নারায়ণগঞ্জে তিন যুবক হত্যাকাণ্ডে রহস্য
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রাজধানীর তিন ব্যবসায়ী যুবককে গুলি করে হত্যা নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে।
শুক্রবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টার দিকে উপজেলার পূর্বাচল উপ-শহরের আলমপুর এলাকার তিনশ’ ফুট সড়কের ১১ নং ব্রিজের নীচ থেকে পুলিশ ওই তিনজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে।
সম্পর্কিত খবর
নিহতদের স্বজনদের দাবি, তারা কেউ রাজনীতি বা কোন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন না। ডিবি পুলিশের পরিচয়ে গত বুধবার তিনজনকে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে একই সাথে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিলেন।
তবে পুলিশ বলছেন, কারা এবং কি উদ্দেশ্যে তাদেরকে হত্যা করেছে সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে। নিহতদের একজনের প্যান্টের পকেট থেকে ৬৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও তাদের কারো বিরুদ্ধে কোন মামলা আছে কিনা সেটিও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি। এ অবস্থায় পুলিশ ও স্বজনদের বক্তব্য অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এটি আইন শৃংখলা বাহিনীর কাজ নাকি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড, বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের দানা বাঁধছে।
নিহতরা হলেন- রাজধানীর মহাখালী এলাকার শহীদুল্লাহ্র ছেলে স্যাটেলাইট ক্যাবল নেটওয়ার্ক ব্যবসায়ী মো: সোহাগ (৩২), মুগদা এলাকার মো: আব্দুল মান্নানের ছেলে ঝুট ব্যবসায়ী শিমুল (৩১) ও তার ভায়রা একই এলাকার আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার ছেলে ঝুট ব্যবসায়ী নুর হোসেন বাবু (৩০)।
স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে পূর্বাচল উপ-শহরের ৯নং সেক্টরের আলমপুর এলাকায় তিনশ’ ফুট সড়কের ১১নং ব্রীজের নীচে গুলিবিদ্ধ তিন যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখে আশপাশ থেকে শত শত লোক এসে ঘটনাস্থলে ভীড় জমান। তবে নিহত তিনজনেরই শার্ট ও জিনস প্যান্ট ছেঁড়া অবস্থায় দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে খবর পেয়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। দুপুরে ফেসবুকের পোস্ট দেখে খবর পেয়ে নিহতের স্বজনরা থানায় এসে লাশ শনাক্ত করেন। এসময় তিন পরিবারের স্বজনদের আহাজারিতে রূপগঞ্জ থানায় থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
নিহত তিন যুবকের স্বজনদের দাবি, তিন বন্ধু মিলে যশোর বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে গত বুধবার তিনজন একটি যাত্রীবাহী বাসে করে ঢাকা ফিরছিলেন। রাজবাড়ি জেলার দৌলদিয়া ঘাট এলাকায় বাসটি আসার পর সেখান থেকে তাদেরকে ডিবি পুলিশের পরিচয়ে একই সাথে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
নিহত সোহাগের ভাই শাওন জানান, রাত দশটার দিকে দৌলদিয়া ঘাট এলাকায় লাল ও সাদা রঙের দুইটি হাইয়েস গাড়ি এসে বাসটির গতিরোধ করে। এরপর ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বেশ কয়েকজন লোক বাসে উঠে পড়েন এবং নাম ধরে তিনজনকে ডেকে বাস থেকে বের করে আনেন। পরে ওই লোকগুলো তিনজনকে দুই হাইয়েস গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। ওই বাসের সুপারভাইজার তাদের ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানান। পরে গত দুইদিন তারা ডিবি অফিস, র্যাব অফিস ও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে তিনজনের কোন সন্ধান পাননি।
নিহত সোহাগের স্ত্রী ফারজানা আক্তার দুলু জানান, তার স্বামী কোন ধরণের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। তিনি দীর্ঘদিন যাবত এই এলাকায় ডিস ক্যাবল অপারেটরের ব্যবসা করছেন। কারো সাথে কোন শত্রুতাও ছিল না। কেন তাকে হত্যা করা হলো তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
নিহত শিমুলের স্ত্রী আয়েশা আক্তার আন্নার দাবি, তার স্বামী ও মামাতো বোনের স্বামী নূর হোসেন বাবু একই সাথে ঝুট ব্যবসা করতো। বন্ধুর মতো তারা চলাফেরা করতো। কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ বা শত্রুতা ছিল না। কোন আইনবিরোধী কাজের সাথে তাদের কোন সম্পৃক্তা ছিল না। তবে কি কারণে আইন শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হলো প্রশাসনের কাছে তার জবাব চান।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতের যে কোনো সময় কে বা কারা ওই তিন যুবককে গুলি করে হত্যার পর সেখানে ফেলে রেখে যায়। তিনটি লাশেরই মাথা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাদের একজনের পকেটে ৬০ পিস ইয়াবা এবং আরেকজনের পকেটে একটি মানিব্যাগ পাওয়া গেছে। তবে, কারা বা কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সে বিষয়ে কোন ধারণা করা যাচ্ছে না। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রূপগঞ্জ থানার পুলিশ এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা হয়ে থাকলে আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদেরকে অবহিত করা হতো। বিষয়টি এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। একজনের পকেটে ইয়াবা পাওয়া গেলেও তারা মাদক ব্যবসায়ী কিনা সেটাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে কোর মামলা আছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত মামলার ব্যাপারে নিশ্চিত হইনি। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ ব্যাপারে তদন্ত স্বাপেক্ষে মামলার প্রক্রিয়া চলবে বলে জানান তিনি।
শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় তিনটি লাশ তাদের পরিবারের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ময়নাতদন্তের ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর এম ও) মো: আসাদুজ্জামান জানান, তিনজনের শরীরে বেশ কয়েকটি করে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আলামত পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
/পি.এস