বিনিয়োগের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে: শাকিল রিজভী
ঢাকা স্টক একচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সদস্য এবং শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের এমডি মোহাম্মদ শাকিল রিজভী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শেয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। একাধিকবার ডিএসই’র সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইর সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনে ব্যাপক উত্থান ও ধসের সময় সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বপশ্চিম তার সঙ্গে কথা বলে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- ওমর ফারুক
পূর্বপশ্চিম: দেশে বর্তমান শেয়ার বাজার পরিস্থিতি কেমন?
সম্পর্কিত খবর
শাকিল রিজভী: মাঝখানে শেয়ার বাজারে সূচকের ব্যাপক পতন হয়েছিলো কিন্তু এখন ধীরে ধীরে সে ঘাটতি আবার পূরণ হচ্ছে। নতুন করে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার পরিস্থতি স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারের এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র, রাজনৈতিক, তারল্য সংকট, প্রা্ইভেট প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ না করা অনেকটা দায়ী বলে জানান তিনি। এছাড়াও ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেট, ব্যাংকের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার, স্থায়ী আমানতের সুদের হার বেড়ে গেলে পুঁজিবাজারের ক্ষতি হয়। তবে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল বাজার এ আশংকা ভুল কারণ আমরা স্থিতিশীল বাজার চাই না গতিশীল বাজার চাই।
পূর্বপশ্চিম: গতিশীল বাজারের জন্য ঘাটতি কোথায়?
শাকিল রিজভী: ঘাটতি আছে অনেক খাতে, তবে সবচেয়ে বড় ঘাটতি ব্যাংকিং খাতে। শেয়ার বাজার গতিশীল করতে হলে ব্যাংকিং সেক্টরের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং কাঠামো সুশৃঙ্খল হলে এবং বিনিয়োগ চ্যালেঞ্জে যত শৃঙ্খলা আসবে পুঁজিবাজার গতিশীলতা ফিরে আসবে। আর্থিক খাতগুলোতেও শৃঙ্খলা আসলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। তাছাড়াও পুঁজিবাজার হলো অর্থনীতির ব্যারোমিটার। ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করতে নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যাংক খাতে দেয়া এই সুবিধার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। তবে বিনিয়োগকারীরা না বুঝে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় যার কারণে সহজে ছিটকে পড়বে।
পূর্বপশ্চিম: তারল্য সংকট প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি?
শাকিল রিজভী: অর্থ বাজারে যে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছিল তা কেটে যাবে। শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংকের বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়ার যে শঙ্কা ছিল, সেটা হবে না। সেই সঙ্গে সুদের হারও কমে আসবে। আর সুদের হার কমলে পরোক্ষভাবে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক খাতের জন্য সরকার যে ছাড় দিয়েছে তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই এক ধরনের আস্থা সৃষ্টি করেছে।বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, সরকার যেকোনো উপায়ে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত শেয়ারবাজার ভালো রাখতে চাই। তারই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে।
পূর্বপশ্চিম: বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে ব্যাংকের করনীয় কি?
শাকিল রিজভী: এক্সপোজার লিমিটের ক্ষেত্রে সাবসিডারি কোম্পানির বিনিয়োগ, বন্ড এবং পুঁজিবাজারে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগের আওতায় না আনা এবং মার্ক টু মার্ক (মার্কেট প্রাইজে নয়, অভিহিত মূল্যে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট নির্ধারণ করা হলেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়বে। বাজারে গতি ফিরবে।
পূর্বপশ্চিম: কি কি বিষয় দেখে বিনিয়োগ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
শাকিল রিজভী: কোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার সময় আমি প্রথমে দেখি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে কে আছে, তার অডিটর কে এবং কোম্পানিটি যে খাতে আছে সে খাতের বর্তমান অবস্থা এবং সামনে কতটুকু প্রবৃদ্ধি হবে। তার পর তিনি দেখি বাজারে অন্য শেয়ারের তুলনায় ওই শেয়ারটি কম দামে বা অনেক দিন ধরে একটা দামে বিক্রি হচ্ছে কি না। তার সঙ্গে কেম্পানির ব্যবসা যদি ভালো হয়, ভালো লোক দিয়ে পরিচালিত হয় তখন সেই কোম্পানিতে আমি বিনিয়োগ করি। কোম্পানির ব্যবসা ভালো বলতে এর তৈরি পণ্যের বিক্রি ও কোম্পানির মুনাফায় প্রবৃদ্ধি এবং উত্পাদন বাড়ানোর নতুন পরিকল্পনা বোঝানো হয়।
এভাবে মনস্থির করে শেয়ার কেনার পরে যদি দাম কমেও যায় তাহলেও আমি নার্ভাস হই না। কারণ ওই শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও কোম্পানির ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার বিষয়ে আমি নিশ্চিত থাকি। বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমি দেখি আমি যেই কোম্পানির শেয়ার কিনছি, সেই কোম্পানির লোকগুলো আমার চেয়ে ভালো ব্যবস্থাপক কি না, অর্থাৎ আমি যদি কোনো ব্যবসা শুরু করি আমি যে সফলতা পাব, এই কোম্পানির ব্যবস্থাপকরা এর চেয়ে ভালো করতে পারবে কি না।
পূর্বপশ্চিম: পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
শাকিল রিজভী: যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন বা করেছেন বা ভবিষতে করবেন তারা এ বাজার সম্পর্কে জেনে-শুনে-বুঝে তারপরে বাজারে বিনিয়োগ করবেন। এ বাজারে শেয়ারের উত্থান-পতন থাকবেই।তাছাড়া তিনি বলেন, শেয়ারের দাম কমে গেলে সেটা বিক্রি করে দেয়া উচিত হবে না। বরং টাকা থাকলে তখন শেয়ার ক্রয় করবেন দেখা গেলো এক সময় না এক সময় শেয়ারের দাম বাড়বে তখন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বেশি দামে বিক্রি করবেন। এ ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের ধৈয্যশীল হতে হবে। রিক্স নিতে পারলে আপনারা (বিনিয়োগকারী) শেয়ার মার্কেটে আসা উচিত। কারণ শেয়ার বাজার হাই রিক্সের একটি স্থান। অল্প সঞ্চয় নিয়ে কেউ এ শেয়োর বাজারে বিনিয়োগ করবেন না কেননা এখানে লাভের পরিমাণ যেমন বেশি হয় তেমনি ঝুঁকির পরিমাণটাও বেশি। বিনিয়োগকারীদের পেনিক ভাব থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।
পূর্বপশ্চিম: পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন করুন?
শাকিল রিজভী: অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমানতালে পুঁজিবাজারের বাজার মূলধন না বাড়াকে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা বলে মনে করি। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশের পুঁজিবাজার বড় হয় নাই। পুঁজিবাজার যেমন দেশের অর্থনীতির চেয়ে বেশি বড় হওয়া ভালো না। আবার অর্থনীতি আগাবে কিন্তু পুঁজিবাজার বাড়বে না সেটাও ভালো না। অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজার বড় না হওয়ার কারণ ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি না হওয়া, বাজারে মানুষের আস্থার অভাব ও ভালো বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণের অভাব। দেখা যাচ্ছে, অনেকে কম মুনাফায় এখনো ব্যাংকে টাকা রাখছে, কিন্তু পুঁজিবাজারে আসছে না। যদিও আমাদের দেশে এখন ব্যাংকের চেয়ে পুঁজিবাজারে মুনাফা বেশি।