• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

এক মহাজীবনের স্মৃতিচারণ

প্রকাশ:  ১৯ জুলাই ২০১৮, ০১:৪৯ | আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৮, ০৫:২৮
বিপুল হাসান

প্রায় দেড় যুগ হয়ে গেল সাংবাদিকতা করছি। এই দীর্ঘ সময়ে হাতেগোনা যে কয়েকটি মহাজীবনের সংস্পর্শ পেয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ। নিজেকে সবসময় সৌভাগ্যবান মনে করি যে, হুমায়ুন স্যার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, পছন্দও করতেন। তার একাধিক আড্ডার আসরে হাজির থাকার অভিজ্ঞতা এইজীবনের অমূল্য সম্পদ।

সময় কিভাবে যে চলে যায়, সময়ের নিয়মেই হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়ার ছয় বছর পেরিয়ে গেল। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে (১৯ জুলাই) ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি মারা যান। মাত্র ৬৪ বছর আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা ক্ষণজন্মা এই মনীষির আজ মৃত্যুবাষিকী। হুমায়ূন স্যারের প্রতি সঙ্গে কাটানো কিছু দুর্লভ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করছি।

ঠিক কবে কখন হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন বইটি পড়েছিলাম মনে নেই। মনে আছে, বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে বসে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখার কিছু টুকরো স্মৃতি। ১৫ দিন পর পর ধারাবাহিকটির একেকটি পর্ব প্রচার হতো। যেদিন বিটিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখানো হবে, সেদিন আমাদের পরিবারে আগে থেকেই শুরু হতো প্রস্তুতি। খুব সম্ভবত রাত ৯টায় দেখানো হতো ধারাবাহিকটি। আগে ভাগেই সেদিন রাতের খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ করে আমাদের ৬ সদস্যের পরিবারের সবাই বসতাম টিভি সেটের সামনে। মনে পড়ে নাটকটির টুনি চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনাটি। মা-বাবা দুজনের চোখেই দেখেছিলাম জল।

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছি। হঠাৎ কানে ভেসে উঠলো ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। বইখাতা আর বাবার চোখ রাঙানি ভুলে দে ছুট। বিশাল মিছিল। মিছিলে লোকজন কেবল বাড়ছে। সবার সঙ্গে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দিলাম ‘বাকের ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’।

তারপর কতো নাটক আর কতো উপন্যাস। কলেজ জীবনে পরিচয় হলো হিমুর সঙ্গে। ইচ্ছে হলো, আমিও হিমু হই। ওমা শুধু কী, আমি সহপাঠী অনেকের মধ্যেও দেখলাম হিমুর প্রচন্ড প্রভাব।

পড়াশোনা শেষ করে প্রথম চাকরি নিলাম একটি এনজিওতে। কাজ হলো সিভিল সোসাইটিকে সংগঠিত করা। সাহিত্য চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা আর সুকুমার বৃত্তিকে প্রণোদিত করাই হলো কাজ। আমাদের টিমের নের্তৃত্বে ছিলেন, স্বনামধন্য কয়েকজন বুদ্ধিজীবি। সাহিত্য চর্চার আলোচনা উঠতেই তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকে। চাকরি ক্ষেত্র কাজেই প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল না। একদিন একটি কাজে হুমায়ূন বিরোধী একজন বুদ্ধিজীবির বাসায় যেতে হয়। ড্রয়িংরুমে ঢোকে দেখি তার বইয়ের আলমারি। তাতে সারি সারি সাজানো বই। অবাক হলাম, সেখানে হুমায়ূন আহমেদের লেখা বহু বই দেখে।

এরপর কেটে গেছে অনেকদিন। এরই মাঝে পেশা পরিবর্তন করে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হই। মানবজমিন পত্রিকার চাকরি ছেড়ে অন্যদিন পত্রিকায় কাজ শুরু করি । অন্যদিন পত্রিকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশ, যেখান থেকে হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ে হুমায়ূনের তৃতীয় ছবি ‘দুই দুয়ারী’ নিয়ে একটি কভার স্টোরি তৈরির। সেটা ছিল ১৯৯৯ সাল। প্রথম সুযোগ হয় হুমায়ূন আহমেদের মুখোমুখি হওয়ার।

প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারে কেবল ‘দুই দুয়ারী’ আর নাটক-চলচ্চিত্র প্রসঙ্গেই কথাবার্তা হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমি মুগ্ধ। যথাসময়ে কভার স্টোরি বের হলো। সময় এলো ‘দুই দুয়ারী’ মুক্তির। ছবি মুক্তির ঠিক আগের দিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের রুমে আমার ডাক পড়লো। ভিতরে ঢুকে দেখি বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনিই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললেন, তোমার লেখা কাভার স্টোরি আমার পছন্দ হয়েছে। কাল তো ছবি মুক্তি পাচ্ছে। তুমি এতো সুন্দর একটা লেখা তৈরি করলে, ছবি মুক্তি পাবে আর তুমি দেখবে না তা হয় না। পকেট থেকে দুইটা টিকিট বের করে দিলেন। মধুমতি সিনেমা হলের টিকিট।

বললেন, বিয়ে করেছো?

- জ্বি না করি নি।

- প্রেম করো?

- আসলে সেইভাবে …

- এই বয়সে প্রেম না করলে আর কবে করবে? একটা টিকিট তোমার জন্য আরেকটি টিকিট তোমার প্রিয় কারো জন্য।

এই হলো হুমায়ূন আহমেদ। এর অনেকদিন পর হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সাক্ষাৎকার নিতে তার দখিন হাওয়ার বাসায় যাই। অ্যাপয়েনমেন্ট করা ছিল শাওনের সঙ্গে । ড্রয়িং রুমে বসে আছি। হুমায়ূন আহমেদ এলেন।

আমি জানতে চাইলাম, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তুমি কী আমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নিতে আসছো?

- জ্বি না স্যার… এমনিই…

- তোমার নাম বিপুল হাসান। বিপুল মানে বিশাল। পৃথিবীতে এসেছো, নামকরণে স্বার্থকতা প্রমাণ করে যাবে ঠিক আছে?

কি আশ্চর্য, মাত্র একবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর থেকেই আমার মতো অভাজনকে তিনি মনে রেখেছিলেন। এরপর কতোবার চাকরি বদল... অন্যদিন, ভোরের কাগজ, অানন্দ আলো, বাংলানিউজ...। হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে কিংবা তার সৃষ্টি নিয়ে স্টোরি করার জন্য সময় চাইলে তিনি কখনো বিমূখ করেননি... এমন কি জানতেও চাননি কোন পত্রিকার জন্য কাজটি করছি।

এমনও হয়েছে ধানমন্ডির দখিন হওয়া কিংবা গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীতে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেছি। কিন্তু হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আড্ডায় বসে তার সম্মোহনী কথপোকথনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভুলে গেছি কী কাজে সেখানে যাওয়া! ।

একবার গেলাম নুহাশ পল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদ তখন সবে মাত্র ওষুধি গাছপালা চাষাবাদ শুরু করেছেন। দেখলাম গাছপালা নিয়ে তার ভীষণ উৎসাহ। আমাদের নিয়ে গেলেন তার সেই বাগানে।

- এটা হলো উলট কম্বল। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এ গাছের ডালপালা বেটে রস দিয়ে শরবত খেলে মুহূর্তেই মামলা খালাস।

- জ্বি স্যার।

- এখন পর্যন্ত ১৩৪টি গাছ লতাপাতা সংগ্রহ করেছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কোনো বাগানে একসঙ্গে এতে ওষধি গাছপালা নেই।

হঠাৎ স্যার বলে ওঠলেন, 'মানুষের চেয়ে গাছ অনেক বেশি ভাগ্যবান!' মনে মনে বলি, এ কেমন কথা? গাছরা বেশি ভাগ্যবান হয় কী করে?

ব্যাখ্যা দিলেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। বললেন, এটা টের পাবে প্রতি বসন্তে। দেখো বছর বছর বসন্ত আসে। কৃষ্ণচুড়া লালফুলে ছেয়ে যায়, আমগাছে মুকুল আসে, গাছে গাছে নতুন করে কচিপাতা গজায়। এর মানে বসন্ত এলে বৃক্ষরা ফিরে পায় নতুন যৌবন। প্রতি বসন্তেই গাছপালা যৌবন ফিরে পায়। কিন্তু দূর্ভাগ্য, মানুষের জীবন থেকে একবার যৌবন চলে গেলে আর ফিরে আসে না।'

সেদিন স্যারের এ কথা শোনার পর অ্যাসাইনমেন্টের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে আক্ষেপ. বৃথাই এ মানবজীবন। কেনো বৃক্ষ হয়ে পৃথিবীতে এলাম না।

নুহাশপল্লীতেই আরেকবার হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এক আড্ডায় বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এমন এক যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি যে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতে হয়। বিশাল তার জ্ঞানের পরিধি। এটা সেটা নানা বিষয়ে কথাবার্তার পর উঠলো ধর্মবিষয়ক কথাবার্তা। একপর্যায়ে স্যারের কাছে আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা স্যার ভালো কাজ করে বেহেশতে গেলে তো পুরুষরা ৭০জন হুর পাবে। নারীদের ক্ষেত্রে কী হবে?

হুমায়ূন স্যার প্রথমেই কোরআন শরীফের একটা আয়াত পড়লেন। অবাক হলাম, কোরআনের আয়াত তার মুখস্ত দেখে। তারপর তিনি ব্যাখ্যায় এলেন।

স্যার বললেন, পুনরুত্থানের পর তোমার স্বত্তা কী হবে, তা কী তুমি বলতে পারো? বেহেশতে যাওয়ার পর নারী বা পুরুষ স্বত্তা তুমি নাও পেতে পারো। ফেরেশতারা নারী না পুরুষ? তারা যেমন কোনো লিঙ্গের নয়। তোমার পরিণতিও তো তাই হতে পারে। আর হুররাও যে নারী বা পুরুষ হবে, তা নিশ্চিত হও কী করে।

শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার মধ্যে তখন তীব্র সংঘাত। দুইনেত্রীর মধ্যে ঐক্য তৈরির জন্য নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সে সময় হুমায়ূন স্যারের এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনাকে যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বলা হয় তাহলে কী করবেন?

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমি দুই নেত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে বলবো, আপনারা এক ঘন্টার জন্য আমাকে সময় দেন। আমার নুহাশ পল্লীতে আপনারা একবার এসে এককাপ চা খান। তারপর জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখেন। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। আমি নিশ্চিত এই অল্পসময়েই দুই নেত্রীর মধ্যে ভাব হয়ে যাবে। কারণ তারা দুজনেই খুব ভালো মানুষ। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের দুই পরিবারেরই অবদান আছে। দুজনই দেশকে ভালোবাসেন। কিছু সময়ের জন্য তারা একসঙ্গে হলেই তাদের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যাবে। দুজন মিলে তখন দেশ গড়ার উদ্যোগ নেবে। তখন আর আমাদের দেশকে ঠেকায় কে। দেখবে ধেই ধেই করে বাংলাদেশ কোথায় চলে যাবে।

অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ হুমায়ূন আহমেদ শুয়ে আছেন নুহাশ পল্লীতে লিচু গাছের নিচে মাটির বিছানায়। কিন্তু তার সংস্পর্শ পাওয়ার মুহূর্তগুলো এখনও ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভাসে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটনিউজ

হুমায়ূন আহমেদ,একজন হুমায়ূন,হুমায়ূন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close