• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সজলের লেখায় মুহসীন হলের সেই পুলিশি অভিযান

প্রকাশ:  ০৫ এপ্রিল ২০১৮, ২৩:২৭ | আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০১৮, ২৩:৪৯
কামরুল ইসলাম সজল

১৯৮৯ সাল ২৭ অক্টোবর, মুহসিন হলে বন্ধু মাসুদ করিম এবং জুয়েলের ৩৪২ রুমে চিচিংগা ভাজি আর মুরগী ডাল দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর নিয়ে আমার ৬৬১ নং রুমে বসে নিশ্চিন্তে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কারণ একটাই নিচের টিভি রুমে ভিসিআরে জমজমাট হিন্দি ছবি চলছে হলের সাধারন ছাত্র ভাইয়েরা বিশেষ বিনোদনের কারণে টিভি রুমে হিন্দি ছবি দেখছে। কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন কখন রাত ১২/১ টা বাজবে সম্মানিত দর্শকরা বিশেষ কিছু (!) ছবি দেখবেন সেই অপেক্ষা। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো একটাই হলের গেটে জমজমাট নিদ্রাহীন ছাত্রভাইদের আড্ডায়, পুলিশ হল তল্লাশীতে আসলে তাদের চিৎকারে অথবা হৈ হুল্লোরে আমরা সচেতন হতে পারবো।

এই একটা মহান (!) উদ্দেশ্যই নিয়েই হলের টিভি রুমে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো,অনেকে এ বিষযটাকে পরোক্ষ ভাবে সাধারণ ছাত্র ভাইদের মানব ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করা হয়েছিলো বললে অযৌক্তিক হবে না। তখনকার সময়ের যারা ছাত্র ছিলেন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ক্যাম্পাস অনেকটা ছিলো বৈরুত বা সিরিয়া বা প্যাল্স্টাইনের মত। ছাত্রদলের আভ্যন্তরীন কোন্দলের নামে অভি গ্রুপ -ইলিয়াস গ্রুপের নামে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে এমনও দিনরাত গিয়েছে যে সারা রাত গোলাগুলি হয়েছে সারা রাত গালাগালি হয়েছে ,দীর্ঘ দিনের পথ পরিক্রমায় এখনো কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না কেনো ছিলো এই ভ্রাতৃঘাতি দ্বন্দ্ব।

সম্পর্কিত খবর

    এই অযৌক্তিক দ্বন্দ্বে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিভিন্নভাবে, ও্ই আলোচনায় অন্য সময় যাওয়া যাবে। যা হোক ১৯৮৯ সালের ২৬ অক্টোবর রাত ১২ টা পর্যন্ত বৃহস্পতিবার ছিলো, টিভি রুমে রোমান্টিক এক হিন্দি ছবি দিয়ে আমি আমার ৬৬১ নং রুমে শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। আমার সাথে ছিলো অভি ভাইয়ের এলাকার বহিরাগত চোকদার নামের একজন। হঠাৎ সম্ভবত রাত ৩টা/সাড়ে ৩টা হবে বিভিন্ন চিৎকার এবং হৈ হুল্লোরে ঘুম ভেংগে গেলো। আমি ঘুম থেকে উঠে জানলা খুলে নিজের চোখকে বিশ্বাস করছিলাম না, প্রায় ১৫০/২০০ পুলিশ হল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ১৫/২০ জনে গেট ভাংগার চেষ্ট করছেন। আমি ১ মিনিটের মধ্যই গেঞ্জি পরে লুংগি পড়া ছিলাম রুমের চোকদারকে বললাম হলে পুলিশ ঢুকেছে, বলেই আমি বের হয়ে অভি ভাইয়ের রুমের দিকে দৌড় দিলাম। পথিমেধ্যেই দ্বিতীয় তলায় অভি ভাইয়ের সাথে দেখা লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত। আমাকে বললেন সারা হল পুলিশ ঘেরাও করে ফেলেছে কি করা যায়? আমি বললাম চলেন পিছনের দিকে যাই। তখন মুহসিন হলের পিছনে মার্কেটটি নির্মিয়মাণ। দৌড়ে হলের ওয়াল টপকে মার্কেটের ছাদে উঠলে রাস্তা থেকে বিডিআররা আমাদের তাড়া করলো। আমি আর অভি ভাই দৌড়ে আবার হলে ঢুকে গেলাম,এর মধ্য হলে গেট ভেংগে পুলিশ ঢুকে গেলো।

    আমি আর অভি ভাই দৌড়ে হল ক্যান্টিনে ঢুকে গেলাম। অভি ভাই ক্যান্টিনের এক কর্নারের ফ্লোরে ক্যান্টিন বয়দের সাথে শুয়ে পড়লেন আর আমি চেয়ারে বয়দের সাথে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম চৌকষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাবুলের কন্ঠস্বর “অভি ওঠো, তুমি এখানে কেন...? সাথে এসি আক্তারুজ্জামান রুনু এসি আকরা সহ অন্যরা ছিলেন,অভি ভাইকে ধরে নিয়ে গেলেন,আমি ভাবলাম এ যাত্রা হয়ত বেঁচে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম তারা আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুললেন। আমি ঘুমের ভান করলাম,ডিবির এসি রুনু ভাই বললেন, ডিবি অফিসে যেয়ে ঘুমাইয়ো, এখানে ঘুমাতে হবে না। আমাকে হল গেটে নিয়ে দূর্ধর্ষ এসি আকরাম তার কোমরে থাকা হ্যান্ডকাফ আমার দুই হাতে পড়িয়ে হল গেটে বসাইয়া রাখলেন। ইতিমধ্যে সকাল হয়ে গেছে। আমি তখন হল শাখা ছাত্রদল সম্পাদক। আমি হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় বসে আছি। তৎকালিন জাসদ ছাত্রলীগ হল সম্পাদক আমার ঘনিষ্ট বন্ধু নোমান এসে বললো. বন্ধু তুমি চিন্তা করো না।হল প্রোভোস্টকে নিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো। আমাদের এ কথোপোকথন শুনে এসি আকরাম বললেন. দুই বন্ধু যখন এত হৃদ্যতা তাহলে একসাথেই থাকো। এটা বলেই আমার হ্যান্ডকাফ একটা খুলে নোমানের হাতে পড়িয়ে বললো. এখন দুই বন্ধু গল্প করো। তাতে মনে হলো নোমান খুশিই হলো,আমাকে বললো বন্ধু ভালোই হলো দুই বন্ধু একসাথে তাস খেলা যাবে। বন্ধুত্বের বন্ধন কতটা দৃঢ হলে এ মানসিকতা পোষন করতে পারে।

    আমাকে এবং নোমানকসহ অনেক অচেনা হলের বিভিন্ন রুমের গেস্টদেরসহ একটি ট্রাকে তুলে রওনা হলো পুলিশ। ট্রকটি যখন বসুনিয়া তোরন পার হচ্ছিলো তখন দেখলাম জহুরুল হক হলের সামনে ওই হলের সাবেক ভিপি চুন্নু ভাইসহ অনেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছেন। আজ পর্যন্ত এ হাত তালির রহস্য খুঁজে পেলাম না, ছাত্র রাজনীতির কোনো রসায়নে এ আচরণটির ব্যাখা পাওয়া যাবে না। আমি ট্রাকে বসে হলে গ্রেফতারের ভয়াবহতা বুঝতে পারি নাই। কি পরিমান ছাত্র এবং বহিরাগতরা গ্রেফতার হয়েছেন, আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো শাহাবাগ পুলিশকন্ট্রোল রুমে। ওখানে যেয়েই বুঝলাম হলে আর কেউ বাকি রইলো না। বন্ধু মাসুদ, নির্মল, ঠাটারীবাজারের হামিদসহ সবাই গ্রেফতার।

    কিছুক্ষণ পরে সবার নাম ঠিকানা এন্ট্রি করা শুরু হলো বন্ধু নোমানকে আগেই মু্ক্তি দিলো, এরপর সবাইকে নাম ঠিকানা লিখে সবাইকে এক এক করে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। পরবর্তীতে আমার সিরিয়াল আসলো। একজন কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বললেন, তুমি ক্যান্টিনে কেনো ঘুমিয়েছিলে? আমি বললাম, আমার পরীক্ষা শেষ। তাই হিন্দি ছবি দেখছিলাম,পরে পুলিশ স্যারদের দেখে ভয় পেয়ে ক্যান্টিনে শুয়ে পড়েছি। পুলিশ অফিসার বললেন, যাও ভালো ভাবে পড়াশুনা করো। আমাকে ছেড়ে দিলো আমি খালি পায়ে আমার বন্ধু মাসুদ ,নির্মল,হামিদসহ অন্যদের পুলিশের গাড়িতে রেখে হেঁটে হেঁটে ক্যাম্পাসের দিকে ঢুকলাম। ,সরাসরি হলে এসে দেখলাম প্রতিপক্ষ গ্রুপ আমাদের সমস্ত রুমগুলো ভেংগে ফেলছে। শুধু মাত্র আমার রুমটি তার বাকি রেখেছিল। আমি রুমে ঢুকে ১০ মিনিটের মধ্য কাপড় চেঞ্জ করে বন্ধু হেলাল মাসুদ করিমের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে চলে গেলাম অজানা গন্তব্যে ... ।

    বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিলো ঐ দিন মুহসীন হল থেকে।

    লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close