• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

লুটেরাদের সামনে অর্থমন্ত্রী কেন অসহায়?

প্রকাশ:  ১৩ জুন ২০১৮, ০০:৪৪ | আপডেট : ১৩ জুন ২০১৮, ০৬:৫৪
পীর হাবিবুর রহমান

গজনির সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত অভিযান করেছিলেন। সে সময় তাঁকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি বলা হতো। ১০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে ৪২ দিনে সৈন্যসামন্ত নিয়ে গজনি থেকে গুজরাটের সোমনাথ মন্দির অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন অভিযানে স্থানীয় হিন্দু রাজাদের পরাজিত করার খবর যেমন রয়েছে, তেমন ইতিহাসবিদদের হাতে এই সোমনাথ মন্দির অভিযান নিয়ে নানামুখী বিতর্ক আছে। একেকজন ইতিহাসবিদ যেমন একেকরকম গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরের অভিযানের ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন, তেমনি এ নিয়ে এখনো ভারতবর্ষে অনেক মিথ রয়েছে। তবে ইতিহাসের সত্য হচ্ছে, সোমনাথ মন্দির থেকে সেই অভিযানে ২০০ মণ সোনা উদ্ধার করে তাঁর দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও অনেকে বলেন, তাঁর সেই অভিযানে অংশগ্রহণ করা সৈন্যদের স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন। সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিবমন্দির, যা গুজরাটের পশ্চিম উপকূলের বেরাবলের কাছে প্রবাসক্ষেত্রে অবস্থিত। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবতা শিবের দ্বাদশ লিঙ্গের মধ্যে পবিত্রতম। সোমনাথ শব্দের অর্থ হচ্ছে চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা। ছয়বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হওয়ায় এটি চিরন্তন পীঠ নামে পরিচিত।

ভারতের স্বাধীনতার পর সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই মন্দিরের কাজ এগিয়ে নেন সরকারের আরেক মন্ত্রী কে এম মুন্সী। এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতবিরোধও দেখা দিয়েছিল। গজনির সুলতান মাহমুদ যখন সোমনাথ মন্দির অভিযানে বিজয়ী হয়ে বিপুল সোনা লুট করে নিয়ে যান, তখন অনেকে পরবর্তীতে ইতিহাসে এমন বর্ণনাও দিয়েছেন যে, তৎকালীন ভারতের অনেক হিন্দু রাজা সোমনাথ মন্দিরে তাদের অনেক সোনা লুকিয়ে রাখতেন।

সম্পর্কিত খবর

    সুলতান মাহমুদের সেই সোমনাথ মন্দির লুটের ইতিহাস টেনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া লুটপাটের তুলনা করেছেন সংসদে। বলেছেন, গজনির সুলতানের সোমনাথ মন্দির লুটের পর বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতেও এমন ভয়াবহ লুটপাট সংঘটিত হয়েছে। সংসদে সম্পূরক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে ফিরোজ রশীদ বলেন, ব্যাংক খেলাপি কারা আপনি জানেন না? ৯৮ হাজার কোটি টাকা কারা নিয়েছে আপনি জানেন না? সোনালী, ফারমার্স, রূপালী, জনতা, অগ্রণী এবং বেসিক ব্যাংক লুট হলো! জনগণ কী বিচার পেল? ফারমার্স ব্যাংক কেন নিলামে তোলা হলো না? অথচ মাত্র ২৪ হাজার টাকার জন্য একজন কৃষককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, এফবিসিসিআই যেখানে ডাকাতদের শাস্তি চেয়েছে, সেখানে অর্থমন্ত্রী ডাকাতদের সুযোগ দিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি অর্থমন্ত্রী আছেন কি ডাকাতদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য, নাকি জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য? ব্যাংকওয়ালারা আপনাকে কি ভোট দেবে? আপনি সাধারণ মানুষের দিকে তাকালেন না! কাজী ফিরোজ রশীদ পরিষ্কার বলেন, নির্বাচনের আগে বড়লোকদের অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা নিয়ে রেখেছেন। ভোটের সময় তাদের পাবেন না। গরিবরাই আপনাদের ভোট দেবে।

    স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সরকারকে টাকা দেয়। আর আমাদের সরকার ব্যাংকে উল্টো মূলধন দেয়। তিনি প্রশ্ন করেন, তারা পারলে আমরা কেন পারব না? ফরাজী আরও বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখে মানুষ নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু মানুষ ভীত হয়ে গেছে। ফলে টাকা পাচার হয়ে যায়।

    এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের রেকর্ড ভঙ্গ করে ১২টি বাজেট ঘোষণা করে ইতিহাস গড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকিং খাতসহ সামগ্রিক আর্থিক খাতে বিদ্যমান পরিস্থিতির মুখে সমালোচনার তীব্র ঝড়ে পতিত হয়েছেন। একজন ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, মননশীল, মেধাবী, প্রজ্ঞাবান ও প্রবীণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েক বছর ধরে ঘটে যাওয়া একের পর এক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, লাখ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ, হাজার হাজার কোটি টাকা ডাকাতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা যেমন নিতে পারেননি, তেমনি ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটিয়ে শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। মানুষের বুকভরা আশা ও আকুতির পক্ষে নিতে পারেননি অবস্থান।

    যখন বাজেট-উত্তর দেশের আর্থিক খাত নিয়ে সংসদের ভিতরে-বাইরে বিতর্ক চলছে, রবিবার সংসদে সম্পূরক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রীকে তুলাধোনা করা হচ্ছে, তার তিন-চার দিন আগে বুধবার আমি আবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে যোগ দিয়েছি। সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠকপ্রিয়তা অর্জনে শুরুতেই যারা নিরলস কাজ করেছেন, তাদের সঙ্গে আমিও আমার মেধা, শ্রম বিনিয়োগ করেছিলাম। দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমার রয়েছে গভীর ভালোবাসার বন্ধন। আমাকে আবার যুক্ত করায় দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের মাননীয় চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহানের প্রতি কৃতজ্ঞ। বন্ধু, সম্পাদক ও কর্মোদ্যমী নঈম নিজামের সঙ্গে আমার সখ্য ও বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। আবার কাছাকাছি হওয়া, আবার সেই চিরচেনা প্রতিষ্ঠান, প্রিয় সহকর্মীদের কাছে ফিরে পাওয়ায় আমি আনন্দিত। বাংলাদেশ প্রতিদিন পাঠকদের সঙ্গে পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে ফের নিয়মিত যোগাযোগ ঘটবে। মধ্যখানে যে নিউজ পোর্টাল করেছিলাম সেই পূর্বপশ্চিম থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছি। সৎ, সাহসী, দক্ষ, মেধাবী সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তা-লেখক খুজিস্তা নূর ই নাহারীন মুন্নি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিই এককভাবে সেটির দায়িত্ব নিয়েছেন। মাঝখানে আমার অভিজ্ঞতা অর্থ ছাড়া কখনই মেধা-সৃজনশীলতা দিয়ে আজকের করপোরেট যুগে স্বপ্নের কাছেও যাওয়া যায় না।

    যাক, গণমাধ্যমসহ যে কোনো পরিস্থিতি সাহস ও মেজাজের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে পারলেও আমাদের অর্থমন্ত্রী আর্থিক খাতে করুণ বিপর্যয়ের মুখে উদ্বিগ্ন দেশবাসীর কেন আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেননি? এই প্রশ্ন অনেকের মতো বার বার আমাকেও ভাবিয়ে তুলছে। কেন একজন সাহসী প্রজ্ঞাবান অর্থমন্ত্রী মুহিত লুটেরাদের সামনে জনগণের সব আবেগ-অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে এতটা অসহায়? বুঝি না!

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পথ হাঁটছেন, অর্থমন্ত্রীর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন, সেখানে অভিজ্ঞ আবুল মাল আবদুল মুহিত কেন এত অসহায়? যারা এই বিশাল খেলাপি ঋণের জন্য দায়ী তাদের নাম যেমন প্রকাশ করতে পারছেন না, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না! একের পর এক সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক থেকে বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক অখ্যাত নামসর্বস্ব লুটেরাদের বিশাল অঙ্কের ঋণ দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বারোটা বাজিয়ে জনগণের টাকা লুট করে নিয়ে গেলেও কোন অসহায়ত্বের কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না? প্রতি বছর প্রায় লাখ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, না ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে, না বন্ধ করা যাচ্ছে, না এসব জঘন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে— এই লুটপাটের সামনে, এই অর্থ পাচারের সামনে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি কেন অসহায়? বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করবেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন, এক বছর আগের দেওয়া অঙ্গীকারই নয়, বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনের তিন দিন আগে জনগণকে দেওয়া ওয়াদা থেকে সরে গেলেন। বলছেন, ব্যাংক কমিশন তিনি করছেন না। পরের সরকারের জন্য রেখে গেলেন। কেন এভাবে পিছু হটলেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী?

    ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধী দলের বর্জন, সহিংস আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ক্যারিশমায় শাসক জোট ওয়াক ওভারই পায়নি, রীতিমতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ঝড় তোলা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকেও হজম করে পূর্ণ মেয়াদ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের মুনশিয়ানায় বিরোধী দলকে দমন করে সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হরতাল-অবরোধের রাজনীতি মুক্ত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের একটি দেশের শাসনব্যবস্থার নজির স্থাপন করলেও ব্যাংকিং খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি রুখতে পারেননি। সব অর্জনকে ধূসর করেছে ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণের পাহাড়। রাজনৈতিক আবহাওয়া শাসকদলের যতই অনুকূলে থাক না কেন আগামী জাতীয় নির্বাচন শাসক দলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, জাতীয় ঐক্যের যে স্লোগান গণফোরামের ড. কামাল হোসেন একদিন তুলেছিলেন, তা এখন বি. চৌধুরীর যুক্ত ফ্রন্টই নয়, রাজনৈতিকভাবে কঠিন বিপর্যয়ে পতিত শক্তিশালী দল বিএনপিও লুফে নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি প্রতিনিধি দল দিল্লি সফর করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাদের সহযোগিতাই চাইছে না; বিএনপি বলছে, তারা ক্ষমতায় এলে ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজে হতে দেবে না। অতীত ভুলের চড়া মাশুল গুনতে গুনতে দিল্লি ঘুরছে বিএনপি। শোনা যাচ্ছে, জুলাই থেকে আন্দোলন-আন্দোলন সুর তুললেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সময় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের ঝড়ো-হাওয়া তুলতে চাইবে। বিনা চ্যালেঞ্জে এবার নির্বাচন ছেড়ে দেবে না বিএনপিসহ ছোট দলগুলোও, এমন খবর বাতাসে বইছে।

    সময় এখনো অনেক দূর। আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে যেতে পারে এমনটা অনেকেই মনে করছেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী বাজেট যেমনই হোক, জনগণের হৃদয় জয় করতে ব্যাংকিং খাতে চরম অনিয়ম রোধে শৃঙ্খলা ও সুশাসন ফিরিয়ে এনে জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ব্যাংক কমিশন গঠন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী কেন সরে দাঁড়ালেন সে এক অপার রহস্য। জানতে ইচ্ছা করে সংসদের ভিতরে-বাইরে এত আহাজারি, এত বিতর্ক, এত হাহুতাশ মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনগণের আকুতি আপনার হৃদয়কে স্পর্শ করে না? কোন রহস্যজনক কারণে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের জন্য কমিশন করতে গিয়ে আপনি সরে দাঁড়ালেন। তাহলে কি যারা অভিযোগ করছেন সংসদে দাঁড়িয়ে ব্যাংক কমিশন গঠন করলে, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারে হাত দিলে দেশবাসীর সামনে সব লুটেরার মুখোশ উন্মোচিত হবে। সে কারণে সরে দাঁড়িয়েছেন? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো প্রজ্ঞাবান অর্থমন্ত্রী ব্যাংক ডাকাতদের রক্ষা করতেই ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন!

    সিপিডি কি যথার্থই বলেছে, ব্যাংকের করপোরেট বা প্রাতিষ্ঠানিক করহার কমানোর পেছনে রাজনৈতিক অর্থনীতি লুকিয়ে রয়েছে? ব্যাংকের ভিতরে যখন নৈরাজ্যের অবসানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আনা জরুরি ছিল, তখন তা না করে মালিকপক্ষকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে পারিবারিক দৌরাত্ম্য উৎসাহিত করা হয়েছে। এসব অভিযোগ অর্থমন্ত্রী কোন যুক্তিতে, কোন বিবেচনায় নাকচ করে দেবেন? আগে আইন করে এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। এবার কর কমিয়ে তাদের লাভবান হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। জনগণের করের টাকা থেকে লুটপাট হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোতে মূলধন সরবরাহ দেওয়া হবে। অথচ ব্যাংক মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, ইচ্ছামতো ঋণ গ্রহণ, এমনকি বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে না এ কেমন কথা! ফারমার্স ও এনআরবি লুটপাটে তছনছ হয়ে গেল। কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হলো না! অপরাধীদের আইনের ঊর্ধ্বে রেখে উল্টো আরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মূলধন সরবরাহ করা হলো। এসব কি তুঘলকি কারবার নয়? এসব কি জনগণের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ নয়? এসব ঘটনা কি ব্যাংকের ওপর মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে বড় বাধা নয়? ব্যাংকিং খাতে অবাধ লুটপাট হলো, খেলাপি ঋণের পাহাড় জমল, ভুয়া এলসির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হলো, কোনো কিছুরই স্বচ্ছ তদন্ত হলো না!

    ব্যাংকিং খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত হলো, ভিতরে লুকিয়ে থাকা অপরাধীরা ধরা পড়ল না। এতে মানুষের আস্থা ফিরবে কোথা থেকে?

    ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার বলেছে, একশ্রেণির লোক আছেন, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকের টাকা তছরুপ করেছেন, ব্যাংকের টাকা ডাকাতি করেছেন। আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যারা ব্যবসা করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংকের সহায়ক ভূমিকা দেখতে চাই। এফবিসিসিআইর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন আরও বলেছেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে, মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে, যা আমাদের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বিষয়টি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব করছি, যাতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বজায় থাকে।

    সংসদে দাঁড়িয়ে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আওয়ামী লীগের প্রবীণ এমপি আলী আশরাফ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পরামর্শ দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে বলেছেন, এদের ধরুন। অর্থ পাচারকারীদের ধরুন। লুটপাটকারীদের ধরুন। শক্ত হাতে এগুলো করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির আমদানি খাত যত বড় রপ্তানি খাত ততই ছোট। ডলারের ঊর্ধ্বগতি স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রচুর ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে টাকা আটকে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সর্বক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। এমন খবরও বাতাসে উড়ছে নির্বাচন যখনই আসে তখনই বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। নব্য টাকাওয়ালারা এ দেশকে নিরাপদ মনে করছেন না বলে বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন। অর্থ সরিয়ে ফেলছেন। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই। অরাজকতার কবলে পতিত ব্যাংকিং খাত প্রকৃত ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের ঋণদানে যত না উৎসাহবোধ করে নাম-পরিচয়হীন ভুয়া কোম্পানিকে ঋণদানে তত বেশি আগ্রহবোধ করে। ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা ও লুটপাট এবং অর্থ পাচারের ফলে তারল্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখতে মানুষ ভয় পাচ্ছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে লুট হয়ে যাবে, এই আতঙ্ক সমাজকে গ্রাস করছে। ব্যাংকিং খাত দেশের মানুষকে অস্থির-অশান্ত-উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়ার কারণে বেকারত্বের হার বাড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটের ঢেউ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে শেয়ারবাজারে। লাখো কোটি মানুষের ভাগ্য পুঁজিবাজার ঘিরে কঠিন বিপর্যয়ের মুখে। শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সাম্প্রতিককালের মতো বিপর্যয় আর কখনো আসেনি। খারাপ শেয়ার বাজারে এনে জুয়াড়িদের লুটপাটে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিসিইসি। এর কর্তারা অগাধ বিত্ত-বৈভব গড়েছেন। সেসবও তদন্তের আওতায় আসে না। শেয়ারবাজার চরম রক্তশূন্যতায় ভুগলেও ব্যর্থ নেতৃত্ব যেমন দায়িত্বশীল সাহসী উদ্যোগ নিতে পারছে না; সরকারও একে চাঙা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মানুষের মধ্যে শেয়ারবাজার ঘিরেও আশঙ্কা গভীর হচ্ছে যে, এখানে বিনিয়োগ করলে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার গ্যারান্টি শতভাগ।

    সামগ্রিক পরিস্থিতি মিলিয়ে দেশের আর্থিক খাত নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংক লুটেরাদের হাত থেকে, শেয়ার লুটেরাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কেন সাহসী ভূমিকা রাখতে পারলেন না? শেয়ার কেলেঙ্কারির পর ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। দোষীদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রত্যাশা শাস্তির খড়্গ নামেনি। সংসদে দাঁড়িয়ে শেয়ার কেলেঙ্কারি ও ব্যাংক লুটপাটের পর সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর অসহায়ত্ব তুলে ধরলেও কেন এত অসহায়, কতটা অসহায়? জীবনের পড়ন্ত বেলায় দেশবাসীকে তাও জানাতে পারলেন না।

    লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close