• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

প্রধানমন্ত্রী দাবি মেনেছেন, ঘরে ফিরে যাও

ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেবে না

প্রকাশ:  ০৬ আগস্ট ২০১৮, ০১:০০
পীর হাবিবুর রহমান

বেপরোয়া বাসচালকদের সড়ক হত্যার শিকার কলেজছাত্রী রাজিব ও মিমের রক্তাক্ত নিথর দেহ সামনে নিয়ে কিশোর-কিশোরীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথ উত্তাল করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’ স্লোগানে স্লোগানে যে অভূতপূর্ব বিস্ময়কর আন্দোলন গড়ে তুলেছে গোটা দেশবাসী তাতে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ ছাত্রছাত্রীদের এমন আন্দোলন অতীতে কখনো কেউ দেখেনি। সরকার থেকে শুরু করে সব মহল তাদের দাবিকে যৌক্তিক বলে সংহতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়েছে। আকাশছোঁয়া এই কিশোর বিপ্লবের অর্জন এতটাই সাফল্যের উচ্চতায় উঠেছিল যে স্মার্ট ফোন ও ফাস্টফুড জেনারেশনকে নিয়ে মানুষের সব হতাশা কেটে গিয়ে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল। সবাই বলছিলেন, এরাই আগামীর বাংলাদেশ। তারা স্লোগান তুলেছিল— ‘যদি তুমি ভয় পাও তবেই তুমি শেষ, যদি তুমি ঘুরে দাঁড়াও তবেই তুমি বাংলাদেশ’। এই অমিত সাহস ও শক্তির সংগঠিত উচ্চারণ প্রতিবাদ স্লোগান এবং দাবি ও কাজ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে। রাষ্ট্র যেখানে উদাসীন ছিল, প্রশাসন যেখানে ব্যর্থ ছিল সমাজ যেখানে দায়িত্বহীন ছিল, আইন যেখানে উপেক্ষিত হয়েছিল সেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সবার বিবেককে জাগ্রত করে দিয়েছে। রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, আইনের রক্ষক থেকে সমাজপতি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী দেশ চলতে হবে। লাইসেন্সবিহীন মন্ত্রীর সরকারি গাড়িচালককে তারা যেতে দেয়নি। লাইসেন্সহীন বিচারক থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের গাড়ি আটকিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র চলবে।

৪৭ বছর ধরে পরিবহন খাত থেকে সব খাতে যে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছিল তা জনসম্মুখে এনে মানুষের চেতনাকে জাগিয়েছে। ঘুমন্ত একটি দেশকে জাগিয়ে বলেছে— ‘রাস্তা বন্ধ রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। কিশোর-কিশোরীদের গায়ে স্কুল ড্রেস পীঠে ব্যাগ নিয়ে আন্দোলন ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে। সরকারও তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সব দাবি মেনে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে সব মহল এবার তাদের লেখাপড়ার টেবিলে ফিরে যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এই আন্দোলনের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রেখে আইনের সংশোধন করতে যাচ্ছেন। পরিবহন সংস্কার আইনটি আজ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হবে। সংসদের এই অধিবেশনে পাস হবে। প্রধানমন্ত্রী রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজকে পাঁচটি বাস উপহার দিয়েছেন। নিহতদের পরিবারকে কাছে ডেকে গভীর সমবেদনা ও আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। আর কারও বুক যাতে খালি না হয় ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিষিদ্ধ করেছেন। আন্ডারপাস, জেব্রা ক্রসিং, স্পিডব্রেকার নির্মাণসহ সব দাবি বাস্তবায়নে সময় চেয়েছেন। এই কাজগুলোর জন্য সময় দরকার। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজপথে পড়ে থাকার সুযোগ নেই। বিজয়ীর বেশে ঘরে যাওয়ার সময় আগেই কড়া নাড়ছিল। দেশবাসীর বুকভরা স্বপ্ন যেখানে আকাশ স্পর্শ করেছিল সেখানে ঘরে ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ঘিরে রাজনীতির কুিসত কালো ছায়ার প্রভাব পড়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছায়া এখন সবার মাঝে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম গড়তে যেখানে ব্যর্থ, রাজনৈতিক ব্যর্থতার গ্লানিতে নিমজ্জিত সেখানে শিক্ষার্থীদের চলমান অরাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পথে ঠেলে দেওয়ার পথে পা বাড়িয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিতেও তারুণ্য রাজপথ উত্তাল করেছিল। সেখানেও বিএনপি শীর্ষ নেতাদের উসকানিমূলক টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হওয়ায়, বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তি ও ছাত্রশিবির যুক্ত হয়েছে এই অভিযোগের পাশাপাশি ভিসির বাসভবনে দুর্বৃত্তদের ভয়াবহ হামলা তাণ্ডব সরকারকে দমননীতির পথে ঠেলে দেয়। এতে আন্দোলন যেমন স্তব্ধ হয় তেমনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা নানা নির্যাতন ভোগ করে।

শনিবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্কুল-কলেজ ইউনিফর্ম পরে দলীয় কর্মীদের যুক্ত হয়ে যাওয়ার নির্দেশনাসহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হওয়ায়, সরকারের মন্ত্রী আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ভর করতে চায় বলে যে অভিযোগ আনছিলেন তার সত্যতা মিলে যায়। সরকার এখন কঠোর অবস্থানেই যাচ্ছে। শনিবার একদল দুর্বৃত্ত ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে, গুলি করেছে। পুলিশ বাধ্য হয়ে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ঘিরে চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের পোশাক পরে ছাত্রশিবিরও মাঠে নেমেছে। নানামুখী ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধাতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাপকহারে নিহত ও ধর্ষণের মিথ্যা খবর ভাইরাল করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে চারদিকে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। গুজব সৃষ্টিকারীরাও কেউ কেউ ধরা পড়েছে। সে রাতেই সুজনের বদিউল আলম মজুমদারের বাসভবনে বিদায়ী নৈশভোজে যোগ দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পথে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন ঘিরে নানামুখী তৎপরতা শুরু হওয়ায় অজানা আশঙ্কা বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, গণমাধ্যমেও খবর এসেছে, স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম ও আইডি কার্ড বিক্রি হঠাৎ বেড়েছে। সব মিলিয়ে গোটা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও নাজুক করার একটি ঘৃণ্য তৎপরতা শুরু হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রশিবিরই হোক আর ছাত্রলীগ-যুবলীগই হোক যারাই হামলা করুক না কেন সব সন্ত্রাসী, অছাত্রদের পুলিশ গ্রেফতার করুক। স্কুল ছাত্রছাত্রীদেরও সচেতন থেকে তাদের ভিড়ে আশ্রয় নেওয়া অছাত্র বহিরাগতদের ধরিয়ে দেওয়া উচিত। চলমান আন্দোলন ঘিরে নিরাপত্তার অজুহাতে বাস মালিক ও শ্রমিকরা অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেছে। সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়ায় জনদুর্ভোগ চরমে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। সুবিধাবাদী ও মুনাফালোভীরাও তৎপর। জনগণকে কষ্ট দেওয়া জনসমর্থিত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকারীদের দায়িত্ব নয়। অতীতে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত সহিংস হরতাল-অবরোধ, পেট্রলবোমা, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের মুখোমুখি করেছিল দেশ। মানুষের জানমাল নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পড়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। সেই দৃশ্য বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে রাজনীতির কুিসত দাবার চাল, সংঘাত সহিংসতার জন্ম নিক এটি কারও কাম্য নয়। এই আন্দোলন ঘিরে লাশের রাজনীতির জন্ম দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি হোক এটাও কারও কাম্য নয়। এসব অশুভ চিন্তা থেকে উদ্বিগ্ন মানুষ চাইছে শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের ঘরে ফিরে যাক। ফিরে যাক লেখাপড়ার টেবিলে। গোটা রাজনৈতিক শক্তি ও সামাজিক শক্তি বা সুশীলরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে এক পরিবহন খাতের চরম নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে যে আকাশছোঁয়া অর্জনের সফল আন্দোলন দেখিয়েছে সেখান থেকে সব নাগরিক ক্ষমতাবান থেকে ক্ষমতাহীন, বিত্তবান থেকে নিতান্ত গরিব সব মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন। শিক্ষার্থীরা পোস্টারে চমৎকার সব স্লোগান লিখে মানুষের হৃদয় কেড়েছিল। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু একদল বর্ণচোরা সুবিধাবাদী সেই পোস্টার হাতে দাঁড়ানো ছাত্রছাত্রীদের ছবিকে ফটোশপ করে নোংরা অশ্লীল শব্দে ভাইরাল করেছে। চেয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে। শ্রমিকদের মুখোমুখি করে দিতেও চেষ্টা হয়েছে। বাস মালিক ও শ্রমিকদের সন্তানরাও শিক্ষার্থী। নিহত দিয়ার বাবাও একজন বাসচালক বা পরিবহন শ্রমিক। আন্দোলনটা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, কোনো পেশার মানুষের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো নয়, বিদ্যমান অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। কঠোর আইন প্রণয়নের দাবিতে। ঘাতক চালকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে। মানুষের জন্য নিরাপদ সড়ক ও নিরাপদ জীবনের। আইন বিধিবিধান লঙ্ঘন করে দাপটের সঙ্গে চলাফেরার বিরুদ্ধে। সংবিধান আইন ও বিধিবিধানের প্রতি সব পেশার সব নাগরিকের নত হয়ে দায়িত্ব পালনের। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাতে তারা ইতিহাস গড়েছে। এই কিশোর বিপ্লব ইতিহাসে অমরত্ব পাবে। এখন চূড়ান্ত সময় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মা-বাবার আদরের ধন শিক্ষার্থীদের সরকারকে দাবি বাস্তবায়নে সময় দিয়ে লেখাপড়ার টেবিলে, কলেজ-স্কুলে চলে যাওয়ার। রাজপথে পড়ে থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা না দেওয়ার। আর সরকারের ওপর পবিত্র দায়িত্ব এই শিক্ষার্থীদের মেনে নেওয়া সব ন্যায্য দাবি একে একে বাস্তবায়ন। এ নিয়ে কোনো ছলচাতুরীর আশ্রয় না নেওয়া। সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের কাছে নিবেদন, সরকারের বিরুদ্ধে যত পারেন গণআন্দোলন গড়ে তুলে গণঅভ্যুত্থান করে ফেলুন। কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীদের কোমল মন ও আবেগ নিয়ে দলীয় স্বার্থে খেলতে আসবেন না। ছেলেমেয়েরা মা-বাবার অনেক আদর ও স্বপ্নের ধন। দেশ ও জাতির সম্পদ। তাদের এই নির্মোহ আন্দোলন নিয়ে কেউ আগুন খেলা খেলবেন না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

পীর হাবিবুর রহমান,সড়ক আন্দোলন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close