর বন্ধু হয়ে যায়। আর আমরা ইনম্যাচিউররা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত ওদের পিছন পিছন ঘুরি গোপন কথা শুনতে। বাকীটা পেকে গেলাম স্কুলে বান্ধবীর অভিজ্ঞতায়।

    আচমকা অনেক বান্ধবী এসে জিজ্ঞেস করে-তোর হইছেরে ? আরে কি হইছে আমার! ঢঙ, কিছুই জানে না। মিথ্যা কথা বলছিস কেন? আল্লাহ্‌র কসম আমার এমন কিছুই হইনাই। তোরও হবে। মা বলছে- পৃথিবীর সব মেয়েদেরই হয়। মনে হয় যেন গজব দিয়ে মনে ভয় ঢুকিয়ে দিলো। এই ঋতুস্রাবের রুগী বান্ধবীগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করতনা। বেশী পাকা পাকা ভাব নিতো। আমরা কেউ কেউ আবার ওদের পাশেও বসতাম না। ওদের মধ্যে কারো কারো নাইন টেনের মেয়েদের মত আচরণ দেখলেই রাগ হত।

    ক্লাশ নাইনে উঠে যখন নিজেও ঋতুস্রাবের শিকার তখন ঠিকঠাক নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম নিজ অভিজ্ঞতায়। শুধু বড়রা শিখিয়ে দিলো কোন ছেলেদের সাথে এখন থেকে বেশী মেলামেশা যাবে না। “কেন?” – উত্তরে বলতো, চুমু দিলে এখন বাচ্চা হয়ে যাবে। সর্বনাশ! কী সাংঘাতিক। তারপর থেকে পুরুষ লোক ট্রাক হয়ে গেলো। ১০০ ফুট দুরত্ব বজায় রেখেই পথ চলা শুরু হয়।

    আমাদের সময় থেকেই এলো গার্হস্থ্য অর্থনীতি। লাল নিউজপ্রিন্টের এই বইয়ের একটি অধ্যায় ছিল ‘ঋতুস্রাবকালীন পরিচর্চা ও করণীয়’। মেয়েরা সবাই ফিসফাস করি,হাসতে হাসতে বলি এই অধ্যায় যেদিন আসবে আমি ক্লাশেই আসবো না। আমাদের লজ্জার চেয়ে বেশী ছিল আপাদের লজ্জা। অধ্যায় না পড়িয়ে অন্য অধ্যায় চলে যেতো। বলতো-এটাও দেখে নিস বাসায়,পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু বাড়ির কাজ হিসেবে দিতো না। এখন কারণটা বুঝি।

    ওই সময় সব ভাইবোনেরা বাড়িতে একসাথেই বসে পড়ত পড়ার টেবিলে বা একই ঘরে। সেখানে কি করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়বে- ঋতুস্রাব হলে কি কি করনীয়? কারো কারো তো আবার জোরে এবং সুরে না পড়লে পড়াই মুখস্থ হত না। আর যদি পড়তে পড়তে এমন হত উত্তর মুখস্থের সময়;(এটি একটি প্রাকৃতিক রোগ। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালই স্বাভাবিক নিয়মেই এটা হয়ে থাকে। এই সময় পরিষ্কার থাকা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নাহলে রোগ জীবাণুর সংক্রামণ হবার সম্ভবনা বেশী থাকে। তাই এই সময় পরিষ্কার পাতলা সুতি কাপড়, তুলা-গোঁজ বা সেনিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়।)

    -এই ভাইয়া,স্যানিটারি ন্যাপকিন কিরে?”

    – মনে হয় কল ঠিক করার কিছু হবে। স্যানিটারি মিস্ত্রী বাসায় আসে না,দেখিস না। দেখি প্রশ্নটা কি? ঋতুস্রাব কিরে আবার! ষড়ঋতু মানে তো ছয় বসন্ত। আচ্ছা স্যারকে জিজ্ঞাসা করিস।

    কী ভয়ঙ্কর লজ্জা! ভাগ্যিস এমন লজ্জার হাত থেকে স্কুলই বাঁচিয়েছে। তাই আপারা বেশী জোর দিতো কিভাবে কাঠের আলমারি, পোশাকের যত্ন নিতে হয়, শিশুর জামার রুমাল ছাঁট। ডিমের পুডিং এর প্রস্তুত প্রনালী। সুযোগ্য গৃহিণীর পরিচয়ই বাঙ্গালী নারীর আসল সৌন্দর্য্য। রোগবালাই তো আছে দুনিয়ায় ভালো থাকার আছে যে উপায়। ঋতুস্রাবজনিত রোগের জন্য আছে হাসপাতাল ও টাকা। শিক্ষার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। এখনও স্যানিটারি ন্যপকিন বা নাপাক কাপড় ব্যবহারে দেশ পিছিয়ে। লাখ লাখ মা- বোনেরা ভুগছে নানান সংক্রামণে বা রোগে। আসলে ওই কুয়োর পাড়ের দেয়ালের উপর শুকতে দেয়া নাপাক কাপড়টাই পাক কাপড় মানে স্যানিটারি ন্যপকিন।

    শরীরের নাম মহামায়া। আছে প্রেম-ভালোবাসা,কাম্না-বাসনা। আছে ঘৃণা,রাগ-অভিমান, আনন্দ-দুঃখ, চিন্তা, রোগ-শোক। সবই তো ওই প্রাকৃতিক ঋতুস্রাবের মত স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে। দেহ পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় উপাদানে সৃষ্টি। দেহের জন্যই পৃথিবীর সকল ব্যবস্থা। যাকে অস্বীকার করার মত বড় সত্য কিছু নেই। সেই সত্যকে মিথ্যা বা ভুলে পরিচালিত করার নামেই ব্যর্থতা।

    জীবনের যা কিছু প্রাকৃতিক তা প্রাকৃতিক নিয়মেই হোক না। আমার জীবনের ছোট ছোট দেখা; আমি সবসময় আমার নাটক বা সিনেমায় দৃশ্য বা সংলাপের মাঝে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

    শেষ এ যে সংলাপটা বলবো তা হলো নদীজন চলচ্চিত্রের একটি সংলাপ;

    – দেহি একটু কাছে আসো, মন ভইরে সোহাগ করতি দাও।

    – আহ! ছাড়েন। আমার সমস্যা আছে।

    – কি সমস্যা?

    – পেরাকৃতিক সমস্যা, বুঝেন না। মাইয়ে গো হয়।

    – ধুর, তুমার আর পেরাকৃতিক সমস্যা হওয়ার সময় পাইলে না।

    যা কিছু সত্য তাই প্রাকৃতিক ও সুন্দর।

    লেখক: নাট্যকার ও নির্মাতা

    নাট্যকার ও নির্মাতা
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close