• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

উচ্চ আদালতের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদ

প্রকাশ:  ১৮ মার্চ ২০১৮, ০১:২১ | আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৮, ০১:৩৬
পীর হাবিবুর রহমান

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পর সাম্প্রতিক নানান ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদ উঠেছে সব মহলে। সমাজের সব মহলের অন্দরেই চলছে পর্যবেক্ষণ। উচ্চ আদালতের রায় বা মতামত যখন যার পক্ষে যাচ্ছে তারাই সন্তুষ্ট হচ্ছেন। অন্যদিকে যাদের বিপক্ষে যাচ্ছে তারা অসন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক শক্তির মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দলীয় স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার বিভাগ ঘিরে দীর্ঘদিন থেকে যেভাবে প্রকাশ হচ্ছে তাতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।

পর্যবেক্ষকদের ভাষায়, দেশের সব মানুষের আশা-ভরসা ও ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস এবং রাষ্ট্রের এই অন্যতম স্তম্ভের ভাবমূর্তি কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন করা যায় না। কিন্তু বিভিন্ন সময় সংসদ থেকে রাজপথ পর্যন্ত বিচার বিভাগ ঘিরে অসন্তোষ, বিরূপ মন্তব্য ও বক্তব্য এসেছে, যা স্বাধীন সার্বভৌম ও শক্তিশালী বিচার বিভাগের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

সম্পর্কিত খবর

    পর্যবেক্ষকদের মতে, উচ্চ আদালতকে যেমন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে, তেমনি বিচারকদেরও উচ্চ আদালতের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখা সময়ের দাবি। সম্প্রতি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সুপ্রিম কোর্টের দুটি অঙ্গের একটি হাই কোর্ট বিভাগ জামিন দিলে রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেল তাত্ক্ষণিক দুই দিনের জন্য জামিন আদেশ স্থগিত চেয়েও তা পাননি। এই জামিন তাদের অসন্তুষ্ট করেছিল। পরবর্তীতে বুধবার দুদকের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আদেশ স্থগিতের আবেদন করেন। এই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান যুক্তি ও বক্তব্য উপস্থাপন করলেও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা উপস্থিত ছিলেন।

    দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম শুরুতেই দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, হাই কোর্ট যে গ্রাউন্ডে জামিন দিয়েছে তার সার্টিফায়েড কপি আমরা এখনো পাইনি। অতএব এই জামিন স্থগিত করা হোক। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আদেশ স্থগিত করে লিভ-টু আপিল দায়ের করার নির্দেশ দিয়ে রবিবার শুনানির দিন ধার্য করে। এই সময় বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্য না শুনে দুদকের একতরফা বক্তব্য শুনে জামিন আদেশ স্থগিত করায় তারা হট্টগোল ও প্রতিবাদ করেন। কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন ও আবদুর রেজাক খানের মতো সিনিয়র আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

    পরবর্তীতে বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে এই রায়ে সরকারপক্ষের ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে বলে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। এদিকে বৃহস্পতিবার দুদকের আইনজীবীরা লিভ-টু আপিল দায়ের করেছেন। কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের ওপর শুনানি আজ রবিবার অনুষ্ঠিত হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে আদালতপাড়ার ভিতর-বাইরের সব মহলেই কমবেশি সৎ-ভদ্র ও ন্যায়বিচারক হিসেবে জানেন এবং চেনেন।

    এর আগে বহু আলোচনা, বিতর্ক ও ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যেভাবে দুজন প্রধান বিচারপতির বিদায় ঘটেছে এবং তাদের ঘিরে যে প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছিল, তা রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগের আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কাঙ্ক্ষিত ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসনামলে উচ্চ আদালতপাড়া কমবেশি উত্তপ্ত ও মারমুখী হয়েছে। প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা থেকে বিক্ষোভ ও অনুষ্ঠান বর্জনের ঘটনা ঘটেছে। বিচারপতিদের বাসভবনে বোমা হামলা হয়েছে। সংসদ থেকে রাজনীতির ময়দান সবখান থেকেই বিচারকদের সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। একটি স্বাধীন শক্তিশালী উচ্চ আদালতের জন্য এসব ঘটনা কখনই শুভকর ছিল না। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উচ্চ আদালতকে সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীনভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করার পথে সব মহলকেই সহযোগিতার হাত বাড়ানো জরুরি। এমনটাই মনে করেন, পর্যবেক্ষকরা।

    এমনকি উচ্চ আদালতে সত্তরোর্ধ্ব প্রখ্যাত আইনজীবীদের মতো জ্ঞানে-গরিমায়, শিক্ষায়, নেতৃত্বে-ব্যক্তিত্বে ও আত্মমর্যাদায় যেমন নতুন আইনজীবী তৈরি হচ্ছেন না, তেমনি বিচার বিভাগে বিচারপতি মুর্শেদের মতো বিচারকেরও আবির্ভাব ঘটছে না। রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে এই পরিস্থিতিতে বিচারক এবং আইনজীবীদেরও চিন্তা করার সময় এসেছে। উচ্চ আদালতের ওপর মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জনে বিচারকদেরও যেমন সাহসী ভূমিকার প্রয়োজন, তেমনি আইনজীবীসহ সব মহলের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা জরুরি।

    পর্যবেক্ষকদের মতে, সুপ্রিম কোর্টে যেমন রিট মামলা কমে যাচ্ছে, তেমনি আগের মতো শুনানিও হচ্ছে না। বিচারক, আইনজীবী, রাজনৈতিক শক্তি এবং নির্বাহী বিভাগ সবাইকে মিলেই জনগণের ভিতর উচ্চ আদালত ঘিরে পুঞ্জীভূত সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করার সময় এখন দরজায় কড়া নাড়ছে। দেশ ও মানুষের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট অনেক নির্দেশনা ও রায় দিয়ে থাকে; যা হামেশা উপেক্ষিত হতে হতে এসব রায়কে উপেক্ষিত রায় হিসেবে চিহ্নিত করছে। সুপ্রিম কোর্ট আসামি ধরতে পুলিশকে পরিচয় প্রদান ও আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করার নির্দেশ দিলেও সম্প্রতি তা উপেক্ষিত হতে দেখেছে দেশ। ফুটপাথের ওপর দিয়ে মোটরসাইকের চলাচলে হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ সেই রায় কার্যকর করতে পারেনি। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করার রায় থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। পুলিশ, প্রশাসন, ট্রাফিক বিভাগ এবং নির্বাচিত সংস্থা উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষায় কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নয়। পর্যবেক্ষক মহল বলছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা রুখতে, প্রতিটি রায় কার্যকর করতে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষায় বিচারকদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

    লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close