• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জাতির পিতার রাজনৈতিক দর্শন ও হালের বাস্তবতা

প্রকাশ:  ১৯ মার্চ ২০১৮, ০০:০৪
মনজুর রশীদ

আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ভুলে দেশের যারা বিদেশী ঐতিহ্য আর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তারা হয়ত ভুলে গেছেন সেই চির পরিচিত ছন্দখানি - “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া একটি ঘাসের ডগার ওপর একটি শিশির বিন্দু।” কবির এই কথাগুলো আসলেই একদম সঠিক। আমাদের বাড়ীর একদম কাছে যে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে সেটা কি আমরা কখনো খুঁজে দেখার চেষ্টা করি? আমাদের দেশে যে বঙ্গবন্ধুর মত এত উঁচু মানের এমন একজন মহান দরদী নেতা ছিলেন সেটাই বা আমরা কতটুকু স্মরণ করি? অবিসংবাদিত এই মহান জাতীয় নেতার জন্মদিনের এই রক্তঝরা মাস আরো যে কারণে আমাদের বাঙালী জাতির জন্য গৌরবোজ্জ্বল তার মধ্যে একাত্তরের ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এবং সেই সূত্র ধরে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভাগ্যক্রমে সেই একইমাসে মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে জাতিসংঘ কতৃক মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ঘোষনা সত্যিকার অর্থেই এক বিরল অর্জন আমাদের দেশের জন্য।

কিন্তু এতসব অর্জনের স্বপ্নদ্রষ্টা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী নেতা হিসাবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত জাতির পিতার নেতৃত্বে বিকশিত যে রাজনৈতিক দলটির সংগ্রামী ও আদর্শবাদী ইতিহাসের কথা আমরা ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছি, দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে সেই দলটির এখনকার ঙ্কিছু কিছু ভূমিকা কেন যেন প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেও পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি কারাবন্দী ছিলেন পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের হাতে। কিন্তু তার আহবানে ডাকা মুক্তিযুদ্ধ কোনো অবস্থাতেই থেমে থাকেনি। তার রাজনৈতিক সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর এবং কামারুজ্জামান এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্রসম। এই চারজনকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়।

সম্পর্কিত খবর

    জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছেন এই চারজন বীর নেতা। বাঙালি জাতি আজো এই চার মহান নেতাকে জাতীয় চার নেতা হিসেবে চেনে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে ঘাতকের ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে নিহত হওয়া এই চার মহান নেতার বাইরেও ছিলো এই দলটির আরো অনেক সূর্যসন্তান। যারা হাল ধরেছে দলটির নানা দুর্যোগকালীন সময়ে। কিন্তু এখন এই বৃহৎ ঐতিহ্যবাহি দলটির সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সেই উচ্চতার আর কোন কান্ডারী আছে বলে দৃশ্যমান হয়না! কত সংগ্রাম, ত্যাগ আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত আদর্শকে ধারণ করে দীর্ঘ পথচলার সেই ঐতিহ্যবাহি রাজনৈতিক দলটি আজ কোথায়? কোথায় সেই চার নেতার মত সমান তালে চলা অন্যান্য নেতৃত্ব? সব কিছুতেই এখন বাংলাদেশে একমাত্র শেষ ভরসা এই দলের সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু একই সঙ্গে এই ঘটনা দেশের সুশাসনের জন্য কি বড় চ্যালেঞ্জ নয়? তাহলে আর এতো এতো মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সাংসদ, নেতা, আমলা রেখে কী লাভ? ছোটো-বড় সব সিদ্ধান্তই যদি তাঁকে একাই দিতে বা নিতে হয়।

    যে লেবাস নিয়ে বর্তমানে অজস্র বঙ্গবন্ধুর সৈনিক(!) দেশজুড়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, তাদের যা কীর্তিগাঁথা, জীবনচর্চা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের মুখে শুনতে পাওয়া যায়, প্রায় সব গণমাধ্যমেই প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নেতিবাচক সংবাদ শিরোনাম হিসাবে যে খবরগুলো আসে - তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই ভেবে যে, এই দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়নে তারা কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ? বঙ্গবন্ধুর সময়কালীন আওয়ামী লীগের আদর্শ আর এখনকার আওয়ামী লীগের আদর্শ আর এপ্রোচের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। সরকারে চাটুকর ও তোষামোদকারীদের ভীড় বেড়েই চলেছে অব্যাহত গতিতে। চাটুকারিতার একই ধারাবাহিকতায় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের অনেকেই দায়িত্ব পালন করছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডারের মতো করে। অনেকের অভিমত, সেই সুযোগে এখন এই দলটির একটি বড় অংশ পরিণত হয়েছে আওয়ামী চাটুকর লীগে। যার মূল লক্ষ্য হলো নানা উপায়ে আওয়ামী বাণিজ্য সিদ্ধি। অনেক লোভী স্বর্ণকারদের মতো মায়ের স্বর্ণও যেন তাদের অনেকে ছাড়তে চায়না। আর এই জায়গাটি তৈরি হয়েছে দলটির ত্যাগী ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতাদের জায়গায় নানা স্থান থেকে আসা সুবিধাবাদি হাইব্রীড ব্যবসায়িক নেতাদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী এই দলের মোট সাংসদদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাদের অনেকেই নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা যেমন ব্যয় করেন, আবার দলকে ব্যাপক ডোনেশনও নাকি দিয়ে থাকেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফলে তারাসহ তাদের অনুগামীদের কী ধরনের রাজনৈতিক অভিলাষ থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

    ফলে এ দেশের সমাজমানসে এক ধরনের বিভ্রান্তিকর বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে ভোগবাদিতার সঙ্গে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনাচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা। সর্বক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতি, বাণিজ্য, মাস্তানি, আর মাদকাসক্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে পুরো দেশ। সমাজে মিথ্যাচার, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়েই চলেছে। সারাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশের পথে, হাটে-মাঠে-ঘাটে ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, বিরোধীদল বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি প্রতিহিংসার যে দাবানল বিস্তৃত করে যাচ্ছে তা হয়তো বর্ণনা করা যাবে। কিন্তু এই তান্ডব বা প্রতিহিংসাপরায়নতা জাতির ভবিষ্যতের জন্য যে অশনি সংকেত দিচ্ছে তা কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু এতটুকু উপলব্ধি করা যায় আমাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রের ভাগ্যাকাশে অদূর ভবিষ্যতে গভীর অন্ধকার কিছু হানা দেয়ার পথ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। হয়তো এই অভাগা জাতিকে আবারো দেখতে হবে রাজপথের নিষ্ঠুরতা, রক্তপাত এবং নতুন মোড়কে পুরানো অপশক্তির আবির্ভাব। আর এ সবকিছুই ঘটবে আমাদের বহুল চর্চিত ভুলে, ক্ষমতায় মোহাবিষ্ট দাম্ভিকতার ফলে। এমন যে কোনো দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর শূণ্যতা তাই অপূরণেয়। কারণ তার নেতৃত্বের বিশালতা ও মানবিক ঔদার্যতা কক্ষণোই হীন স্বার্থকে চরিতার্থ করার শিক্ষা দেয়না।

    দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাছে বর্তমানে যে বিষয়গুলো অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লাগে তা হলো - বছরের পর বছর ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজপথ জুড়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচী। এসব কর্মসূচীকে ঘিরে নানা অরাজকতা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত-হত্যাকান্ড এমনকি ছাত্রী নির্যাতনের খবরও মিডিয়ায় বারবার আসছে। অথচ দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য ভিন্ন মতাবলম্বী বিরোধী দলসমূহকে কোনোভেবেই কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে দিচ্ছেনা সরকারী দল আওয়ামী লীগ এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ। কেবল ক্ষমতাসীনরা রাজপথে কর্মসূচী পালন করবে, আর অন্য দলগুলোর অনুমতি চাইলেও দেওয়া হবেনা, অথবা তাদের শান্তিপূর্ণ কোন কর্মসূচীতে বাধা দেওয়া, লাঠিচার্জ করে কর্মসূচী বানচাল করা, ক্ষমতার জোরে গ্রেপ্তারপর্ব চালানো, যখন তখন যাকে তাকে ডিবি পরিচয়ে উঠিয়ে নিয়ে তা অস্বীকার করা, মামলা মোকদ্দমার মধ্যে বিরোধী ঘরানার রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারগুলোকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তোলা – এসব কেমন রাষ্ট্রীয় ও মানবিক নীতি! বিরোধী দলকেও রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনে সহযোগিতা করাও সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। কারণ বিরোধী দল ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার নিঃস্ব এবং তার বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ অত্যন্ত দুঃজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে আন্দোলন প্রতিরোধ করার নামে আমাদের সরকার বিরোধীদলসমূহকে ভবিষ্যতে আরো চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিতে প্রভাবিত করছে। ইতিপূর্বেকার জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের জায়গা থেকে সরে এসে যখন তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করার চেষ্টা করছে সেটি নিয়েও সরকার প্রধান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ অনেকদিন ধরেই খুব উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের যারা পরামর্শদাতা কিংবা যারা সরকার চালান তারা কেন আন্দোলন প্রতিহত করার নামে এমন সহিংসতার পথ প্রশস্ত করছেন তা বোঝা সত্যিই কষ্টকর। এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের পরিণাম কী হতে পারে তার স্পষ্ট নজির সকলেরই জানা। কিন্তু দুঃখের বিষয় ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিতে চায় না।

    বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের প্রধান শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। একটি প্রবীণতম দল হিসাবে এই দলটিই নেতৃত্ব দিয়েছে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ এদেশের অধিকাংশ ও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামের। জনগণের আস্থা ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বহু ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে আজো টিকে আছে এই দলটি। এই দলের ইতিহাস ও পথচলার সাথে মিশে আছে জাতির জনকের নাম। তারাই আজ ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এখন কোনো কিছুর অভাব আছে বলেতো মনে হয়না। তাদের পাশে আছে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ, সংসদে এককভাবে সর্বাত্মক ক্ষমতাও তাদের আছে। তাহলে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে দিতে এতো ভীতি কেনো তাদের? জিয়া অরফানেজ ট্রাষ্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাজার প্রতিবাদে বা তাদের ভাষায় নির্দলীয় সহায়ক সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবীতে প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন, গণমিছিল বা অন্য যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী দিলেই কি তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া সম্ভব? জনগণ না চাইলে কোন আন্দোলন-সংগ্রাম করে এখন কী কোনো দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়? আওয়ামী লীগতো ক্ষমতা দখল করেনি, পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতার মসনদ ছিনিয়েও নেয়নি- তাহলে কেন, কিসের এত ভয় তাদের বিএনপিকে নিয়ে?

    এ কারণেই অসংখ্য দায়িত্বের বোঝা আওয়ামী লীগের কাঁধে। আর আমাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্বও আওয়ামী লীগের। সে দায়িত্বের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুরোধ এমন কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ হবেনা যাতে দেশে চরম সহিংসতা সৃষ্টি হয় এবং এমন কিছু করার জন্য উস্কানি দেওয়াও ঠিক হবেনা যাতে সেই পুরানো অপশক্তি আবারো এদেশের গণতন্ত্র গ্রাস করার সুযোগ খুঁজে পায়। জনগণের প্রতি আস্থা রাখুন এবং জনকল্যানমূলক কাজে মনোযোগ দিন - জনগণ তখনই কেবল আপনাদের পাশে থাকবে। তা না হলে নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারার পথই কিন্তু প্রশস্ত হতে পারে !

    লেখকঃ গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close