• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

হে মার্কেট টু রানা প্লাজা

প্রকাশ:  ০১ মে ২০১৮, ০০:৩৪ | আপডেট : ০১ মে ২০১৮, ০১:৫৪
বিপুল হাসান

আজ ১ মে, শ্রমিকের রক্তে রাঙা মহান মে দিবস । ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীতে শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু করে। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর সেই সময় গুলি চালিয়ে পুলিশ ১১ জনকে হত্যা করে। শ্রমিকদের অপরাধ ছিল তারা তাদের অধিকার দাবি করেছিল। ১২৬ বছর পর ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের সাভারে ভবন ধসের ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা।

কোনটি বড় ঘটনা? শিকাগোর হে মার্কেটে শিকাগোর হে মার্কেটে বাড়তি সময় কাজ করতে অস্বীকার করায় পুলিশের গুলিতে ১১জন নিহত হওয়া, নাকি ঢাকার সাভারের রানা প্লাজায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে মালিকের খামখেয়ালির খেসারত স্বরুপ ১,১৩৬ জন শ্রমিকের প্রাণহানীর ঘটনা? এ প্রশ্ন আজ বিশ্ব-বিবেকের কাছে। বিশ্বের দেশে দেশে সাড়ম্বরে ১ মে পালিত হয় বিশ্ব শ্রমিক দিবস। আর আমাদের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিনটি পাড় হয়ে যায় নিরবে-নিভৃতে, হতাহতের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারের ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার চাপা বিক্ষোভ আর সশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলার মধ্য দিয়ে।

সম্পর্কিত খবর

    ১ মে বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো বাংলাদেশ পালন করে শ্রমিক দিবস হিসেবে, আর আমাদের পোশাকশ্রমিকদের রক্তে ভেজা ২৪ এপ্রিল পায় না রাষ্ট্রীয় কোনো বিশেষ দিবসের স্বীকৃতি। দৈনিক পত্রিকায় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তির নিউজ ছাপা বড়জোর দুই কলামে, আর বিশ্ব শ্রমিক দিবস উপলক্ষে বের হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র।

    ঐতিহাসিক মে দিবসের সূচনা যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ১৮৮৬ সালের কথা দেশটির শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকরা আন্দোলন করেন উপযুক্ত মজুরি ও দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করার দাবিতে। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর সেই সময় গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হয়। সেদিনের ওই ঘটনা ক্রমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে নিহত শ্রমিকদের সম্মানে `মে দিবস` হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে ১ মে দেশে দেশে পালিত হয় `মে দিবস` খ্যাত বিশ্ব শ্রমিক দিবস হিসেবে।

    বাংলাদেশের শ্রমজীবি গরিব মানুষগুলো চাকরি হারানোর ভয়ে ভবন মালিক ও গার্মেন্টস মালিকের নির্দেশে ফাটল ভবনে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। গত ২৪ এপ্রিল ভবনটি ধসে পড়লো মেহনতি মানুষগুলোর মাথার ওপর। ভবনের প্রতিটি তলা যেন স্যান্ডউইচের মতো একটির ওপর আরেকটি মুহূর্তেই চেপে বসে আর পিষে ফেলে শ্রমজীবী মানুষদের। মানব ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজেডিগুলোর মধ্যে সাভারও যুক্ত হলো।

    ভবন মালিক রানার আহ্বানেই গার্মেন্টস মালিকেরা সেদিন সকালে কর্মীদের ডেকে এনে কাজে যোগদান করান। আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দিলে তাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কাজে যোগদানে বাধ্য করিয়ে অসংখ্য শ্রমিকের জীবনাবসান হলো। এ ঘটনাকে দুর্ঘটনা না বলে ‘হত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। পাঁচ বছর আগেলসাভারে আট তলা রানা প্লাজা ধসে সেখানে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১১৭ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ১৭ দিনের অভিযানে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যান। সে হিসেবে নিহত হয় এক হাজার ১৩৬ জন। আহত হয় এক হাজার ১৭০ জন। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অশনাক্তকৃত মরদেহ জুরাইন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে ৭৮ জন।

    সারা বিশ্বেও অন্যতম ভয়াবহ এই শিল্প দুর্ঘটনার পর মামলা হয় মোট তিনটি। হত্যা, ইমারত নির্মাণ আইন এবং ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে তিনটি মামলায় অভিযোগ গঠনও হয়েছে। কিন্তু এরপর আইনি জটিলতায় ঝুলে আছে বিচার। মামলাগুলোর ৪২ আসামির মধ্যে একমাত্র ভবনটির মালিক সোহেল রানা এখন কারাগারে। বাকিদের ৩২ জন জামিনে, সাত জন পলাতক এবং দুই জন আসামি মারা গেছেন।

    ১,১৩৬ জন শ্রমিকের প্রাণহানীর জন্য যারা দায়ি, তাদেরকে পাঁচ বছরেও সাজা দিতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আমাদের পালন করতে হচ্ছে এবারের বিশ্ব শ্রমিক দিবস ১ মে।

    লেখক: সাংবাদিক/বার্তা সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close