সুন্দরবনে ফের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা
চারদিনেও উদ্ধার হয়নি ডুবে যাওয়া কয়লাবাহী কার্গো
সুন্দরবনের সংরক্ষিত হারবাড়িয়া এলাকায় পশুর নদীকে ডু্বে যাওয়া কয়লাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি বিলাসের উদ্ধার কাজ শুরু হয়নি চার দিনেও। কয়লার রাসায়নিক উপাদান এরই মধ্যে পানিতে ভিজে দূষিত করে তুলেছে সেখানকার জলভূমি। এটি প্রতিরোধে জরুরী ভিত্তিতে উদ্যোগ না নিলে পানির মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে আশেপাশের এলাকায়। এতে ঝুঁকির মুখে সুন্দরবনের এই অংশের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কয়লায় মধ্যে থাকে সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, পারদ ও আর্সেনিক। এগুলো মানুষ ও প্রাণীর শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ফলে এসব রাসায়নিক পদার্থে আক্রান্ত হবে মাছসহ জলজ প্রাণী। সেগুলো থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষও। তাছাড়া, এসব পদার্থ মাটিতে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করবে। যার ফলাফল হবে দীর্ঘমেয়াদি।
সম্পর্কিত খবর
সুন্দরবনের হারবাড়িয়া এলাকা হলো ইরাবতি ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র। তাছাড়া কুমিরের প্রজননেরও সময় এটা। পশুর নদীতে ডু্বে যাওয়া কার্গোর কয়লার বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হতে পারে। অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননও হুমকিতে পড়বে। একইসঙ্গে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী ভেতর থেকে আক্রান্ত হবে। কেবল প্রাণীই নয়, উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে কয়লার রাসায়নিক পদার্থ।
গত শনিবার (১৪ এপ্রিল) সুন্দরবনের হাড়বারিয়া এলাকায় ৭৭৫ মেট্রিকটন কয়লা নিয়ে এমভি বিলাস নামের কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। এতে ৭৭৫ মেট্রিকটন কয়লা ছিল। প্রাথমিক অবস্থা য়উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি শিপসা সেখানে পৌঁছে কার্গোটি উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর কার্গো উদ্ধারে নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
হাড়বাড়িয়ায় কয়লাসহ কার্গোডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) বিভাগীয় কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রাথমিক একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে সেই প্রতিবেদনে সুন্দরবন ও এর আশপাশের পরিবেশ ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কার্গো উদ্ধার হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শাহিন কবির।
সুন্দরবনের আশপাশের নদীগুলোতে কয়লা বা তেলবাহী কার্গো জাহাজডুবির ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় তেলবাহী ট্যাংকার এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন। ২০১৫ সালের ৩ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবে যায় সারবোঝাই কার্গো জাহাজ এমবি জাবালে নূর। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের শরণখোলার রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবতে ডুবতে অন্য কার্গোর সহায়তায় মোংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় আরেকটি কয়লা বোঝাই কার্গো। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবরেই সুন্দরবনের পশুর নদীতে ৫১০ মেট্রিন টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় এমভি জিয়া রাজ। পরের বছরের ১৯ মার্চ বিকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর ‘হরিণটানা’ বন টহল ফাঁড়ির কাছে ১,২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে এমভি সি হর্স-১ ডুবে যায়। ২০১৭ সালের ৪ জুন দিবাগত রাতে হারবাড়িয়া চ্যানেলে ৮২৫ টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল স্লাগসহ এমভি সেবা নামে আরেকটি কার্গো জাহাজ তলা ফেটে ডুবে যায়।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত নৌযান চলাচল নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। তার পরও বাধাহীনভাবে চলছে ফিটনেসবিহীন বিভিন্ন ধরনের নৌযান। গত শনিবার সুন্দরবনের পশুর চ্যানেলে জাহাজডুবির ঘটনা তদন্তেও উঠে এসেছে— কয়লাবাহী কার্গো জাহাজটি ছিল ফিটনেসবিহীন। জাহাজটিতে কয়লাও ছিল ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বা বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অবাধে ফিটনেসবিহীন নৌযান চলছে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আরো একবার প্রমাণ হলো।
গত শনিবার সুন্দরবনের ভেতরে পশুর চ্যানেলে কয়লাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি বিলাস ডুবে যাওয়ার ঘটনায় এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। তদন্ত প্রতিবেদনটি গতকাল জমা দিয়েছে কমিটি। তাতে বলা হয়েছে, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কয়লা পরিবহন ও ফিটনেস না থাকার কারণেই ডুবেছে জাহাজটি।