• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

দেন-দরবার থাকলেও ভারতই আমাদের বন্ধু

প্রকাশ:  ৩০ মে ২০১৮, ২৩:৫৭
পীর হাবিবুর রহমান

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব বিশ্বে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি নিকেতনে দেয় এই বক্তব্যর সঙ্গে ভবিষ্যতেও উভয় দেশ সহযোগিতা চলমান রাখবে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তা যথার্থই বলেছেন। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর যাত্রাপথে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ গভীরতা রয়েছে।

দুই দেশের আদর্শিক চেতনার জায়গা, পারস্পরিক স্বার্থ, ভৌগলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই বন্ধুত্বের এই বন্ধনকে চিরস্থায়ী উষ্ণতা দেবে না, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ভারতের গড়ে ওঠা নিবিড় বন্ধন রক্তে লেখাই নয়, বিশ্বাসের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণই নয়, ঐতিহাসিক মানবিক প্রেক্ষাপটেও রয়ে গেছে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতের নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দুই রাষ্ট্রের জনগণের আবেগ-অনুভূতি, পারস্পরিক সহমির্মতা ও ভালবাসার শক্তির উপর এই বন্ধুত্বের ভিত্তি রচনা করে গেছেন। আজকের বাংলাদেশ ও ভারত স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সেই ঐতিহাসিক রক্তে লেখা বন্ধুত্বের উত্তারাধিকারিত্ব বহন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, আস্থা-বিশ্বাসের উপর বন্ধুত্বকেই জোরদার করেনি, সমস্যার সমাধানও একের পর এক ঘটিয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে মে রেখে একটি স্বাধীন দেশের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় নেত্রীই নন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় কথা বলেছেন। তার বক্তব্যের মধ্যে তথাকথিত ভারত বিরোধী সমালোচকদের খুঁজে ফেরা আনুগত্যের চিহ্ন ছিল না। গোটা বক্তব্যেই ছিল, দুই দেশের বন্ধুত্ব সুসংহত, উষ্ণ ও অব্যাহত রাখা। বাস্তবসম্মত নির্দেশনা।

শান্তি নিকেতনে নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন শেষে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনের সময় দেয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি নিকেতনের এই ভবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় এবং দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও জোরদার করবে। তিনি পরিস্কার বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের সঙ্গে একত্রে চলতে চায় এবং এই লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যকার অনেক সমস্যার নিষ্পত্তি হয়েছে। তিনি বলতে ভুলেননি, এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে, যা বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাধান করা যাবে। গত ৯ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ভবন দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ ভবন দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতি বিনিময়ের প্রতীক হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থল সীমান্তের মতো জটিল সমস্যার সমাধান হয়েছে, যা এক সময় অসম্ভব বলে মনে করা হত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সব রকম সহযোগিতা করছে ভারত। মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশ ভবনের মধ্য দিয়ে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।

সমাবর্তণ অনুষ্ঠান ও বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধের পর সেখানে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ৩০ মিনিটের একান্ত বৈঠকে কোনো আলোচ্য সূচি না থাকলেও গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, নিরাপত্তা, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা ও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ভুলেননি। সেই আলোচনায় নরেন্দ্র মোদি সাড়া দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়েই শেখ হাসিনা আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিস্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনো দিল্লির প্রত্যাশিত সহযোগিতা পায়নি ঢাকা। এরমধ্যে তিস্তা যে অমিমাংসিত বিষয়গুলোর একেবারেই উপরে আছে নাম উল্লেখ না করেই তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যায়। আর এখনো কিছু বাকি রয়েছে মন্তব্য করে নরেন্দ্র মোদির উপর কূটনৈতিক চাপটি দিতে তিনি ভুলেননি। তিনি আরও বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ রয়েছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও তারা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যাক এটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে মমতা দেখা করতে এলে শেখ হাসিনা দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি নিয়েও কথা বলেছেন। গণমাধ্যম কর্মীরা সাক্ষাৎ শেষে মমতাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই প্রকাশ্যে আলোচনা করতে চান না। যদিও মমতা বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভাল। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু ভবন হবে এবং তাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি গ্রহণ করে দেয়া বক্তৃতায় বলেন, নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতানার। তাঁর সেই চেতনায় আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলছি। কাজেই আমরা আশা করি, আপনারাও একই চেতনায় কাজ করবেন। সেখানেও তিনি বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে সমৃদ্ধ হবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেক সমস্যা থাকলেও তা অমিমাংসিত রাখা উচিত নয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে মুুজিব-ইন্ধিরা চুক্তির আলোকে স্থল সীমান্ত বা ছিটমহল সমস্যার ঐতিহাসিক সমাধান ঘটেছিল। দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা কংগ্রেস জোট শাসনামলে উদ্যোগ নিয়ে এটি করতে না পারলেও নরেন্দ্র মোদির জামানায় ভারতের পার্লামেন্টে বিলটি সর্বসম্মতভাবে পাস করে এই সমস্যার সমাধান ঘটেছে।

শেখ হাসিনার আগের শাসনামলে গঙ্গাচুক্তি হয়েছে। তিস্তা চুক্তি দিল্লি সরকার আন্তরিক হলেও পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী মমতার বাগড়ায় এখনো ঝুলে আছে। শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে চুক্তি সম্পন্নে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তাঁর ও শেখ হাসিনার শাসনামলে এই চুক্তি সম্পন্ন হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর সামনেই জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ হাজির হচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করতে পারি, নাটকীয়ভাবে তিস্তা চুক্তি নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন হবে এই আশায়। সীমান্ত হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনার অভিযোগ আমাদের তরফ থেকে বরাবর উঠেছিল। দুই পক্ষের দফায় দফায় বৈঠক আলাপ-আলোচনায় সেটির সমাধান এনেছে।

ভারত ২০১০ সালে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সুবিধা বর্ধিত করে। লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় গৃহিত ৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ঘোষণা করা হয়, যা ভারত কর্তৃক কোনো দেশকে দেয়া একক সর্ববৃহৎ লাইন অব ক্রেডিট। বিদ্যুৎ খাতসহ বিভিন্ন খাতে তাদের বিনিয়োগ যেমন রয়েছে, তেমনি বেড়েছে আমদানি-রপ্তানীর খাত। এসব দীর্ঘ খতিয়ানের বিষয়।

ভারতের সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে পানিসহ দুই দেশের বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে জনগণের আশা-আকাঙ্খা লালন করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ এবং এই দেশের জনগণের হৃদয় জয় করার বিষয়টিকে উপলব্দি করা দরকার। তেমনি রাজনৈতিক কারণে ভারত বিরোধী অসুস্থ, নেতিবাচক সংস্কৃতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আমাদের রাজনৈতিক শক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের আত্মপলব্ধির দরকার যে, আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পার্শ্ববর্তী বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থেকেই দেন-দরবার করে দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ নিতে হবে। অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও সামরিক শক্তি বিবেচনায় ভারতের মতো শক্তিশালী বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে বৈরীতা নয়, বন্ধুত্বের খোলা পথে সকল সমস্যার সমাধান এবং আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে পথ নিতে হবে।

সহজ-সরল মোটা দাগে ভাবতে হবে। একাত্তরের পরাজিত, ব্যর্থ, সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সঙ্গে যতই কূটনৈতিক সম্পর্ক থাক না কেন বন্ধুত্বের প্রশ্নে কোনো উচ্চতায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রটি তার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র ভারতের নিরাপত্তা বিঘœ করতে গিয়ে নিকট অতীতে আমাদের ভূখ-ের শান্তি ও স্বস্তি নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র যারা হামেশাই আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলায়, এমনকি একাত্তরে আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুটে ক্ষমা চায় না, পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নাক গলায়, বিতর্কের ঝড় তোলে, আমাদের ভূখ-ে সন্ত্রাসবাদের জায়গা করে দিতে চায়, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সীমারেখা বড় বেশি সীমিত।

পাকিস্তান হচ্ছে, সামরিকতন্ত্র, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য। অন্যদিকে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তিই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের আলোকিত পথ, তেমনি সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আকুতিই হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত ও মানবিক রাষ্ট্র।

আজকের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতের বুক চিরে যেমন ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটেছে, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যকা-ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাই মুছে যায়নি, সামরিক শাসকদের হাত ধরে সংবিধানে বিসমিল্লাহই যুক্ত হয়নি, রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামই হয়নি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভঙ্গুরই হয়নি, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানও ঘটেছে। গণতন্ত্রকামী যে জনগণ স্বাধীনতার পথ ধরে সুমহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেছিল, তাদের উত্তরাধিকাররা সামরিক শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছিল।

আজকের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু মানুষের আশা ফুরিয়ে যায়নি। ফুরিয়ে যায়নি বলেই চেতনাগত জায়গা থেকে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেন। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হন। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে এই জাতির জীবনে বড় গৌরব আর কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে ধ্রুবতারার মতো উজ্জল স্বপ্ন হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সেই উন্নত, আধুনিক অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বৃথা যেতে পারে না। ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীর চেয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে আর কোনো অকৃত্রিম বন্ধু যেমন নেই, তেমনি আমাদের সেই যুদ্ধদিনের দুঃসময়ে ভারতের মতো কোনো বন্ধু পাশে এসে দাঁড়ায়নি এই জাতির জীবনে। শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর দিয়ে বাংলদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব যেমন হতে পারে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসীর অবদান মিত্রবাহিনীতে যুক্ত হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে আমাদের বীর যোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীরদের ভূমিকা অস্বীকার করে এই বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক চলতে পারে না। আমরা চাইলেই ভুলে যেতে পারি না। একাত্তরের ২৫ মার্চ কাল রাতে বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানকে দিয়ে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান কি নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল। সেই গণহত্যার মুখে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী ও তাঁর জনগণ আমাদের এককোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়েছিলেন। সেদিনও ভারতের মানুষ দারিদ্র পীড়িত ছিল। তবু আমাদের খাবার, আশ্রয় ও অস্ত্র দিতে কাপর্ণ্য করেননি। ভারতের নেত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নই নয়, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ সফর করেছিলেন। ইয়াহিয়া খান সামরিক আদালতে আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কারাগারের পাশেই কবর খুঁড়েছিলেন। সেই নেতার মুক্তির জন্য ইন্ধিরা গান্ধী ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন।

আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের হাজারটা সমালোচনা করা গেলেও বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস, অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সেদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেই জনগণের পাশে প্রতিবেশী ভারত নামের রাষ্ট্রটিই বন্ধুত্বের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। সেদিনও মুক্তিযোদ্ধা ও তার পক্ষের শক্তিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোষররা ইসলামের দুশমন বলেছিল, ভারতীয় গুপ্তচর বলেছিল, ভারতের দালাল বলেছিল। চীনাপন্থী অতিবিপ্লবীদের সুর তাদের থেকে বেশি দূরে ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর মুজিব বিদ্বেষী শক্তির উত্থানই ঘটেনি, মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের বিরুদ্ধে জিগির শুরু হয়েছিল।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মাথায় এসে প্রমাণ হয়েছে, ষড়যন্ত্রের অন্ধকার পথ কখনই সূর্যের মতো ইতিহাসের সত্যের শক্তিকে রুখে দাঁড়াতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসিই হয়নি, মুজিব বিদ্বেষী রাজনৈতিক শক্তির পরাজয়ই ঘটেনি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে হিমালয়ের উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের নিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল এটি হতে পারে তা সত্য। কিন্তু জনগণের শক্তি ছিল বলেই সেই সত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। কারণ জনগণের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব মুছে দেয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ এলেই, স্বাধীনতা সংগ্রাম এলেই ইতিহাস মহানায়কের আসনে বসায় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু নামটি উচ্চারিত হলেই ¯্রােতশিন্নী নদীর মতো কলকল ধ্বনি তুলে ইতিহাসে উঠে আসে স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ গৌরবজনক অধ্যায়। উঠে আসে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস। জাতির জীবনে বীরত্বের ইতিহাস একবারই রচিত হয়েছিল, পৃথিবীর মানচিত্র ভেদ করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের অভ্যূদ্বয়ে। আর সেই অভ্যূদ্বয়ে কৃতজ্ঞ জাতির জীবনে বন্ধুর ভূমিকায় ইন্ধিরা গান্ধীর হাত ধরে উঠে এসেছিল ভারতবর্ষ ও তাঁর জনগণ। সেই ভারতের মহান নেত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর পর সেখানকার অনেক রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে আমাদের কৃতজ্ঞ করে গেছেন।

তাদের মধ্যে প্রয়াত সিদ্ধার্থ শংকর রায় ও জ্যেতি বসুর নাম উজ্জল। কালের স্বাক্ষী হয়েই বাংলাদেশের আরেক অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী রয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় নিয়ে সর্বশেষ ঢাকা সফরে এলে তিনি ছিলেন ক্লান্ত, অসুস্থ। ঢাকায় নেমেই হোটেল থেকে ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়েছিলেন ক্লান্ত, অবসন্ন প্রণব মুখার্জী। সেখানে অনেকেই সমেবেত হয়েছিলেন। প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সবার ফটো সেসন চলছিল। প্রতিটি ফটো সেসনে দুই মিনিট করে সময় লেগেছিল। ২০টি ফটো সেশনের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রণব মুখার্জী চেয়ারে বসা আর আমাদের রাজনীতিবিদরা দুপাশে দাঁড়িয়ে। ভারত বিরোধীরা জাত গেল জাত গেল বলে সুর তুলেছিলেন। একবারও বিবেচনা করেননি, টানা ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে একজন ক্লান্ত, অসুস্থ প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জীর জন্য ফটো সেসন করা সম্ভব ছিল না। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে একটি ছবি ভাইরাল হলেও সেই ভারত বিরোধীরা একদম নীরব, বোবা বনে গেছেন। শান্তি নিকেতনে দর্শণার্থীর বইয়ে নিজের অনুভূতি লিখছেন বাংলাদেশের প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে আরাম কেদারায় বসে তিনি লিখছেন, আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিনয়ের সঙ্গে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এতে কি ভারতবর্ষ ছোট হয়ে গেল? এতে কি নরেন্দ্র মোদি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বা আমাদের কাছে ছেট হয়ে গেলেন? এই বিনয়ের সংস্কৃতি ব্যক্তি ও জাতিকে বড় করে বিনয় কখনো ছোট করে না। বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা এত যুগ পরেও আমরা ছাড়তে পারিনি। আমাদের পূর্বসরীদের কাছ থেকে পাওয়া উঁচু সংস্কৃতি যেন আমরা ভুলে গেছি। ভারত বিরোধীতার নামে, সাম্প্রদায়িকতার নামে বাতাসে যারা বিষ ছড়িয়ে দেন প্রতিহিংসার আগুনে, জাতীয় স্বার্থ তারা কি আদৌ বিবেচনায় রাখেন। বন্ধুকে শত্রু বানাতে গিয়ে প্রকৃত শত্রুকেই তারা তৃপ্তির হাসি হাসতে দেন। বঙ্গন্ধুর রাজনৈতিক সচিব প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের স্মৃতি চারণে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতবাসী কি আবেগ, উত্তেজনা ও ভালবাসা নিয়ে অভিনন্দিত করেছিল। কলকাতার ২০ লাখ মানুসের সেই সংবর্ধনা এদের বুকটাকে বড় করতে পারে না। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতির জনক ইন্ধিরা গন্ধীকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণে কিভাবে এক কথায় তার মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের এই দেশ থেকে প্রত্যাহার করিয়েছেন। সেটি নিয়ে এই সমালোচকরা কখনো বাহবা দেন না।

শেখ হাসিনার সফরকালে কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর নামে মমতার বঙ্গবন্ধু ভবন নির্মাণে ঘোষণা শুনে তারা একবারও বলেন না, বাহ্ এত খুশির খবর। ভারত যেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশর মতো প্রতিবেশী বন্ধুকে পাশে নিয়ে হাঁটতে চায়, তেমনি আমরা আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের সঙ্গে বাস্তবতার নিরীখে বন্ধুত্বের হাত সুদৃঢ় করে হাঁটলে আপত্তি কোথায়?

২০০১ সালের নির্বাচনে যারা ভারতের সঙ্গে উষ্ণ বন্ধুতের সম্পর্ক গড়তে আনন্দবোধ করেছিলেন, তারা আজ এত ব্যথিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে যে চরম ভুলগুলো করেছিলেন, তার বিচার-বিশ্লেষণ করে আত্মপলব্ধি করলে এতটা ব্যথিত হতেন না। চড়া ভুলের চড়া মাসুল গুণতে হয়। আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না। কিন্তু যখন যারা ক্ষমতায় থাকবেন, জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে উষ্ণ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে হাঁটার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করবেন, আর সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক দেন-দরবার করবেন। বিশ্বায়নের এই যুগে সম্পর্ক উন্নয়ন ও আলোচনাই সমস্যা সমাধানের পথ। নির্বাচন, গণতন্ত্র ও ক্ষমতায় আরোহণের জন্য বিদেশী শক্তিকে দোষারোপ বা বিদেশী শক্তির কাছে করুণা ভিক্ষার চেয়ে দেশের জনগণের উপর আস্থা রেখে, জনগণের শক্তির উপর বিশ্বাস রেখে জনমত পক্ষে নিয়ে রণকৌশল নির্ধারণই একমাত্র পথ। দেন-দরবার থাকলেও ভারতই আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। এই সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

পীর হাবিবুর রহমান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close