• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

বানান সংস্কারে কবিগুরুর পত্রালাপ

প্রকাশ:  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৪৮
হাসান হামিদ

বানান নিয়ে আমাদের সতর্কতা যখন তলানিতে, ঠিক সেই সময়ে বানান বিষয়ক বেরসিক লেখাটি অনেকেরই বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠতে পারে। আর এই ঝুঁকি মাথায় রেখে ভালো লেখা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আজকে আমরা যে বানান সংস্কার নিয়ে এটা সেটা বলি, তার ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন বাঙলা বানান সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে, তখন অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘোষ যুক্তি-তর্ক দিয়ে মূলত: দুটি প্রাথমিক প্রশ্ন তুলছিলেন, সে-দুটি এযুগের সংস্কারের ক্ষেত্রেও অল্পবিস্তর প্রযোজ্য। এক হল, ভাষা চলমান, শব্দের উচ্চারণ সময়ের সঙ্গে পাল্টায়। তাই শুধু উচ্চারণ বা ফোনেটিক-এর ভিত্তিতে বানানের রূপ দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। দুই, বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের যে বন্ধন, সেটাকে ছিন্ন করে - তার রীতিনীতি উপেক্ষা করে বাংলা বানানের সংস্কার উচিত নয়। এ নিয়ে দেবপ্রসাদ শুধু রাজশেখর বসু বা সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিতদের নয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। নিঃসন্দেহে ওঁর অবস্থান ছিল রক্ষণশীল, কিন্তু ওঁর বক্তব্যবিষয় উপেক্ষণীয় ছিল না। তার্কিক হিসেবে দেবপ্রসাদের খ্যাতি ছিল।

প্রসঙ্গত, দেবপ্রসাদ ঘোষ ছিলেন গণিতজ্ঞ। গণিতশাস্ত্রে অনার্স পরীক্ষায় তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পাওয়া নম্বরের যে রেকর্ড ছিল, সেটিকে ভাঙ্গেন। তিনি আইন পরীক্ষাতেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীকালে দেবপ্রসাদ রিপন কলেজে পণিতের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে অনেক বছর কাজ করেছিলেন এবং বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির উপর জনপ্রিয় পাঠ্যবই রচনা করেছিলেন। ১৯৪১ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ হন এবং সেখান থেকে ১৯৫০ সলে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি শ্যামাপ্রসাদ প্রতিষ্ঠিত জনসংঘে যোগ দে ১৯৫২ সালে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। বেশ কয়েক বছর তিনি জনসংঘের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৫ সালে ৯১ বছর বয়সে ওঁর মৃত্যু হয়।

সম্পর্কিত খবর

    বাংলা বানান নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেবপ্রসাদ একাধিক চিঠি লিখেছিলেন। নীচে দেবপ্রসাদের লেখা প্রথম চিঠি ও রবীন্দ্রনাথের উত্তর দেওয়া হল। দুটি চিঠিই 'প্রবাসী'তে প্রকাশিত হয়েছিল। দেবপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তার একটা কপি 'প্রবাসী'-তে ছাপাবার জন্য পাঠিয়ে দেন। মনে হয় সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বানান-বিতর্কে নিজের অবস্থান সবাইকে জানানোর জন্যে দেবপ্রসাদকে যে উত্তর দিয়েছিলেন তার একটি নকল প্রবাসীতে পাঠান।

    (১) দেবপ্রসাদের চিঠি

    কলিকাতা

    ৮ ই জুন, ১৯৩৭

    শ্রদ্ধাস্পদেষু,

    আশাকরি সুদূর আলমোড়ায় গিয়া আপনি কিঞ্চিত বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করিয়া কতটা সুস্থ হইতে পারিয়াছেন,তাই আপনাকে একটু বিরক্ত করতে সাহসী হইয়াছি। আমি আপনার বিশেষ পরিচিত নহি।। সাক্ষাৎ পরিচয় মাত্র একবারই হইয়াছিল, বছর পাঁচেক পূর্ব্বে এক শ্রাবণ -প্রভাতে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ-গৃহে। শ্রদ্ধেয় রামানন্দবাবু আমাকে আপনার সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলেন। আমি গিয়াছিলাম স্বর্গীয় মনীষী বিপিনচন্দ্র পাল মহাশয়ের পরলোক গমনের এক স্মৃতিসভায় আপনাকে সভাপতি হইবার জন্যে অনুরোধ করিতে...

    যাহা হউক, যে বিষয় লইয়া আজ আপনাকে পত্রাঘাত করিতে সাহসী হইয়াছি, তাহাতে ব্যক্তিগত পরিচয়ের বিশেষ কোন অপেক্ষা রাখে না। ব্যাপারটা এই।

    বছর দেড়েক ধরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়-নিযুক্ত একটি কমিটি বাঙ্গালা বাণান-সংস্কারের ব্যাপারে লিপ্ত আছেন, তাহা অবশ্যই আপনি জানেন; কারণ, উক্ত কমিটির প্রকাশিত ভূমিকায় শ্যামাপ্রসাদবাবু লিখিয়াছেন যে, মূলত: আপনার অনুরোধেই এই প্রচেষ্টার উদ্ভব; এবং দ্বিতীয় সংস্করণের গোড়াতে আপনার ও শরৎ চাটুজ্জে মহাশয়ের সম্মপ্তি জ্ঞাপিত হইয়াছে। এখন এই বাণান সংস্কার প্রচেষ্টার ব্যাপারে আমি নিজেও কতকটা জড়িত হইয়া পড়িয়াছি। দেশে যখন এই বিষয় লইয়া বিশেষ কোনও আন্দোলন উপস্থিত হয় নাই – বস্তুত: যখন অতি অল্প লোকেরই মনোযোগ এ বিশয়ে আকৃষ্ট হইয়াছিল – এই সময়ে অর্থাৎ পূজাবকাশে রাঁচি বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিরূপে আমি এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করি; বিশেষত বাণান-কমিটির কতগুলো হাস্যাস্পদ প্রস্তাবের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বিদ্রূপের কশাঘাত করি। আমি বন্ধুবর প্রশান্তর* মারফৎ সেই অভিভাষণের এক কপি আপনার নিকট পাঠাইয়াছিলাম – কারণ আমার বিশেষ ইচ্ছে ছিল আমার কথা কয়টি আপনার গোচরে আনা।

    বাণান ছাড়াও, বর্তমান বাঙ্গলা সাহিত্যের ধারা, অশ্লীলতার ঢেউ প্রভৃতি, আরও অনেক জিনিষ আপনার নজরে আনা আমার অভিপ্রায় ছিল। আমি অবশ্য জানি না যে উহা পড়িবার আপনার অবকাশ হইয়াছিল কিনা। যাক্‌। পরে গত ফেব্রুয়ারী মাসে চন্দননগরে বঙ্গীয় সাহিত্যসম্মিলনে বাঙ্গলা বাণান আলোচনা বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। তাহাতে ঢাকার অধ্যাপক ডাক্তার শহীদুল্লা মহাশয় সভাপতি ছিলেন। সেখানে আমি এ বিষয়ে কিছু বিস্তৃত আলোচনা করি; বোধহয় তাহারই ফলে বাণান-কমিটির উদ্যোক্তারা আমাকে ও আরও দুইজন ভদ্রলোককে কমিটিতে যোগদান করিতে আহবান করেন। আহূত হইয়া আমি তথায় যাই; এবং গিয়া বাস্তবিকই রকম সকম দেখিয়া বিস্মিত হই।

    কমিটির পুস্তিকায় যে সব নূতন নূতন প্রস্তাব দেখা যায়, তাহা ছাড়াও দেখি যে বহু আজগুবি এবং অভাবনীয় প্রস্তাব একে একে উঠিতে থাকে। দুই একটা বলিলেই যথেষ্ট হইবে; যথা: “যে, যাহা, যেমন, অর্থাৎ ‘যদ্‌’-শব্দজ কথা ‘জ’ দিয়া লিখিতে হইবে;” “বাঙ্গালা শব্দ হইতে ঐ-কার, ঔ-কার বর্জ্জন করিতে হইবে,” ইত্যাদি। তখন আমি পরিষ্কার ব হাবে উঁহাদিগকে বলি, “বাঙ্গালা ভাষা লইয়া ছিনিমিনি খেলিবার অধিকার আপনাদিগকে কেহ দেয় নাই; ভাষার যে সব রূপ সুপ্রতিষ্ঠিত, তাহা সকলেরই মানিয়া লইতে হইবে; যে সব কথার রূপান্তর আছে, সে—সব স্থানে কোনও একটা রূপ নির্দেশ করা মন্দ নয়; আর সত্য বলিতে, বাঙ্গালা সাধুভাষায় গুরুতর কোনও বিশৃঙ্খলা নাই; আছে কথ্য ভাষায় (বা চল্‌তি ভাষায়), সেই বিষয়ের রূপ-নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আপনারা করুন।“ আর শ্যামাপ্রসাদ বাবুর নিকট শুনিয়াছি যে, এই চল্‌তি ভাষার রূপবাহুল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করিতেই আপনি বিশেষ করিয়া অনুরোধ করিয়াছিলেন।

    এই কথা বলিবার পর আমি স্থির করিলাম যে, শুধু সমালোচনা না করিয়া আমার নিজের এবিষয়ে কি বলার আছে, তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া কমিটির সমক্ষে উপস্থিত করিলে, বোধ হয় ভাল হয়; তাই একটি সংক্ষিপ্ত memorandum প্রস্তুত করিয় উঁহাদিগকে দিই। সেইটি জ্যৈষ্ঠ মাসের ‘প্রবাসী’-তে বাহির হইয়াছে – শুধু উপসংহারটি পরে জুড়িয়া দিয়াছি। আমি তাহারই এক কপি আপনার নিকট এতৎসঙ্গে পাঠাইলাম; যদি আপনি অবসরমত পড়িতে পারেন, তবে খুবই আনন্দিত হইব। কোন কোন বিষয়ে দেখিবেন যে, আপনি কোন কোন শব্দের যে রূপের ব্যবহারের চেষ্টা করিতেছেন তাহারও সমালোচনা আছে। আশা করি তাহাতে কিছু মনে করিবেন না; কারণ ভাষাসম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মতভেদ অনিবার্য।

    আমি বিশেষ করিয়া আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি রেফের পরে কোন কোন ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব-প্রয়োগের বিষয়ে। এ বিষয় আমি প্রবন্ধটিতে যে সব যুক্তির অবতারণা করিয়াছি তাহার পুনরাবৃত্তি এই পত্রে করিতে চাই না। কিন্তু এ বিষয়ে লইয়াই বাণান-কমিটি একটু বেশী মাত্রায় জিদ্‌ বা বাড়াবাড়ি করিতেছেন বলিয়া আমার ধারণা। আপনি বাণানের নববিধান মানিবার রাজী-নামা দস্তখত করিয়াও কেন নিজের লেখায় উহা পালন করিতেছেন না, এই অনুযোগকারী জনৈক পত্রলেখকের উত্তরে আপনি যে চিঠিখানি লিখিয়াছিলেন, তাহাও আমি একদিন ‘প্রবাসী’ অফিসে বসিয়া দেখিয়াছি এবং আপনার সুরসাল মন্তব্যটি – “নিয়ম পরিবর্ত্তন সহজ, অভ্যাস পরিবর্ত্তন সহজ নহে” – পড়িয়া খুবই উপভোগ করিয়াছি। কিন্তু এ বিষয়ে আপনার প্রতি আমার একটু অনুযোগ আছে। যে অভ্যাস কু-অভ্যাস নহে, তাহা যে খাম্‌খা পরিবর্ত্তন করিতেই হইবে – ইহা আপনি মানিয়া লইলেন কেন? আপনার এই apologetic attitude সম্বন্ধেই আমার অনুযোগ।

    বাস্তবিক পক্ষে, এ পর্য্যন্ত কোনই সঙ্গত কারণ কমিটি প্রদর্শন করিতে পারেন নাই – সুপ্রচলিত ব্যাকরণ-সম্মত রূপ কেন পরিবর্ত্তিত করিতে হইবে; বরঞ্চ তাহার বিরুদ্ধে যথেষ্ট যুক্তি দেওয়া যাইতে পারে এবং দেওয়া হইয়াছে। মোটামুটি সে যুক্তি এই যে, ভাষার রূপের চরম প্রামাণ্যই হইতেছে প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা। এমন কি এই প্রচলের খাতিরে অনেক অশুদ্ধ রূপও ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, তাহা এখন সরাইবার উপায় নাই, আবশ্যকতাও নাই – সুপ্রচলিত রূপ-পরিবর্ত্তনের প্রচেষ্টার ফলে আবার নানাবিধ রূপ প্রচলিত হইয়া বিশৃঙ্খলার কারণ হয়। এ বিষয়ে আমার প্রবন্ধে আমি যথেষ্ট বলিয়াছি; আপনি যদি পড়িয়া সুযোগমত এ বিষয়ে আপনার মতামত জানাইতে পারেন, তবে আমি অত্যন্ত উপকৃত হইব। একটা কথা বলি, আপনি আমার ধৃষ্টতা মাপ করিবেন, - বাণান-কমিটির নানাবিধ পরিবর্ত্তন প্রস্তাবগুলির পূর্ব্বাহ্নেই যে আপনি একখানি সহি দিয়া বসিয়াছেন, তাহা যেন একটু hasty বলিয়াই মনে হয়।

    পত্রখানি সুদীর্ঘ হইয়া পড়িল। আমি এখন শেষ করি। তবে শেষ করিবার পূর্ব্বে অন্য একটা বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই।আমার বড় ছেলেটি থার্ড ক্লাসে পড়ে; তাহার জন্যে একদিন আপনার “ছুটির পড়া” বইখানি কিনিয়া আনিয়া পৃষ্ঠা উল্টাতেই একটা অতি বিশ্রী ভুল চোখে পড়ায় আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হইলাম। “সূর্য্যকিরণের ঢেউ” প্রবন্ধে ৭৯ পৃষ্ঠায় লেখা আছে Wave Theory of Light-এর আবিষ্কর্তা “ডেন্মার্ক দেশের হিগেন্স নামক” পণ্ডিত। এত বড় প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিকের নামে ও ধামে এত বড় ভুল বাস্তবিকই বিস্ময়কর – উঁহার নাম হয়গেন্স (Huygens) এবং ধাম ডেন্মার্ক নয়ে, হল্যাণ্ড – বিখ্যাত ডাচ্‌ বৈজ্ঞানিক হয়গেন্স নিউটনের সময়াময়িক এবং প্রায় নিউটনেরই সমকক্ষ। দেখিলাম আপনার এই ছোট্ট বইখানি ১৩২৬ সনে প্রথম মুদ্রিত হয় – আজ ২৮ বছরের কথা – এবং তারপর ইহার বহু সংস্করণ হইয়া গিয়াছে; অথচ এরকম একটা মারাত্মক ভুল সমানে চলিয়া আসিতেছে, কেহ আপনার দৃষ্টি এ বিষয়ে আকৃষ্ট করে নাই, ইহা সত্যই আশ্চর্য্যের বিষয়।** আবার দেখা হইলেই প্রশান্ত ভায়ার উপর vote of censure আনিতে ত্রুটি করিব না।

    তাছাড়া, গত পৌষ মাসের ‘প্রবাসী’-তে বাঙ্গালা বাণান সম্বন্ধীয় আপনার ছোট্ট প্রবন্ধ বাহির হয়। সেই প্রবন্ধ আমি পড়ি মন্দালয়ে বসিয়া। বিগত বড়দিনের ছুটিতে বন্ধুবর সুনীতি চাটুয্যে মহাশয় ও আমি ব্রহ্মদেশে যাই বাঙ্গালীদের এক সাহিত্য সম্মিলন উপলক্ষ্য করিয়া। তার পর অবশ্য আমি কয়েকদিনের জন্যে গোটা বর্ম্মাদেশময়ই ছুটাছুটি করিয়া বেড়াই। যখন আমি মন্দালয়ে, তখন ঐ পত্রিকাখানি আমার হাতে পড়ে, এবং প্রবন্ধটি বাণানবিষয়ক ও আপনার নিজের লেখা – তাই তখনই উহা পড়িয়া ফেলি।

    উহার বক্তব্য বিষয় সম্বন্ধে এস্থলে কিছু লিখিতেছি না; কিন্তু একটা বিষয় আমার বড় আশ্চর্য্য লাগিল – যত বারই “মূর্দ্ধন্য” কথাটি ব্যবহৃত হইয়াছে (এবং বহুবারই ব্যবহৃত হইয়াছে) ততবারই ঐ শব্দটি “ণ” দিয়া লেখা হইয়াছে – অথচ “মুর্দ্ধ্বন্য” শব্দটির “ন”টি বস্তবিক “দন্ত্য ন”। আমি ইহা মুদ্রাকর--প্রমাদ ব্লিয়াই ঠিক করিয়াছিলাম, কিন্তু েই সেদিন আবার আপনার পুরাতন “শব্দতত্ত্ব” বইখানির উপভোগ্য প্রবন্ধগুলি পড়িতে পড়িতে পুনরায় সেই “ণ”-এর আবির্ভাব দেখিয়া আমার মনে খট্‌কা লাগিয়াছে, হয়ত বা আপনার নিজের মনেই এ বিষয় একটা ভুল ধারণা রহিয়া গিয়াছে।

    তারপর, কিছুদিন পূর্ব্বে কোন একখানি শিশুপাঠ্য মাসিক পত্রে আপনার লেখায় দেখি যে, ফরাসী “S’l vous plait”-কে বাঙ্গালাতে লিখিয়াছেন “সি ভূ প্লে”; কিন্তু বাস্তবিকই কি তাহাই উচ্চারণ? আমার ত ধারণা যে “il” শব্দের “l” silent-ও নয়, liquid-ও নয়, উহা সম্পূর্ণই উচ্চারিত হয় – সুতরাং “S’il” বাঙ্গালাতে “সিল্‌” হওয়াই উচিত। আমি ফরাসী মোটামুটি জানি; তবে কথাবার্ত্তায় ফরাসীতে বিশেষ অভ্যস্ত নহি, সুতরাং আমি এ বিশয়ে নিঃসন্দেহ নহি। বিষয়টিও সামান্য। তবে inaccuracy প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়াতে এটিও আপনাকে জানাইলাম, আপনি সহজেই এ বিষয় সন্দেহ দূর করিতে পারিবেন।

    আমার এই চিঠির শেষ ভাগে এই যে সামান্য কয়েকটি ভুলচুকের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলাম, আশাকরি আপনি ক্ষুণ্ণ হইবেন না। কারণ, অপর লক্ষ লক্ষ লোকের ন্যায় আমিও আপনার লেখার একজন নিয়মিত পাঠক ও শোধ্য পাঠক, এবং নামের সামের সহিত জড়িত কোন কোন লেখায় ভুল দেখিলে মনটা বড় ভাল লাগে না। সত্য বলিতে, এই জাতীয় ভুল বা inaccuracy আপনার লেখায় আমার চোখে বেশী পড়েও নাই। যাহা হউক, যদি এই পত্রে আমি কোন প্রকারে ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করিয়া থাকি, তবে সে অপরাধ নিজ গুণে মার্জ্জনা করিবেন, প্রণাম জানিবেন। ইতি নানাবিধ ভুল বা inaccuracy আপনার লেখায় আমার চোখে বেশী পড়েও নাই। যাহা হউক, যদি এই পত্রে আমি কোন প্রকারে ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করিয়া থাকি, তবে সে অপরাধ নিজ গুণে মার্জনা করিবেন, প্রণাম জানিবেন।

    ইতি প্রণত

    শ্রী দেবপ্রসাদ ঘোষ

    ----------------

    *প্রেসিডেন্সী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বিশ্বভারতীর ভূতপূর্ব সম্পাদক প্রশান্ত মহলানবিশ

    ** এই বইখানির হালের সংস্করণ (পৌষ, ১৩৫৫) হইতে বুঝিলাম যে হয়গেন্স সাহেবের কপালে আরও দুর্গতি লেখা ছিল – কারণ বিশ্বভারতীর কল্যাণে এবার তাঁহার নামরূপ দাঁড়াইয়াছে ‘ইয়েগেন্স’!

    বাংলা অক্ষর ব্যবহার করে বিদেশী নামের উচ্চারণ বোঝানো অনেক সময়েই অসম্ভব। কার কারো ধারণা সেটা সম্ভব। দেবপ্রসাদবাবু তাঁদের মধ্যেই পড়েন। Huygens-এর নামের ডাচ্‌ উচ্চারণ শুনতে এইখানে ক্লিক করুন। আমার কোনও ধারণা নেই এই উচ্চারণে হল্যাণ্ডের কোনও আঞ্চলিক প্রভাব আছে কিনা...

    (২) রবীন্দ্রনাথের উত্তর

    ওঁ

    বিনয়সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন –

    বানান সম্বন্ধে আপনার মন্তব্য পড়েছি । - প্রথমেই বলা আবশ্যক ব্যাকরণে আমি নিতান্তই কাঁচা, তার একটা প্রমাণ “মূর্দ্ধন্য” শব্দে আমার “ণ”-এর ব্যবহার। এ সম্বন্ধে নিয়ম জানা ছিল। কিন্তু বোধ হয় “ণ”কারের বাহনত্ব স্বীকার করাতে ঐ শব্দটা সম্বন্ধে

    বরাবর আমার মন প্রমাদগ্রস্থ হয়ে ছিল। বস্তুত শিক্ষার বনিয়াদের দোষেই এ রকম ঘটে থাকে – ব্যাকরণে আমার বনিয়াদ পাকা নয় এ কথা গোপন করতে গেলেও ধরা পড়বার আশঙ্কা আছে।

    বাংলা বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করবার জন্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলুম। তার কারণ এই, যে, প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার সাহিত্যে অবাধে প্রচলিত হয়ে চলেছে কিন্তু এর বানান সম্বন্ধে স্বেচ্ছাচার ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠ্‌চে দেখে চিন্তিত হয়েছিলুম। এ সম্বন্ধে আমার আচরণেও উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ পায় সে আমি জানি, এবং তার জন্যে আমি প্রশ্রয় দাবি করি নে। এ রকম অব্যবস্থা দূর করবার একমাত্র উপায় শিক্ষাবিভাগের প্রধান নিয়ন্তাদের হাতে বানান সম্পর্কে চরম শাসনের ভার সমর্পণ করা।

    বাংলা ভাষার উচ্চারণে তৎসম শব্দের মর্য্যাদা রক্ষা হয় বলে আমি জানি নে। কেবল মাত্র অক্ষরবিন্যাসেই তৎসমতার ভান করা হয় মাত্র, সেটা সহজ কাজ। বাংলা লেখার অক্ষর বানানের নির্জ্জীব বাহন – কিন্তু রসনা নির্জ্জীব নয় – অক্ষর যাই লিখুক, রসনা আপন সংস্কার মতোই উচ্চারণ করে। সেদিকে লক্ষ্য করে দেখলে বলতেই হবে যে, অক্ষরের দোহাই দিয়ে যাদের তৎসম খেতাব দিয়ে থাকি সে সকল শব্দের প্রায় ষোলো আনাই অপভ্রংশ। যদি প্রাচীন ব্যাকরণকর্ত্তাদের সাহস ও অধিকার আমার থাকত, এই ছদ্মবেশীদের উপাধি লোপ করে দিয়ে সত্য বানানে এদের স্বরূপ প্রকাশ করবার চেষ্টা করতে পারতুম। প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণের কেমাল পাশা হবার দুরাশা আমার নেই কিন্তু কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ। উক্ত পাশা এদেশেও দেহান্ত গ্রহণ করতে পারেন।

    এমন কি, যে সকল অবিসম্বাদিত তদ্ভব অনেকখানি তৎসম ঘেঁষা তাদের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে গেলেও পদে পদে গৃহবিচ্ছেদের আশঙ্কা আছে। এরা উচ্চারণে প্রাকৃত কিন্তু লেখনে সংস্কৃত আইনের দাবি করে। এ সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানসমিতি কতকটা পরিমাণে সাহস দেখিয়েছেন সে জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁদের মনেও ভয় ডর আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

    প্রাকৃত বাংলায় তদ্ভবশব্দ বিভাগে উচ্চারণের সম্পূর্ণ আনুগত্য যেন চলে এই আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যদি নিতান্তই সম্পূর্ণ সেই ভিত্তিতে বানানের প্রতিষ্ঠা নাও হয় তবু এমন একটা অনুশাসনের দরকার যাতে প্রাকৃত বাংলার লিখনে বানানের সাম্য সর্ব্বত্র রক্ষিত হতে পারে। সংস্কৃত এবং প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা ছাড়া সভ্য জগতের অন্য কোনো ভাষারই লিখনব্যবহারে বোধকরি উচ্চারণ ও বানানের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য নেই – কিন্তু নানা অসঙ্গতি দোষ থাকা সত্ত্বেও এ সম্বন্ধে একটা অমোঘ শাসন দাঁড়িয়ে গেছে। কাজ চালাবার পক্ষে সেটার দরকার আছে। বাংলা লেখনেও সেই কাজ চালাবার উপযুক্ত নির্দিষ্ট বিধির প্রয়োজন মানি; আমরা প্রত্যেকেই বিধানকর্ত্তা হয়ে উঠলে ব্যাপারটা প্রত্যেক ব্যক্তির ঘড়িকে তার স্বনিয়মিত সময় রাখবার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দেবার মত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সমিতির বিধানকর্ত্তা হবার মতো জোর আছে – এ ক্ষেত্রে যুক্তির জোরের চেয়ে সেই জোরেরই জোর বেশী এ কথা আমরা মানতে বাধ্য।

    রেফের পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ববর্জ্জন সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় যে নিয়ম নির্দ্ধারণ করে দিয়েছেন তা নিয়ে বেশী তর্ক করার দরকার আছে বলে মনে করিনে। যাঁরা নিয়মে স্বাক্ষর দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেক বড় বড় পণ্ডিতের নাম দেখেছি। আপনি যদি মনে করেন তাঁরা অন্যায় করেছেন তবুও তাঁদের পক্ষভুক্ত হওয়াই আমি নিরাপদ মনে করি। অন্তত তৎসম শব্দের ব্যবহারে তাঁদের নেতৃত্ব স্বীকার করতে কোনো ভয় নেই লজ্জাও নেই। শুনেছি “সৃজন” শব্দটা ব্যাকরণের বিধি অতিক্রম করেছে, কিন্তু যখন বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত কথাটা চালিয়েছেন তখন দায় তাঁরই, আমার কোনো ভাবনা নেই। অনেক পণ্ডিত “ইতিমধ্যে” কথাটা চালিয়ে এসেছেন, “ইতোমধ্যে” কথাটার ওকালতি উপলক্ষ্যে আইনের বই ঘাঁটবার প্রয়োজন দেখে নে – অর্থাৎ এখন ঐ “ইতিমধ্যে” শব্দটার ব্যবহার সম্বন্ধে দায়িত্ব বিচারের দি আমাদের হাত থেকে চলে গেছে।

    বিশ্ববিদ্যালয়বানান্সমিতিতে তৎসম শব্দসম্বন্ধে যাঁরা বিধান দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন, এ নিয়ে দ্বিধা করবার দায়িত্বভার থেকে তাঁরা আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এখন থেকে “কার্ত্তিক” “কর্ত্তা” প্রভৃতি দুই-ত-ওয়ালা শব্দ থেকে এক “ত” আমরা নিশ্চিন্ত মনে ছেদন করে নিতে পারি, সেটা সাংঘাতিক হবে না। হাতের লেখা ছাড়তে পারব বলে প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না, কিন্তু ছাপার অক্ষরে পারব। এখন থেকে “ভট্টাচার্য্য” শব্দের থেকে য-ফলা লোপ করতে নির্ব্বিকার চিত্তে নির্ম্মম হতে পারব কারন নব্য বানানবিধাতাদের মধ্যে দুজন ভট্টাচার্য্যবংশীয় তাঁদের উপাধিকে য-ফলা বঞ্চিত করতে সম্মতি দিয়েছেন। এখন থেকে আর্য্য এবং অনার্য্য উভয়েই অপক্ষপাতে য-ফলা মোচন করতে পারবেন, যেমন আধুনিক মাঞ্চু এবং চীনা উভয়েরই বেনী গেছে কাটা।

    তৎসম শব্দে আমি নমস্যদের নমস্য জানাব। কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপণ্ডিতদের অধিকারই প্রবল অতএব এখানে আমার মতো মানুষেরও কথা চলবে – কিছু কিছু চালাচ্চিও। যেখানে মতে মিলচি নে সেখানে নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানচি। কেননা অক্ষরকৃত অসত্যভাষণেরদ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানসমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম তা আমি বলব না – এমন কি হয় তো – থাক্‌ আর কাজ নেই। তা হোক্‌, উপায় নেই। আমি হয়তো একগুঁয়েমি করে কোনো কোনো বানান নিজের মত চালাবো। অবশেষে হার মান্‌তে হবে তাও জানি। কেননা শুধু যে তাঁরা আইন সৃষ্টি করেন তা নয় আইন মানাবার উপায়ও তাঁদের হাতে আছে। সেটা থাকাই ভালো, নইলে কথা বেড়ে আয়, কাজ বন্ধ থাকে। অতএব তাঁদেরই জয় হোক – আমি তো কেবল তর্কই করতে পারব তাঁরা পারবেন ব্যবস্থা করতে। মুদ্রাযন্ত্রণবিভাগে ও শিক্ষাবিভাগে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সেই ব্যবস্থার দৃঢ়তা নিতান্ত আবশ্যক।

    আমি এখন স্বপ্রদেশ থেকে দূরে এসে বিশ্রামচর্চার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত আছি। কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম্মের ফল সর্ব্বত্রই অনুসরণ করে। আমার যেটুকু কৈফিয়ত না দিয়ে নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু এই দুঃখ স্বীকার করলুম এর ফল কেবল একলা আপনাকে নিবেদন করে বিশ্রামের অপব্যয়টা অনেক পরিমাণেই অনর্থক হবে, অতএব পত্রখানি আমি প্রকাশ করতে পাঠালুম। কেননা বানানবিধি ব্যাপারে যাঁরা অসন্তুষ্ট তাঁরা আমাকে কতকটা পরিমাণ দায়ি করতে পারেন সে তাঁদের জানা আবশ্যক। আমি পণ্ডিত অই, অতএব বিধানে যেখানে পাণ্ডিত্য আছে সেখানে নম্রভাবেই অনুসরণের পথ গ্রহণ করব, যে অংশটা পাণ্ডিত্যবর্জ্জিত দেশে পড়ে সে অংশে যতটা শক্তি বাচালতা কর, কিন্তু নিশ্চিত জানব, যে একদা “অন্যে বাক্য কবে ,কিন্তু তুমি র’বে নিরুত্তর।“

    ইতি

    ভবদীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    ১২/৬/৩৭

    --------------------------

    দেবপ্রসাদ ঘোষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ বেশ কিছুদিন চলেছিল। বেশীর ভাগ পত্রেই দেবপ্রসাদবাবু বানান সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত রবীন্দ্রনাথকে জানাতেন এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যে বানানের ব্যাপারে অমনোযোগী নানান উদাহরণ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। বলাবাহুল্য, তাতে খোঁচাও বেশ কিছু থাকত। রবীন্দ্রনাথ বিনয় সহকারে সেই তির্যক মন্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝে প্রত্যাঘাত করতে ছাড়েন নি। বিশেষ করে এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ লিখেন...

    “বর্ণন” শব্দে আপনি যখন মূর্ধন্য ণ লাগান , তখন সেটাকে যে মেনে নিই সে আপনার খাতিরে নয়, সংস্কৃত শব্দের বানান প্রতিষ্ঠিত স্বে মহিম্নি – স্বমহিমায়। কিন্তু আপনি যখন “নানান” শব্দের মাঝখানটাতে মূর্দ্ধন্য ণ চড়িয়ে দেন তখন ওটা মানতে আমি বাধ্য নই। প্রথমত এই বানানে আপনার বিধানকর্তা আপনি নিজেই – দ্বিতীয়ত আপনি কখনো বলেন প্রচলিত বানান মেনে নেওয়াই ভালো আবার যখন দেখি মূর্ধন্য ণ-লোলুপ নয়া বাংলা বানানবিধিতে আপনার ব্যক্তিগত আসক্তিতে সমর্থনের বেলায় আপনি দীর্ঘকাল প্রচলিত বানানকে উপেক্ষা করে উক্ত শব্দের বুকের উপর নবাগত মূর্ধন্য ণয়ের জয়ধ্বজা তুলে দিয়েছেন তখন বুঝতে পারি নে আপনি কোন মতে চলেন।

    জানি না “কানপুর” শব্দের কানের উপরে আপনার ব্যবহার নব্যমতে না পুরাতন মতে। আমি এই সহজ কথাটা বুঝি যে প্রাকৃত বাংলায় মূর্ধন্য ণয়ের স্থান কোথাও নেই, নির্জীব ও নিরর্থক অক্ষরের সাহায্যে ঐ অক্ষর বহুল আমদানি করে আপনাদের পাণ্ডিত্য কাকে সন্তুষ্ট করচে বোপদেবকে না কাত্যায়নকে...।

    রবীন্দ্রনাথের এই পত্রের উত্তরে ক্ষান্ত না হয়ে দেবপ্রসাদবাবু যে পত্রটি রচনা করেন সেটা প্রায় একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকার আকার নেয়। রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে লেখেন...

    স্বাস্থ্যের এবং সময়ের অভাববশত আপনার সঙ্গে বাংলা বানান নিয়ে দীর্ঘ তর্কবিতর্ক আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। আপনার হাতের অক্ষরও আমি অনভ্যস্ত এ কারণেও পত্রযোগে এই আলোচনায় আমার স্বল্প অবকাশকে পীড়িত করতে আমি নিরস্ত হলুম। এখনো আপনার এবারকার সুদীর্ঘ পত্র পড়তে আমি সাহস করি নি, কোনো এক সময়ে সুযোগ হলে পরে চেষ্টা করব। কিন্তু আমার পক্ষে এ নিয়ে উত্তর-প্রত্যুত্তর অনাবশ্যক, কেন না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই বানান নির্দ্দেশের ভার স্বয়ং গ্রহণ করেছেন।

    ইতি

    ভবদীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    ২১শে শ্রাবণ, ১২৪৪

    এর উত্তরে দেবপ্রসাদবাবু লেখেন...

    কলিকাতা

    ২৩শে শ্রাবণ, ১৩৪৪

    শ্রদ্ধাস্পদেষু,

    এইমাত্র আপনার ছোট্ট চিঠিখানি পাইলাম। বাস্তবিকই আমার হস্তাক্ষর একেবারেই দেবাক্ষর - আমার আগের চিঠিগুলি আপনি কষ্ট করিয়া পড়িলেন কেমন করিয়া তাহা ভাবিয়া আশ্চর্য্য হই। এবারকার চিঠিখানি - অথবা চিঠির অছিলায় দীর্ঘ রচনাখানি - হস্তাক্ষরে পড়িবার কষ্টস্বীকার করিবার আপনার দরকার নাই; আমি উহা 'মাসিক বসুমতী'তে হাপিতে দিয়াছি, ছাপা হইবামাত্র আপনাকে এক কপি আমি পাঠাইয়া দিব, আপনি অবসর মত পড়িলি আমি অনুগৃহীত হইব......।

    আপনি যেএই আলোচনায় আমাকে অনুগ্রহ করিয়া আহবান করিয়াছিলেন, তজ্জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ...।

    এই চিঠির উত্তর রবীন্দ্রনাথ দেননি।

    (সূত্রঃ বাঙ্গালা ভাষা ও বাণান - দেবপ্রসাদ ঘোষ)

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close