আমাদের সংস্কৃতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য
সৃষ্টির যদি সেরা সৃষ্টি হয় মানুষ তবে মানুষের সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি হলো ভাষা। মানুষ তার ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলে আর আমরা সেই কথাকে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করি। তাকে নানা ধরনের কথামালায় অলঙ্কিত করি। যে কথা বলতে জানেনা সেও কিন্তু আকার-ইঙ্গিতে নানা ধরনের ইশারায় তার মনের ভাবকে প্রকাশ করে তার নিজের ভাষায়। স্বাবলম্বী বা প্রতিবন্ধী যে নামেই আখ্যায়িত করিনা প্রত্যেকেরই তাই মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভুমিকা পালন করেছে এই ভাষাই।
সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে এবং সময়ের বিভিন্ন ধারাবাহিকতায় মানুষ বিভাজিত হয়ে পড়েছে নানা জাতি-গোষ্ঠিতে, সেইসাথে জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ভাষার বহুত্ববাদ বাস্তবে জন্ম দিয়েছে ভাষা বৈচিত্রের। ভাষার এই বৈচিত্র পৃথিবীকে করেছে অনেক বেশী ঐশ্বর্য্যমন্ডিত। প্রত্যেকেই চায় সারা পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য্যকে তিল তিল করে এনে মাতৃভাষায় তাকে তিলোত্তমা করে তুলতে। কিন্তু আধিপত্যবাদের ভয়াল থাবা থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মাতৃভাষা তথা ভাষাবৈচিত্রেরও যেন আজ রেহাই নেই। আর তাই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা আজ হুমকীর মুখোমুখি।
সম্পর্কিত খবর
‘এটলাস অব দি ওয়ার্ল্ডস ল্যাঙ্গুয়েজেস ইন ডেন্জার অব ডিসএপিয়ারিং’ নামক ভাষা বিষয়ক বিশ্বকোষ থেকে জানা যায় বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ছয় হাজার আটশত নয়টি ভাষার অস্তিত্ব আছে - যে সব ভাষায় কিছু না কিছু মানুষ কথা বলে। কিন্তু আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সেইসব ভাষা কমপক্ষে অর্ধেক হয়ে যাবে, নয়তো অস্তিত্বের সংকটে পৌছাবে। ইউনেস্কোর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০৯৯ সালের মধ্যেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে প্রায় তিনহাজার ভাষা। অর্থাৎ চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই সব সংস্কৃতি।
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী মাইকেল ক্রাউসের মতে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ ভাষাই মরে যাবে। এখন যে ভাষাগুলোকে কার্যকর বলে ধারনা করা হয় তার মধ্যে ২০-৮০ শতাংশই আসলে মৃত। এসব ভাষায় কথা বলে এমন মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দ্রুত। খুব শিগগীরই তাতে কথা বলে এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। ৩৫৭টি ভাষা রয়েছে যাতে কথা বলে এমন লোকের সংখ্যা মাত্র ৫০। ৪৬টি ভাষা আছে যাতে করে কথা বলে মোটে একজন করে মানুষ। তারা মরে গেলে ভাষাও মরে যাবে। বর্তমানে প্রচলিত এই ভাষাগুলো তার প্রতিটিই কোনো না কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা। আর প্রতিটি জনগোষ্ঠির কাছে তার মাতৃভাষা প্রবল ভাবাবেগ আর ভালবাসার সমার্থক ধ্বনি। কবির ভাষায় ‘যারে যেই ভাষায় করিলে সৃজন, সেই ভাষা তার অমূল্য ধন।’ সেই অমূল্য ধন হারাতে বসেছে বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষ।
এতকিছুর পরও সারা পৃথিবীকে উদ্দীপ্ত করার ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশেই। মাতৃভাষাকে ঘিরে আমাদের যে আবেগ আর ভালবাসা তার তীব্রতার কারণেই বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে। একুশের চেতনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ইউনেস্কো এদিন অমর একুশকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এই স্বীকৃতি নিজের ভাষার জন্য বাঙ্গালী জাতির সাহসিকতার স্বীকৃতি। বাঙালী জাতি এর মধ্য দিয়ে মাতৃভাষায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াকু মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বুকে বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে।
ইউনেস্কো সারা বিশ্বের সব ভাষাভাষি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বেছে নিয়েছে এমন একটি দিন। এই দিনটি নিজ নিজ মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানানোর, ভালবাসার আর সবকিছু উজার করে মাতৃভাষা রক্ষা করার এক অফুরন্ত প্রেরণার নাম। আর ভাষা প্রশ্নে এ স্বীকৃতির সত্যিকার মানে হলো পৃথিবীর সব মাতৃভাষাগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অতি জরুরী। বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের ভাষা স্বকীয়তা এবং বৈচিত্রতাকে ধ্বংশ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর এই উপলক্ষ্যতো আমরাই তৈরি করেছি। কিন্তু এতকিছুর পরও আমরা কি আমাদের গৌরবগাঁথাকে ম্লান করে দিচ্ছিনা ? সংখ্যালঘুর ভাষার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা থেকে কি আমরা সরে আসতে পেরেছি ?
একথা ভুলে গেলে চলবেনা যে বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষা আর বহু জাতির সম্মিলনে বাংলাদেশ একটি জাতি-বৈচিত্রের দেশ। এদেশের পাহাড় থেকে সমতলে প্রায় ৪৫টি জাতিগোষ্ঠির বসবাস। সংখ্যায় এদের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ লাখ। নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ধারক এসব জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, ভাওয়াল মধুপুর গড় অঞ্চল, গারো পাহাড় ও বরেন্দ্রভুমি অঞ্চলে তাদের নিজস্ব জীবনধারা নিয়ে বসবাস করছে। পৃথিবীর আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার দিকে পিঠ ফিরিয়ে তাঁরা এখনো প্রাচীন যুগের আচার-বিধি, রীতি-নীতি-প্রথাকে সযত্নে ধরে রেখেছে।
প্রকৃতির সুশীতল ছায়ায় সহজ সরল জীবন যাপন তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতিপ্রেমী এইসব মানুষের জীবনের সাথে তাই মিশে আছে বন-জঙ্গল আর পাহাড়-পর্বত। অথচ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্টির অবন্ধুসুলভ আচরণ শুধু নয়, আগ্রাসী মনোভাবে আজ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হওয়ার পথে। এতদিন তারা জল, জমি ও জঙ্গলের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছেন, এখন তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিশেষ করে তারা এই স্বাধীন দেশে পরাধীন জাতির মতো মাতৃভাষায় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে। একসময় ভাষার অধিকার বঞ্চিত বাঙালীরাই যদি আজ অন্য ভাষার প্রতি আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কি হতে পারে।
একথা ভুলে গেলে চলবেনা যে বিশ্বের প্রতিটি শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার একটি জন্মগত অধিকার। জন্মের পর একটি মানুষের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, তেমনি তার নিজের ভাষায় শিক্ষা লাভেরও অধিকার আছে। কিন্তু দেশের আদিবাসীসহ অপরাপর জাতিগুলোর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের বিষয় নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দশকের কার্যক্রমের একটি বিশেষ বিষয় হলো শিক্ষা। আইএলও কনভেনশন ১০৭-এ আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং এ কনভেনশন বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করেছে। পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তিতে পাহাড়ি শিশুদের জন্য অন্তত পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় পড়াশোনার কথা বলা হয়েছিল। আবার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সার্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন মাতৃভাষা চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বিভিন্ন জরীপ ও পরিসংখ্যান রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শুধু প্রথম শ্রেণী থেকেই শতকরা অন্তত ৩০ জন শিশু স্কুল ছেড়ে চলে যায়। অর্থাৎ স্কুলত্যাগী এই ঝরে পড়ার হার প্রমাণ করে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠের বিষয়বস্তু ও পাঠদান পদ্ধতি আমাদের দেশের শিশুর মন মানসিকতাকে আকর্ষণ করতে পারছেনা। কাজেই মাতৃভাষা ও স্বীয় সংস্কৃতি ব্যতীত শিক্ষা নিতে গিয়ে অধিকাংশ আদিবাসী শিশুর অবস্থা কতটা শোচনীয় তা সহজেই অনুমেয়। এসব শিশুদের বাংলা ভাষার মাধ্যমেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু করতে হয়।
ফলে মাতৃভাষার সাথে তারতম্যের কারণে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাগ্রহণে যে সব সমস্যার সৃষ্টি হয় তা প্রাথমিক জ্ঞানের হেরফেরের কারণে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিস্তার লাভ করে। কেননা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষায় ভাষাগত দূর্বলতার কারণে শিক্ষাটি দূর্বলভাবে গড়ে ওঠে। অথচ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করলে শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার বিষয়বস্তু আরো সহজে বোধগম্য হবে। এতে শিক্ষার্থীর সহজাত বুদ্ধি, মৌলিক চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ সহজতর হবে।
এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, শুধুমাত্র প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে এসমস্ত শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করলে চলবেনা। আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠিভূক্ত ভাষাসমূহকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ভাষায় অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসী জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত এলাকার অফিস আদালতে, কোর্টকাচারীতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহে, সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচর্যা কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে হলেও এই ভাষাকে কার্যকরী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। তাহলেই কেবল আদিবাসী ভাষা শিক্ষার প্রসার ঘটবে। তাদের মধ্যে সমনাগরিকত্ব বোধ গড়ে উঠবে, রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে তখন তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে উৎসাহিত হবে।
একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে একুশের সত্যিকারের চেতনাকে শাণিত করার সময় এসেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা বাঙালীর সংস্কৃৃতি আত্মকেন্দ্রিকতাকে প্রশ্রয় দেয়না। বহুজাতি, বহুভাষি ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় গৌরবগাঁথা। আমরা সেই উজ্জল গৌরবগাঁথাকে অপমানিত করতে পারিনা। রাষ্ট্রের ক্ষমতাধারীরা সবসময়ই বাংলাদেশের ভিন্ন ভাষাভাষি নাগরিকদের উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু তার দায়ভার কিন্তু আমরাও এড়িয়ে যেতে পারিনা। অতীতের শিক্ষা থেকে দেশপ্রেমিক বিবেকবান মানুষকে এখনই সোচ্চার হতে হবে।
আমরা সবাই মিলে আমাদের জাতিবৈচিত্রতাকে সুন্দর আলোকিত এক সকালের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারি। আর এর মাধ্যমে কেবল মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নয়, বরং জাতি হিসেবেও আমরা সম্মানিত হতে পারি। গৌরবোজ্জল ও মহিমান্বিত করে তুলতে পারি বাঙ্গালী সংস্কৃতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। একুশ শতকে এসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক