• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের ভাবনা কী?

হাসান হামিদ

প্রকাশ:  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২০:১৫ | আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:১৫
নিজস্ব প্রতিবেদক

আমার জন্ম সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের এক অজপাড়া গ্রামে; অবশ্য হাওরের প্রায় সব গ্রামই একরকম। অনেক দিন বাড়ি যাই না। বড় হতে হতে দেখেছি সেখানকার মানুষ কতো কষ্ট করে বেঁচে থাকেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সবচেয়ে বড় সমস্যা সেখানে। বাড়ি না গেলেও প্রতিদিন খোজ-খবর নেওয়া হয়। তাছাড়া পত্রিকার পাতা দেখে চোখে পড়েছে সাম্প্রতিক কিছু উন্নয়ন তৎপরতা; বিশেষত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।

আমরা জানি, যে কোনো অঞ্চলের উন্নয়ন একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সুষম উন্নয়নে হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন সমান দাবিদার। দীর্ঘদিন অবহেলিত আমাদের অঞ্চলের উন্নয়ন তাই আজ হাওরবাসীর প্রাণের দাবি। কোনো অঞ্চলের উন্নয়নে প্রথম কাজটি হলো সে অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন জনপদের মধ্যে যোগাযোগ ও দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ একান্তভাবে দরকার। বর্ষা মৌসুমে হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌকা ও স্টিমারনির্ভর। কিন্তু শুকনো মৌসুমে যখন পানি থাকে না, তখন হাঁটা ছয়-মাইসা রাস্তা (ছয় মাস পানির নিচে, ছয় মাস মোটামুটি শুকনো) রাস্তা ছাড়া আর চলার ব্যবস্থাই থাকে না। এ দুই অবস্থার মধ্যে সমন্বয় করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের মধ্যে সাম্যতা রেখে হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। নইলে এ অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ আমূল পরিবর্তন হয়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে।

সম্পর্কিত খবর

    অনেক দিনবাড়ি যাইনি; তবে শুনেছি, বর্তমানে হাওরাঞ্চলে মাটির রাস্তা তৈরি করে পিচঢালা সড়ক বানানো হচ্ছে, যা জনগণের কাছে আভুরা সড়ক নামে পরিচিত। ছয়-মাইসা রাস্তাকে মাটি দিয়ে উঁচু করে এ রাস্তা বানানো হচ্ছে। প্রতিটি রাস্তাই 'একরস দা ফ্লো' অর্থাৎ হাওরের পানি বের হয়ে যাওয়ার পথে আড়াআড়িভাবে তৈরি হচ্ছে, যা বাঁধের মতো কাজ করছে বা করবে । এগুলো বেড়িবাঁধের মতো পানির প্রবাহ আটকে রাখবে। বাঁধের মতো এই সড়কপথের মাঝে মধ্যে ব্রিজ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ স্থলভাগের যোগাযোগের মডেলটি হাওরে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কেন এই স্থলের যোগাযোগের মডেলটি হাওরে প্রয়োগ করা হচ্ছে? কারণ প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের ঘটে এ ছাড়া অন্য যোগাযোগ পদ্ধতি জানা নেই বা কোনো নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করার যোগ্যতা নেই বা চিন্তা করে পরিবেশ উপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করার সদিচ্ছা নেই। এ রাস্তা কি আসলে হাওরের পরিবেশ উপযোগী? না, কখনোই হাওরের জন্য পরিবেশ উপযোগী নয়।

    এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কিছু বলা দরকার বলে মনে করছি। পানিপ্রবাহের একটি প্রাকৃতিক পথ আছে, যা হাইড্রোলজিতে 'ন্যাচারাল ওয়াটার কোর্স' বলে। বাঁধের মতো এই রাস্তা পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক পথকে রুদ্ধ করে দেবে। ফলে পানিপ্রবাহের মধ্যে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাছাড়া পানি আগের চেয়ে বেশি সময় ধরে হাওরাঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে থাকবে। কারণ ব্রিজের মতো আউটলেট দিয়ে বের হওয়ার জন্য অনেক বেশি সময় লাগবে। ফলে হাওরের কৃষি তথা ধান লাগানো, পরিচর্যা ও কাটার সময়ের মধ্যে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেবে। বেশি সময় পানি আটকে থাকার কারণে ফসল ফলানোর মৌসুম পরিবর্তিত হবে এবং ধান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে সমস্যার সৃষ্টি হবে। আগাম বর্ষণ বা অতিবৃষ্টি এই জলাবদ্ধতা বাড়িয়ে দেবে, যা এ অঞ্চলের কৃষিকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। তা ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত এই রাস্তা কিছু হাওর এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। কারণ বাঁধের মতো রাস্তা সব পানি সরে যেতে বাধার সৃষ্টি করবে এবং পানি বের হওয়া শেষ না হতেই পরবর্তী বর্ষা মৌসুম এসে তা আবার জলাশয়ে পরিণত করবে। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। যদিও বলার চেষ্টা চলছে, আবদ্ধ পানিতে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু প্রাকৃতিক মাছের উৎস চিরতরে বিলীন হবে। সাধারণত প্রাকৃতিক মাছ বিষ বা দূষণমুক্ত হয়। চাষের মাছ হয় দূষণযুক্ত। কারণ এর খাদ্য-খাবার। মাছের খাদ্য-খাবার ট্যানারিসহ বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য মিশিয়ে তৈরি করা হয়, যা মাছে খাওয়ার পর বায়োঅ্যাকুমুলেশনের মাধ্যমে মাছের শরীরে জমা হয়। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে এবং মারাত্মক রোগের জন্ম হবে। তাছাড়া এ বাঁধের মতো রাস্তা মাছ ও জলজ প্রাণীর জীবনপ্রবাহে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি হবে।

    আমরা জানি, হাওরের পানিতে যুগ যুগ ধরে মাছ ও জলজ প্রাণী বিচরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে আসছে এবং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ডিম দিয়ে প্রজনন করে আসছে। প্রতিটি মাছ ও জলজ প্রাণী তা করে থাকে। বাঁধের মতো রাস্তা মাছ ও জলজ প্রাণীর চলার পথে অন্তরায় হবে এবং এরা দিক্ভ্রান্ত হয়ে দিগ্গি্বদিকে ছড়িয়ে পড়বে। দেখা যাবে তার প্রজনন ক্ষেত্রের ওপর বা পাশে রাস্তা হয়ে প্রজনন ক্ষেত্রটি বিলীন হয়েছে। বিচরণের পথ অনেক ঘুরিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্রিজের নিচে স্রোত বেশি হওয়ায় অনেক মাছ সেদিকে চলাচল করবে না। প্রজননে বাধা পড়বে। প্রজননের অভাবে অনেক মাছ দ্রুত বিলুপ্ত হবে। কিছু মাছ ও জলজ প্রাণী অভিযোজন করার চেষ্টা করবে, বাকিরা টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যদিও বর্তমানে সাদা চোখে এ পরিবর্তন দেখা যাবে না। আর সাধারণ মানুষের পক্ষে বিষয়টি বোধগম্য করা দুরূহ ব্যাপার। ২০-৩০ বছর পর বাজারে মাছের আমদানির পরিমাণ ও কম সংখ্যক প্রজাতির মাছের উপস্থিতি দেখে এর ফলাফল চোখে পড়বে। তখন নতুন প্রজন্ম বলবে, পূর্ব প্রজন্মের মানুষ আমাদের উন্নয়নের নামে ঠকিয়েছে। প্রাকৃতিক মৎস্য ক্ষেত্র নষ্ট করে আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালি থেকে বঞ্চিত করেছে।

    আশার কথা হলো, ২০১৫ সালের মে মাসে 'হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর'-এ উন্নীত করা হয়। এর আগে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। মহাপরিকল্পনায় হাওর এলাকায় 'সাবমার্সিবল' সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এ সড়ক শুষ্ক মৌসুমে যানচলাচল উপযোগী থাকে। বর্ষায় পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি হয় না। বর্ষায় দীর্ঘ সময় তলিয়ে থাকলেও সড়কের কোনো ক্ষতি হয় না। পানির নিচে থাকায় নৌ চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করে না। এ ছাড়া পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রেখে উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হলে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। মহাপরিকল্পনায় সাবমার্সিবল সড়ক নির্মাণের সুপারিশ থাকলেও হাওরে সাধারণ সড়ক নির্মাণ করা টাকা বাঁচাতে। সাবমার্সিবল সড়ক কিংবা উড়াল সড়ক নির্মাণ ব্যয়বহুল। কিন্তু সাবমার্জিবল রাস্তা ও মাটির রাস্তা দুটিই হাওরে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে। মাটির রাস্তা বর্ষা মৌসুমে বা ভরা হাওরের সময় ঢেউয়ের জন্য ওয়াশআউট হয়ে ক্ষয় হবে এবং ভাঙন ধরবে। সাবমার্জিবল রাস্তার ওপর প্রচুর পলি-কাদা জমবে, যখন রাস্তাটি জলের তলায় থাকবে। ফি বছর রাস্তার ভাঙন মেরামত ও পলি-কাদা পরিষ্কার করা মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করবে। আর আমাদের মতো দেশে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ যেখানে দুর্বল, সেখানে এই রাস্তা অল্প সময়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাবে এবং দীর্ঘদিন মেরামত করা হবে না। আরও প্রশ্ন হচ্ছে, এত খরচ করে ছয় মাস ব্যবহারের জন্য রাস্তা তৈরি কতটা যুক্তিযুক্ত?

    আমার মনে হয়, সবচেয়ে উপযোগী হতে পারে আধুনিক নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্তমান প্রচলিত নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার স্থলে আধুনিক নৌঘাট, নৌযান ইত্যাদির ব্যবস্থা করা গেলে বর্ষাকালের যোগাযোগ অনেকটা নিরাপদ ও আরামদায়ক হতে পারে। শুকনো মৌসুমের জন্য নতুন চ্যানেল খনন করা যেতে পারে, যা সারা বছর পানি ধরে রাখবে এবং এই চ্যানেলের মাধ্যমে বিভিন্ন জনপদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে। হাওরের নদীগুলোকে পরিকল্পিত ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়িয়ে শুকনো মৌসুমে নৌচলাচলের উপযোগী করা যেতে পারে। ফলে সারা বছর এ নদীতে নৌচলাচল করতে পারবে। ফ্লাইওভারের মতো দীর্ঘ ব্রিজ তৈরি করে হাওরের বিভিন্ন জনপদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা হতে পারে সবচেয়ে আধুনিক ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একমাত্র সমাধান। যদিও ব্যয়বহুল বলে এ ধরনের প্রজেক্ট নেওয়া যাবে না বলে অনেকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেবেন। কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশ বোঝেন এমন যে কোনো ব্যক্তিই এ প্রজেক্টকে সবচেয়ে উপযোগী বলে গ্রহণ করবেন। বর্ষা মৌসুমে জলের তোড়ে বা বাতাসের ফলে ঢেউয়ের আঘাতে রাস্তা ভাঙার আশঙ্কা নেই। বছর বছর মেরামতের ঝামেলা নেই বললেই চলে। বর্ষা ও শুকনো মৌসুমসহ সব মৌসুমেই সব সময় ব্যবহার করা যাবে। পানিপ্রবাহ ব্যাহত হবে না; ফলে জলাবদ্ধতা হবে না। কৃষি তথা ধান লাগানো, পরিচর্যা ও কাটার সময়ের মধ্যে সমস্যা হবে না। মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও প্রজনন মৌসুমের পরিবর্তন হবে না। মাৎস্য সম্পদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। এসব বিবেচনা করে হাওরের জন্য ফ্লাইওভারের মতো দীর্ঘ ব্রিজ হবে পরিবেশ উপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা।

    আমাদের হাওরে বন্যার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হাওরে প্রচলিত পদ্ধতিতে যেসব সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলোই হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যার কারণ। হাওর উন্নয়নের মহাপরিকল্পনাকে উপেক্ষা করে নির্মাণ করা এসব সড়কের কারণে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে পারছে না। দেখা দিচ্ছে বন্যা, স্থায়ী জলাবদ্ধতা। তাই বন্যা মোকাবেলার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী 'সাবমার্সিবল সড়ক' (পানিতে ডুবে যাওয়া সড়ক) অথবা উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব করেছে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর।

    ভিন্ন এক স্বপ্ন পূরণের কথা বলে লেখটি শেষ করছি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে রাস্তা নির্মাণের পরিমাণ বাড়ছে। হাওরবাসী যারা সারাজীবন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় বাহন হিসেবে ব্যবহার করতন নৌকা আর লঞ্চ। তারা এখন দেখবে এবার নৌকার পথে পাকা সড়ক ধরে কিভাবে বাস যায় হাওরে। দ্বীপের মত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে এবার যাতায়াতের মাধ্যম হবে লাক্সারী বাস। এবার আর ঘন্টার পর ঘন্টা মনে ভীতি নিয়ে বসে থাকতে হবে না নৌকা বা লঞ্চে, আর এভাবে সময় মতই হাওরবাসী পৌঁছতে পারবে যার যার গন্তব্যে। তবে স্বপ্ন এখানে স্থায়ী হয় না বেশি দিন। দুর্নীতি আর বরাদ্দ লুটপাটের দোলাচলে হাওরের পানিতে মিশে যায় হাওরবাসীর চোখের অশ্রু, ভেসে যায় পুটলি বাধা স্বপ্নগুলো অবিরাম...

    লেখক- তরুণ কলামিস্ট ও কবি।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close