• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

দিতে পারো এক শ’ ফানুস এনে

প্রকাশ:  ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ০২:২৩ | আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:৪৮
মাজহারুল ইসলাম

[ নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ৭০তম জন্মবার্ষিকী ১৩ নভেম্বর ২০১৮। জীবদ্দশায় এই কিংবদন্তি লেখকের জন্মদিন পালনের খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছেন তার সিংহভাগ বইয়ের প্রকাশক অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী ]

দুপুরবেলা মেঝেতে বসে কাচ্চিবিরিয়ানি খাচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে দেশি মুরগির রোস্ট। ফ্লোরে এবং টেবিল-চেয়ারে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও অনেকে তাঁর সঙ্গে খেতে বসেছেন। কেউ কেউ প্লেটে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। ঘরভর্তি মানুষ। স্বর্ণা সবার খাওয়াদাওয়া দেখাশোনা করছে।

১৩ নভেম্বর ২০০৯। আজ হুমায়ূন আহমেদের ৬১তম জন্মদিন। দিনের প্রথম প্রহরে রাত বারোটা এক মিনিটে ‘দখিন হাওয়া’য় মা আয়েশা ফয়েজ, স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, পুত্র নিষাদ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কেক কেটেছেন তিনি। স্বজন, বন্ধু ও ভক্তরা ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন তাদের প্রিয় মানুষটিকে। টিভি চ্যানেলগুলো গত রাত এগারোটার পর থেকে দখিন হাওয়া’য় আসতে শুরু করেছে। কেউ কেউ তাদের চ্যানেলের পক্ষ থেকে কেক ও ফুলও এনেছেন।

সকাল ১১টায় পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকদের আয়োজনে জন্মদিন উপলক্ষে একক বইমেলার উদ্বোধন করেন তাঁর মা। নতুন বই কাঠপেন্সিল ও রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় এ উপলক্ষে। হুমায়ূন আহমেদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বইমেলার উদ্বোধন শেষে দখিন হাওয়া’য় চলে এসেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ জন্মদিনটা কাটাতে চাইতেন পরিবার ও বন্ধুদের একান্ত সান্নিধ্যে, ঘরোয়া পরিবেশে। নিজেকে ‘গর্তজীবী’ বলতেন, জন্মদিনেও সেই ‘গর্ত’ থেকে বেরুতে অনীহা তাঁর। ঘটা করে জন্মদিন পালনের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তাঁর ৬০তম জন্মদিনের আগে আমি প্রস্তাব করলাম, যেহেতু ৬০তম জন্মদিন, একটি বিশেষ উপলক্ষ, তাই আমরা অন্যদিন-অন্যপ্রকাশ এর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা পালন করতে চাই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এ প্রস্তাবে কোনোভাবেই রাজি হচ্ছেন না। অনেক চেষ্টার পর শেষে তিনি রাজি হলেন, কিন্তু নানা শর্ত—বেশি হইচই করা যাবে না। হুমায়ূন আহমেদের সম্মতি পেয়ে আমি যারপরনাই খুশি। আমার মনে পড়ল তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী আয়োজিত হয়েছিল লেডিস ক্লাবে, প্রকাশকদের যৌথ উদ্যোগে। একদিন পর তাঁকে জানালাম পরিকল্পনাটায় একটু ভিন্নতা আনতে চাই। অন্যদিন-অন্যপ্রকাশের পক্ষ থেকে এককভাবে এ আয়োজন না করে বরং তাঁর বইয়ের সকল প্রকাশক সম্মিলিতভাবে এই আয়োজনে যুক্ত হলে কেমন হয় ? তিনি বললেন, খুব ভালো প্রস্তাব। আমি তাঁর সকল প্রকাশককে আমন্ত্রণ জানালাম আমার অফিসে। তাঁরা এলেন, আলোচনা হলো এই বিষয়ে। সকলে আমার প্রস্তাবে একমত হলেন। ঠিক করা হলো, ৬০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে পাবলিক লাইব্রেরিতে। এ উপলক্ষে দশ দিনব্যাপী হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের একক মেলা অনুষ্ঠিত হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে সকালে পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ বইমেলার উদ্বোধন করেন। ওখানকার বড় হলে বিকেলে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি প্রদর্শিত হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় জন্মদিনের মূল আয়োজন। হলভর্তি হুমায়ূন-অনুরাগী। ছিলেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। সকলে এসেছেন প্রিয় লেখককে শুভেচ্ছা জানাতে। একপর্যায়ে শওকত ওসমান মিলনায়তনের বিশাল স্টেজ ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে গেল। এই আয়োজনে মোড়ক উন্মোচিত হলো তিনটি গ্রন্থের—হুমায়ূন ষাট, রচনাবলী প্রথম ও দ্বিতীয় খ-। আয়োজনের শেষ পর্বে সংগীত পরিবেশন করলেন সুবীর নন্দী, এস আই টুটুল, সেলিম চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন। সে রাতে ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে নৈশভোজ করলেন হুমায়ূন আহমেদ।

এবার প্রেক্ষাপট খানিকটা অন্যরকম। বড় কোনো আয়োজন নয়। মা আয়েশা ফয়েজের ইচ্ছায় বেশ কিছু আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে আনা হয়েছে। এরমধ্যে নানা বাড়ি মোহনগঞ্জ থেকে মামা, খালা, ফুপা এবং তাদের কারও কারও ছেলেমেয়েরাও এসেছেন। জন্মের পর মা দুই বছর অসুস্থ থাকায় হুমায়ূন আহমেদের নানি তাকে ও ছোট খালাকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। সেই ছোট খালা রিজিয়া বেগমও এসেছেন। পৈতৃক বাড়ি কেন্দুয়ার কুতুবপুর থেকেও এসেছেন কেউ কেউ। হুমায়ূন আহমেদের দুইবোন ও তাদের পুত্র-কন্যারাও উপস্থিত। চাচাত মামাত ভাইবোনরাও অনেকে আছেন। আমন্ত্রিতরা সবাই এখন দখিন হাওয়া’য়। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই নুহাশপল্লী রওনা হবেন। আমার ফ্ল্যাটে দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদ নিজের খাওয়া শেষ করে অন্যদের তাড়া দিচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছে সন্ধ্যার আগেই নুহাশপল্লী পৌঁছানো। এখনো ভক্তরা অনেকে ফুল নিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগে আসাদুজ্জামান নূর এসেছেন বন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। শ্বশুর মোহাম্মদ আলী ও শাশুড়ি তহুরা আলীও এসেছেন। একসাথে নুহাশপল্লী যাবেন। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাদের খাওয়াদাওয়া তদারক করছেন।

দখিন হাওয়া’র গেটের সামনে একটা মিনিবাস অপেক্ষা করছে। অনেক মানুষ হওয়ায় বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ একবার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও সবার সঙ্গে বাসে করে নুহাশপল্লী যাবেন। পরে অবশ্য সবাই নিষেধ করায় সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। বিকেল চারটায় একটি বাস ও কয়েকটি গাড়ি ভর্তি করে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে নুহাশপল্লী রওনা হলেন তিনি। রাতে সেখানে হবে জন্মদিনের প্রধান উৎসব।

নুহাশপল্লীর মাটির তৈরি সীমানাপ্রাচীরে দুই ফুট পর পর বিশেষ ধরনের প্রকোষ্ঠে মোমবাতি লাগানোর ব্যবস্থা করা আছে। সন্ধ্যার পর সেখানে কয়েকশত মোমবাতি জ্বালানো হলো। সুইমিং পুল থেকে শুরু করে বৃষ্টিবিলাস পর্যন্ত পায়ে চলার পথের দুই পাশ দিয়ে মোমবাতি জ্বলছে। অতিথিশালার সামনে বারবিকিউয়ের আয়োজন করা হয়েছে। নুহাশপল্লীর সব আয়োজন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের। তিনি নিজে বারবিকিউ করে মেহমানদের খাওয়াবেন। ঢাকার বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির থেকে চারটি ফানুস আনা হয়েছে। ফানুসের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক। ফানুস ওড়ানোর দুইজন বিশেষজ্ঞও এসেছেন ঢাকা থেকে। কারণ এটা ওড়ানোর বিশেষ কিছু কায়দাকানুন আছে।

রাতে ফানুস ওড়ানো হবে। মাঠের মধ্যে ফানুস ওড়ানোর আয়োজন চলছে। গজারি কাঠ দিয়ে ক্যাম্পফায়ারের মতো করে আগুন জ্বালানো হলো। হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে ডাকলেন ফানুস ওড়ানো দেখতে। একে একে আগুনের চারপাশে গোল করে সাজিয়ে রাখা চেয়ারগুলো ভর্তি হয়ে গেল। ফানুস এনে ধরা হলো জ্বলন্ত আগুনের উপর। ফানুসের নিচে কুপি বাতির মতো সলতে লাগানো। কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর সেখানে আগুন দেওয়া হলো। আস্তে আস্তে ফানুস উপরে উঠে যাচ্ছে। সাদা কাগজ দিয়ে বানানো গোলাকার ফানুসটির ভেতরে আগুন জ্বলছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে মাথা উঁচু করে উপরের দিকে তাকিয়ে ফানুস দেখছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকটা উপরে উঠে গেল। আস্তে আস্তে ফানুসটির আকার ছোট হয়ে আসছে। হুমায়ূন আহমেদের মুগ্ধতা দেখার মতো। মনে পড়ে গেল তাঁর লেখা প্রথম কবিতার দুটি লাইন।

‘দিতে পার একশ’ ফানুস এনে

আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।’

এভাবে পরপর তিনটি ফানুস আকাশে ওড়ানো হলো। প্রতিবারই সে কী মুগ্ধতা হুমায়ূন আহমেদের চোখেমুখে! অনেক ওপরে উঠে যাওয়ার পর মনে হলো তিনটি নক্ষত্র আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। বড়দের সাথে শিশুরাও অসম্ভব আনন্দ পেল।

কেন্দুয়া থেকে ইসলাম উদ্দীন বয়াতির দলকে আগেই খবর দিয়ে আনা হয়েছিল নুহাশপল্লীতে। শুরু হলো গানের আসর। বয়াতির দল নেচে নেচে একের পর এক গান গাচ্ছে। তাদের ঘিরে বসে আছেন অতিথিরা। লন্ডন প্রবাসী লেখক সালেহা চৌধুরীও এসেছেন। আয়েশা ফয়েজ আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে বসা। তাঁর চোখেমুখে ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। ছেলের জন্মদিনের এসব আয়োজন দেখানোর জন্য তার আগ্রহেই নেত্রকোনার কেন্দুয়া আর মোহনপুর থেকে আত্মীয়স্বজনদের আনা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ পেছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ গান শুনছিলেন। এবার তিনি সামনে এসে মজার মজার কিছু গল্প বললেন। সবাই মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। আমার মা’ও সেখানে উপস্থিত। মাঝে মাঝে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। আবার শুরু হলো গান-বাজনা। এর মধ্যে বারবিকিউ শুরু হয়ে গেছে। শাওন ভাবি নিজে বারবিকিউ করছেন। তাঁকে সহযোগিতা করছেন নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুল। একপর্যায়ে গানের দলের সাথে নাচতে শুরু করলেন স্থপতি ফজলুল করিম ও বন্ধু কমল। ইসলাম উদ্দীন বয়াতির পর গান শুরু করল নুহাশপল্লীর কর্মী মোশাররফ ও তার দল। তাদের নিজেদের লেখা ও সুর দেওয়া একটি গান হুমায়ূন আহমেদের খুব পছন্দ। নুহাশপল্লীর বিভিন্ন আয়োজনে গানটি পরিবেশন করা হয়।

হুমায়ূন স্যারের রেলগাড়িটা প্রেমের ইস্টিশনে

ইস্টিশনে গাড়ি, ইস্টিশনে।

নুহাশেতে আসলেন যারা, প্রেমের সালাম দেই তাদের

ইস্টিশনে গাড়ি, ইস্টিশনে

হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে নিয়ে গান শুনছেন। মাঝে মাঝে স্ত্রীর কর্মকাণ্ড দেখার জন্য তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এর মধ্যে ঢাকা থেকে অভিনেতা জাহিদ হাসান এলেন। জন্মদিনের উপহার হিসেবে এনেছেন আস্ত খাসির রোস্ট। হুমায়ূন আহমেদ দেখে খুবই আনন্দ পেলেন। মা আয়েশা ফয়েজকে ডেকে দেখালেন, আম্মা দেখেন জাহিদ কী করেছে! লেজার ভিশনের দুই কর্মকর্তা কেক ও ফুল এনেছেন। নুহাশ চলচ্চিত্রের কর্মীরাও একটি কেক এনেছেন। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ কেক দুটো কাটলেন। সবাইকে মাঠের মাঝ বরাবর আসতে বললেন তিনি। আরও একটি ফানুস ওড়ানো হলো। এটি রেখে দেওয়া হয়েছিল দেরিতে আসা অতিথিদের জন্য। চারটি ফানুস আকাশে উড়ছে কোনো মঙ্গল বারতা নিয়ে। বারবিকিউ-র গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কেউ কেউ ঢাকা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাসিমুখে হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে বিদায় জানাচ্ছেন।

লেখক: স্বত্বাধিকার, অন্যপ্রকাশ/ সম্পাদক, পাক্ষিক অন্যদিন

হুমায়ূন আহমেদ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close