• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

সব ডাক্তার ডাক্তার নয়, সব শিক্ষক শিক্ষক নয়

প্রকাশ:  ১১ জুলাই ২০১৮, ০০:২৭
পীর হাবিবুর রহমান

আমরা নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করি। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থে-বিত্তে, শিক্ষায় এবং যোগাযোগ ও প্রযুক্তি ব্যবস্থায় সাদা-কালো যুগের অবসান ঘটিয়ে রঙিন সময়ে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের মুখে নিজেদের অগ্রসর সমাজের নাগরিক বলে ভাবতে গৌরববোধ করি। আমাদের পূর্বপুরুষদের সেকেলে মনে করি। ফ্যাশনে-পোশাকে, শিক্ষায় ও রুচিতে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে নিজেদের যতই উন্নত ও সভ্য সমাজের বাসিন্দা বলে দাবি করি না কেন, কার্যত পূর্বপুরুষদের চেয়ে সরলতায়, মানবিকতায়, মূল্যবোধ ও আদর্শিক জীবনব্যবস্থায় উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা দূরে থাক মূলত লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাসের নীতিহীন অমানবিক ও অস্থির-অশান্ত সময়ে ডুবছি। নষ্ট হতে হতে শেষ তলানিতে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সুনামগঞ্জ শহরে আমরা যখন আট ভাইবোন জন্ম নিয়েছিলাম, তখন বিস্তীর্ণ হাওর, নদী, স্রোতস্বিনী খালবেষ্টিত মেঘালয়ের কোলে শুয়ে থাকা এ শহরটিকে পর্যটকরা ভিলেজ টাউন বলে পরিচিত করেছিলেন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রশ্নের সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রান্তিক শহরটি অনেক পিছিয়ে ছিল। ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমরা আট ভাইবোন মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম দাইমার হাতে। কোনো ডাক্তার বা হাসপাতালে সন্তান জন্মদান সেই সময় ছিল চিন্তার অতীত। চিকিৎসকের কাছে সন্তানসম্ভবা মায়ের নিয়মিত চেকআপ, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, বিশ্রাম ছিল কল্পনার বাইরে। বিরাট সংসারের হাল ধরে সব পারিবারিক কাজ দুই হাতে সামলে যাবতীয় সামাজিকতা, অতিথি আপ্যায়ন সেরে আজকের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে রীতিমতো অনাদর-অবহেলায় মায়েরা আমাদের জন্ম দিয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। বিষয়টি ভাবলে মায়ের প্রতি গভীর মমতায় কান্না উঠে আসে। তারপর একে একে এতগুলো সন্তানকে স্নেহ-মমতায় বড় করার অসাধ্য সাধন করে গেছেন হাসিমুখে-মহানন্দে। একালে ভাবলে পুরো বিষয়টা অবিশ্বাস্য লাগে। কিন্তু সেই সময় পরিবার, সমাজ এক কথায় মানুষের মধ্যে সততা, সরলতা, বিশ্বাস-আস্থা ও ভালোবাসার নির্মল বন্ধন ছিল গভীর। মহান আল্লাহর অসীম করুণা ছিল বলেই সেকালে যা ঘটেছে একালে তা ভাবতেই পারি না।

সম্পর্কিত খবর

    এখন সমাজ বদলেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সচেতনতার ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামের একজন সন্তানসম্ভবা নারীও কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। প্রসব বেদনা উঠলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। দাইমার জায়গায় নার্সেরা যুক্ত হয়েছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়েও প্রয়োজনে সিজারিয়ান শিশু জন্ম নিচ্ছে। পরিবার ছোট রাখার তাগিদও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অনুভব করছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় সরকারি হাসপাতালের বাইরেও আধুনিক হাসপাতালে একালের সন্তানসম্ভবা মায়েরা সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে আধুনিক ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা গ্রহণে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা কার্পণ্য করছেন না।

    মনে হয়, কিছুদিন আগেও দেশের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা খাত এতটা অগ্রসর ছিল না। উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাতে গোনা সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল একমাত্র অবলম্বন। এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ অনেক জন্ম নিয়েছে। কিন্তু এসবের শিক্ষার মান ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মনিটরিং ব্যবস্থা, অনিয়মে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা না থাকায় নৈরাজ্য চলছে। সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি আর বেসরকারি হাসপাতালে চলছে মুনাফা লুটের মহোৎসব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ঢাকার বাইরে থাকতেই চান না! অথচ তাদের প্রতি মানুষের কত ভরসা, ভালোবাসা।

    আমাদের ছেলেবেলায় যারা মেধা তালিকায় স্থান লাভ করতেন তারা পরিবারেই নয়, সমাজে সোনার সন্তান হিসেবে সবার ভালোবাসায় অভিষিক্ত হতেন। যারা সবচেয়ে মেধাবী তাদের বড় অংশ ডাক্তার হওয়ার উচ্চাভিলাষই নয়, আদর্শিক মানবিক বোধ থেকে মেডিকেল কলেজে পড়তে যেতেন। কেউ বা যেতেন বুয়েট বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাকিরা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির লড়াই করতেন। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শিক্ষক, কেউ আমলা, উকিল বা রাজনীতিবিদ হওয়ার মহান স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জীবনটাকে মূল্যবোধ ও আদর্শিক চেতনা থেকে লেখাপড়ার পাঠ শেষ করতেন। যিনি ডাক্তার হতেন, ইঞ্জিনিয়ার হতেন, শিক্ষক হতেন বা ছাত্রনেতা হয়ে নিজেকে উদ্ভাসিত করতেন, তিনি নিজেই সম্মানিত হতেন না, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সমাজকেও আলোকিত করতেন। তখন দেশ অর্থনীতিতে এতটা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেনি। মাথাপিছু আয় বাড়েনি। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হয়নি। প্রযুক্তির ছোঁয়া পায়নি। দেশ-বিদেশ ভ্রমণের বা দুনিয়াকে কাছ থেকে জানার বা দেখার এত সুযোগ মানুষের জীবনে আসেনি। কিন্তু মানুষের সততা, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শক্তি ছিল প্রবল। সমাজে রাতারাতি যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা ও বিত্তবৈভব গড়ার এমন আগ্রাসী চেহারা দেখা যায়নি। সমাজ-সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটে যাওয়া একালে এসে সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও আদর্শিক কমিটমেন্ট নির্বাসিত হতে বসেছে। রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, আইন ব্যবসা থেকে সাংবাদিকতার মতো মহান জগৎ বাণিজ্যিকীকরণের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্যের কাছে পেশাদারিত্বের অহংকার বলি হয়েছে। মূল্যবোধ নির্বাসনে পাঠিয়ে ত্যাগের মানবিক পথ ছেড়ে ভোগবাদী, নীতিহীন অমানবিক পথে হাঁটছে অনেকে। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে শোষণ-বৈষম্য-ভেদাভেদই বাড়েনি, অসততা, হৃদয়হীনতা, ছলচাতুরী ও মানুষ ঠকানোর সর্বগ্রাসী রূপ সমাজকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। গোটা সমাজকে শনির রাহু গ্রাস করে নিচ্ছে।

    চট্টগ্রামে সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার রুবেল খানের আড়াই বছরের চাঁদের মতো ফুটফুটে কন্যাশিশু রাইফাকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করেছিলেন বাণিজ্যিক চাকচিক্যময় বেসরকারি হাসপাতাল ম্যাক্সে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেখেন এর ভিতরটা অন্তঃসারশূন্য। হাইডোজ অ্যান্টিবায়োটিকে বাচ্চা মেয়েটির শারীরিক অবনতি ঘটলে তার বাবা চিকিৎসকদের দৃষ্টিতে এনেছিলেন। চিকিৎসকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিধান রায়চৌধুরীকে কল করলে তিনি আসেননি। পরদিন এসেও রোগী না দেখে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ আরও বাড়িয়ে দেন। তাতে শিশুটির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে কল করলে তিনি সেডিল ইনজেকশন পুশ করতে বলেন। এ সময় শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সাংবাদিকরা হাসপাতালে শিশুটির খোঁজ নিতে গেলে তাদের একেকবার একেক কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত একজন নার্স কেঁদে উঠে বলেন, ওষুধের ডোজ বাড়াতে মানা করলেও ডাক্তার শোনেননি। চোখের সামনে শিশুটিকে মেরে ফেললেন। সাংবাদিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পুলিশ ছুটে আসে। হাসপাতালে হামলা হতে পারে এ কারণে ডাক্তার-নার্সদের থানায় নিয়ে যান। সেখানে আলাপ-আলোচনাকালে চট্টগ্রাম বিএমএর মহাসচিব ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী ছুটে আসেন থানায়। আলাপ-আলোচনার পর ডাক্তার-নার্সদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিএমএর এই নেতার বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে।

    স্থানীয়ভাবে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি হয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে। দুই তদন্তের রিপোর্টে চিকিৎসার গাফিলতিসহ হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সনদ না থাকা মিলিয়ে অনেক অনিয়মের অভিযোগ আসে।

    সারা দেশের মানুষের সামনে বাবা-মায়ের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া ফুটফুটে শিশু রাইফার মৃত্যু প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। বিষাদ নেমে আসে মানুষের মাঝে। এত অনিয়মের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত র‌্যাব নিয়ে ম্যাক্স ও সিএসসিআর হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে অবিশ্বাস্য অসংগতি, আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড ও অনিয়মের প্রমাণ পায়। ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ ও সিএসসিআর হাসপাতালকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে।

    ব্যবসা ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ একদল চিকিৎসক আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অহমে লাগে। অসহায় রোগীদের ব্ল্যাকমেইল করে প্রাইভেট হাসপাতাল ব্যবসায়ী সমিতি চিকিৎসাসেবা বন্ধের ঘোষণা দেয়। দেশের মানুষ ও বিবেকবান সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসক এটি মানতে পারেননি। মানুষের অনুভূতি ও সরকারের চাপের মুখে ধর্মঘট পরদিন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এর আগেও সরকারি হাসপাতালে ঢাকা মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে বিরোধ ও অসদাচরণ ঘিরে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সংঘর্ষেই জড়াননি, রোগীদের চিকিৎসাসেবা থেকে বিরত থেকেছেন।

    কথায় কথায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের মারমুখী আচরণ, ভাঙচুর, হামলা যেমন আইনবিরোধী এবং গ্রহণযোগ্য নয়, তেমন হাসপাতাল মালিক ও সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের কিছু চিকিৎসকের রোগীর প্রতি অবহেলা, ভুল চিকিৎসা, বাণিজ্যিক মনোভাব, বিবেকবর্জিত উন্নাসিক ও দাম্ভিক আচরণ এবং কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার জন্য রোগীর মৃত্যু হলে তিনি যেমন আইনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না, তেমন চিকিৎসকের ওপর কেউ চড়াও হলে আইন হাতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভাঙচুর চালালে তাদেরও আইনের ঊর্ধ্বে যেতে দেওয়া যায় না। চট্টগ্রামের শিশু রাইফা আর মা-বাবার বুকে আসবে না। একটি আবেগ-অনুভূতির উত্তেজনার সময় স্থানীয় বিএমএ নেতর দাম্ভিক আচরণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এনে ক্ষতস্থানে যন্ত্রণা দিয়েছে। তিনি নেতা হলেও বড় ডাক্তার হতে পারেননি।

    পশ্চিমা দুনিয়ায় যেখানে মুমূর্ষু রোগী এলে আগে চিকিৎসা, রোগীকে রিলিজ করার পরে বিল নিয়ে দেনদরবার বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়, এখানেও তেমনটি হবে না কেন? ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে বিচার ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না কেন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমন আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা আমাদের দেশের জন্য সুখের নয়। চিকিৎসকরা ও হাসপাতাল দেশের সম্পদ। এটা যেমন সত্য, তেমন হাসপাতালগুলোর বিধিবিধান বা নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেন রোগীর আত্মীয়স্বজন, দর্শনার্থীরা— এও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। চিকিৎসকের কাছে হাসপাতাল বা রোগীকে সারিয়ে তোলা যেমন ইবাদতের মতো তেমন রোগীর কাছে একজন চিকিৎসক ও নার্স আল্লাহর পর পরম আশ্রয় বিশ্বাসের শেষ ভরসা। উভয় দিকের এ জায়গাটি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। সংক্ষুব্ধ মনোভাব কোনো পক্ষের জন্যই সুখকর নয়।

    চট্টগ্রামের ঘটনা প্রসঙ্গে মহামান্য হাই কোর্ট বলেছেন, কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। দেশে স্বনামধন্য অনেক চিকিৎসক রয়েছেন। ভালোমানের চিকিৎসাসেবার সুযোগ থাকলেও ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পাশের দেশে চলে যাচ্ছেন। এতে দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। মহামান্য হাই কোর্ট একটি রুলের শুনানিতে এই নির্মোহ সত্য উচ্চারণ করেন।

    আমাদের জমানায় জাতীয় অধ্যাপক মরহুম নুরুল ইসলাম, শিশু বিশেষজ্ঞ মরহুম এম আর খান থেকে চিকিৎসক হিসেবে মানবতার সেবায় অনেকেই নিজেদের উৎসর্গ করে গেছেন। ইতিহাস তাদের আদর্শ হিসেবে অমরত্ব দিয়েছে। জীবিতদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত এম এ মালেক থেকে অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত, এ বি এম আবদুল্লাহ, কাজী দীন মোহাম্মদ, ডা. কৌরি, অধ্যাপক শাহলা খাতুন, রওশন আরা, মুবিন খান, মোহাম্মদ আলী, আলী হোসেনসহ অনেকেই জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। আগুন পেট্রলবোমার নৃশংসতার মরণ চিৎকার থেকে ডাক্তার সামন্ত লাল সেন সেবা দিয়ে শ্রদ্ধা-সম্মান আদায় করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসকই মানবিক। রোগীকে সারিয়ে তোলা তাদের কাছে ইবাদত। পারিবারিক জীবন তুচ্ছ করে দিনরাত তারা রোগীর সেবায় নিজেকে নিবেদিত করেন।

    কিডনি ও হার্টের চিকিৎসার জন্য এখন আর মানুষকে দেশের বাইরে যেতে হয় না। কিন্তু আস্থা-বিশ্বাস ও ভয়ের কারণে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত পাশের ভারত থেকে শুরু করে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে যান। বেসরকারি খাতে হৃদরোগ চিকিৎসায় মানুষের আস্থা-বিশ্বাস নিয়ে স্বাস্থ্যসেবার দুয়ার প্রথম খুলেছিলেন সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। মানবিক হৃদয় নিয়ে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিদেশ থেকে আনা প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ও অভিজ্ঞ নার্স দিয়ে সুনামের সঙ্গে চিকিৎসাসেবাই দেয়নি, অনেক কার্ডিয়াক সার্জনও দেশে জন্ম দিয়েছে। হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে যেমন প্রখ্যাত হৃদরোগ চিকিৎসক হিসেবে জাহাঙ্গীর, মুমিনুজ্জামানরা উঠে এসেছেন, তেমনি সিকদার মেডিকেল থেকে ডা. লুত্ফুর রহমান, সোহরাব উজ জামান, শামস মনোয়াররা দক্ষতাই নয়, মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। ডা. মাহবুবুর রহমান, ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটুর মতো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রোগী পাঠালে গভীর মমতায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে হাসিমুখে বাড়ি পাঠান। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বলেছিলেন, চিকিৎসকের কাছে হাসপাতাল হচ্ছে মন্দির। তেমনি চিকিৎসা পেশাকে যেসব ডাক্তার ইবাদতের মতো নিয়ে রোগীকে সেবা দেন, সারিয়ে তোলেন সেসব রোগীও বিশ্বাস করেন এসব চিকিৎসকের ভিতরে ঈশ্বর বাস করেন। মহামান্য হাই কোর্ট যথার্থই বলেছেন কতিপয় ডাক্তারের কথা। অনেক আধুনিক হাসপাতালেও ভুয়া ডাক্তারের হাতে রোগীর অপারেশন হয়েছে। এমন ঘটনা যেমন ধরা পড়েছে তেমন অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে সব নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয় না। দক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়োগ না দিয়ে অনভিজ্ঞদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সব ডাক্তার যেমন ডাক্তার নয়, তেমন সব রাজনীতিবিদ রাজনীতিবিদ নন, সব আমলা আমলা নন। সব আইনজীবী যেমন আইনজীবী নন, তেমন আদালতপাড়ার কতিপয় টাউট-বাটপার সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনজীবীর সুনাম নষ্ট করছেন। একদল লুটেরা গণবিরোধী আদর্শিক রাজনীতিবিদদের সুনাম নষ্ট করেন। তাদের কাছে রাজনীতি জনসেবা নয়, ক্ষমতার দম্ভ, অর্থবিত্ত ভোগ-বিলাসের বাহন। ত্যাগ, নির্লোভ চরিত্রের জননেতার আকাল এদের জন্য। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে উচ্চ আদালত থেকে সনদ জালিয়াতির অভিযোগে একজন বিচারককেও সরে দাঁড়াতে হয়েছে। সব ব্যবসায়ীও ব্যবসায়ী নন। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশকে এগিয়ে নেন। যারা ব্যাংক লুট করে, শেয়ার কেলেঙ্কারি করে এরা ব্যবসায়ী নয়, সুবিধাভোগী লুটেরা। সব লেখক যেমন লেখক নন, তেমন সব সাংবাদিক সাংবাদিক নন, সব কবিও কবি নন। কতিপয়ের দল সব পেশার মানুষের সুনামকে কলুষিত করছে। দেশে নাগরিক সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের আকালও পড়েছে।

    রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে অনেক অন্যায় ভুল অসংগতি দেখেও আমরা চুপ হয়ে থাকি, না হয় এড়িয়ে চলি। আপস করার নামে আত্মপ্রবঞ্চনার দহনেও কেউ কেউ দগ্ধ হই। আর কেউ কেউ যেখানেই সুযোগ, যেখানেই সুবিধা, সেখানেই হুজুর, জাহাঁপনা বলে তেলের নহর বইয়ে দিই। বিবেকের দরজা তালাবদ্ধ করে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে আমরা অনেকে উচ্ছিষ্ট কুড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সব লাজলজ্জা বেমালুম ভুলে পেশাদারিত্বের জায়গায় নীতি ও আদর্শবোধ পরিহার করে ক্ষমতার করুণাশ্রিত জীবনে মানবিক গুণাবলি নিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মহিমায় নিরলস কাজ করার মধ্য দিয়ে সুখ আহরণের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বিপদগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়ের জায়গা হলো ডাক্তার, পুলিশ ও উকিল। ডাক্তার হলো তার জীবন রক্ষার নির্ভরতা। পরমভক্তি ও আদর ডাক্তারদের প্রতি মানুষের। এটা রক্ষা করাও তাদের পবিত্র দায়িত্ব। সবাই তাই করেনও। কিন্তু নির্দয় লোভী, দাম্ভিক দায়িত্বহীন কেউ কেউ এই ইমেজের সর্বনাশ করেন।

    সব ডাক্তার যেমন ডাক্তার নয়, তেমন সব শিক্ষকও শিক্ষক নয়। সেনাশাসক জমানায়ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল মেরুদণ্ডনির্ভর। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ দেশের সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য ইতিহাসে গৌরবের তীর্থস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একটি কথা বলতেই হয়। সেনাশাসন-উত্তর গণতন্ত্রের জমানায়ও বিএনপির রাজনীতির প্রতি অনুগত ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বস্ত অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নিজেদের ব্যক্তিত্ব মাটিতে নামাননি। নিজেদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, তামাশায় পরিণত হতে দেননি। অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীদের জমানার কথা স্মরণ করতে চাই না। একালে এসে তাদের আমলের কথা তুলনা করলে তাদের আত্মা কষ্ট পেতে পারে।

    রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী তরিকুলকে ছাত্রলীগের কর্মীরা হাতুড়িপেটা করে হাড় ভেঙে দিয়েছে। ভিসি ও তার প্রশাসন সেখানে নিজেদের অথর্ব প্রমাণ করেছেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ পঙ্গু অবস্থায় তাকে ছেড়ে দিয়েছে। গরিবের ছেলেটির জন্য কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। আমাদের লেখাপড়ার সিংহভাগ ব্যয় করে দেশের জনগণ। আর আমরা কিছু কিছু আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার রাজনীতিবিদ, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্যাংকার ব্যবসায়ী হয়ে মানুষের সঙ্গে নিয়ত প্রতারণা করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ভিসি আখতারুজ্জামান যেখানে বলেছিলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক, তিনি তা সমর্থন করেন। সেই তিনি আন্দোলনরত অসহায় শিক্ষার্থীদের বিপদের সময় পাশে না দাঁড়িয়ে এখন বলছেন, এদের আন্দোলনে জঙ্গিবাদের চরিত্র দেখছেন। ভিসির এ বক্তব্যে জনগণ বিস্মিত হয়েছে।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দাপটের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করে জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। যদিও রাজনৈতিক বক্তব্যে তিনি এ আন্দোলনে বিএনপির বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ এনেছেন, তবু তার বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ হলেও কাউকে বহিষ্কার করার নজির কেউ গড়তে পারেননি। সেনাশাসন জমানায় সন্ত্রাসের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকে বহিষ্কৃত হলেও গণতন্ত্রের জমানায় বহিষ্কৃত হয় না।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহিরাগতদের অনুমতি ছাড়া আনাগোনা, হলে হলে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের বা মেহমানদের অবস্থান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব ছাত্রছাত্রীর নির্বিঘ্নে চলাফেরা, বসবাস ও নিরাপদে হলে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যেখানে নিয়োগ হয় দলীয় আজ্ঞাবহ, শিক্ষক যেখানে নিয়োগ হয় দলীয় ক্যাডার বিবেচনায়, সেখানে গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করবেন, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন এমনটি আশাও করা যায় না। সমাজের ছাত্র-শিক্ষক, ডাক্তারসহ সবার জন্য সংবিধান, আইনি-বিধিবিধান কার্যকর জরুরি। দলকানাদের যেমন আইনের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না অন্যায় করলেও তেমন অপরাধীদেরও। কোটা সংস্কার আন্দোলকারীদের প্রধানমন্ত্রীর ওপর এখন আস্থা রেখে সরে আসা উচিত। কমিটি কাজ শুরু করেছে। তেমনি সরকারকেও দমনের পথ পরিহার ও আন্দোলনকারীদের ওপর হাতুড়ি নিয়ে নগ্ন আক্রমণকারীদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে জরুরি দুর্নীতি অনিয়ম রুখে শক্তিশালী মনিটরিং।

    লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

    সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close