খালেদার আপিলে যেসব যুক্তি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার খালাস দাবি করে করা আপিলে বিচারিক আদালতের রায়কে অপরিপক্ক দাবিছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। মোট এক হাজার ২২৩ পৃষ্ঠার আপিল আবেদনে যুক্তি দেখানো হয়েছে ৪৪টি।
আপিল গ্রহণ করা হবে কি না, সে বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ রয়েছে। ওই দিনই খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
সম্পর্কিত খবর
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন। ১১ দিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি ১১৭৬ পৃষ্ঠা রায়ের অনুলিপি পান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আইনজীবীরা।
পরদিন এই রায় নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে বিএনপির আইনজীবীরা দফায় দফায় বৈঠক করেন। আর বিকালে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাটি করা হয়েছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে যে অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছিল, সেই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯১ সালে।
বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালের ৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের অনুদান হিসেবে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার বাংলাদেশে আসে। এটা জমা হয় প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে।
এই টাকা পরে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে পাঠান খালেদা জিয়া। সে সময় সেনানিবাসের মইনুল রোডে তার বাসভবনের ঠিকানায় খোলা হয় ট্রাস্ট। এর সেটেলার ছিলেন খালেতা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো এবং জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ছিলেন ট্রাস্টি। কিন্তু এতিমখানা না করে টাকাটা পরে মাগুরার সংসদ সদস্য কাজী সলিমুল হক কামালের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে এফডিআর করা হয়। পরে সে এফডিআর ভেঙে ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের নামে পাঠানো হয়।
রায়ে আদালত বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কীভাবে একটি বেসরকারি ট্রাস্টের দাপ্তরিক ঠিকানা হতে পারে তা বোধগম্য নয়। আদালত এমনও মনে করে যে, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল একটি সরকারি তহবিল। ওই তহবিলের টাকা এ দেশের এতিম ও এতিমখানার উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার বিধান আছে কিংবা থাকা উচিত ছিল।
রায়ে বলা হয়, সেসময় প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা অবস্থায় সরকারি প্রতিটি অর্থের হিসাবের জিম্মাদার ছিলেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা ট্রাস্টের হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছে, অথচ তিনি তা জানতেন না বলে যে দাবি করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
রায়ে আদালত বলেছে, দণ্ডিত আসামিদের পরস্পরের যোগসাজশে সরকারি এতিম তহবিলের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। খালেদা জিয়া সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও খালেদা জিয়াকে সরকারি এতিম তহবিলের ব্যাংক হিসাব খুলতে সহায়তা করেছেন এবং দুটি বেসরকারি ট্রাস্টের অনুকূলে সরকারি অর্থের চেক বেআইনিভাবে দিয়েছেন, যা অপরাধে সহায়তার শামিল।
আসামি তারেক রহমান, মমিনুর রহমান ও শরফুদ্দীন আহমেদ কৌশল অবলম্বন করে সরকারি এতিম তহবিলের টাকা পরস্পরের সহযোগিতায় আত্মসাৎ করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। আদালত মনে করে, এই মামলার ছয় আসামিই প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।
তবে আপিলে বলা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন। তাকে ‘প্রতিহিংসা’ থেকে ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার বিরুদ্ধে মামলার উদ্যোগ নেয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই মামলার অনুসন্ধানে প্রথমে মামলা করার মতো কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি বলেও দাবি করা হয় আপিলে। ওই অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামলার ৩২ নম্বর সাক্ষী তা স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করা হয় আপিলে।
আবেদনে বলা হয়, ‘এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকার সাধারণ নির্বাচন থেকে বিরত রাখার জন্য মামলাটি দায়ের করেছিল।’
আপিলে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় যে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিল সে বিষয়ে আসামিপক্ষের দাখিল করা নথি বিবেচনায় আনেনি বিচারিক আদালত। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের প্রদর্শিত নথি বিবেচনায় নিয়ে ‘অপরিপক্কভাবে’ বিচার শেষ করা হয়েছে।
আবেদনে বলা হয়, বিচারিক আদালত কোন ধরনের নথি এবং রেকর্ড ছাড়াই এবং কোন কিছু বিবেচনা না করেই ‘বেআইনি এবং অযৌক্তিকভাবে’ কামাল সিদ্দিকীর (সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব) দেয়া চিঠি এবং সিডি গ্রহণ করেছে। তবে ৩৪২ ধারার অধিনে খালেদা জিয়ার দেয়া ‘গুরুত্বপূর্ণ’ নথি গ্রহণ না করে বিচারেরর অপরিপক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে।
যুক্তিতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ফৌজদারী কারযবিধি ২২১, ২২২, ২২৩, ২৩৫ ও ২৩৯ ধারা লংঘন করে অভিযোগ গঠন করার অভিযোগও আনা হয়।
অবশ্য বিচার চলাকালে এসব যুক্তি নিয়েই উচ্চ আদালতে নানা আবেদন করেছিলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এর মধ্যে অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেও করা হয়েছিল আবেদন। কিন্তু সেসব আবেদন উচ্চ আদালত ফিরিয়ে দেয় হাইকোর্ট।
খালেদার খালাস চেয়ে আপিলে আরো বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া নিজের নামে কোন একাউন্ট খুলেননি। নিজে হিসাব পরিচালনা করবেন বা হালনাগাদ করবেন এ জাতীয় কোন তথ্যও নাই।
খালেদা জিয়া স্বাক্ষরিত কোন ফাইল বা চেক পাওয়া যায়নি বলেও উল্লেখ করা হয় আপিল আবেদনে। বলা হয় অর্থ স্থানান্তর সংক্রান্ত বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কোন আদেশ বা নির্দেশ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এসব বিষয় আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা। স্বীকার করেছেন বলেও জানানো হয় আপিল আবেদনে। বলা হয়, ‘এরপরও তার (তদন্ত কর্মকর্তা) জবানবন্দি বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করে সাজা দেয়া হয়েছে।
যুক্তিতে বলা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া এ সংক্রান্ত কোন ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেননি। তিনি ট্রাস্টিও নন। এবং তিনি কোনভাবেই ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রণ করেননি। এমনকি ট্রাস্টের তহবিল তিনি পরিচালনা করেননি।
যুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়ার পর দ্বিতীয় অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগের যথাযথ কোন কারণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপরও খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিয়ে যে রায় দেয়া হয়েছে তা বাতিলযোগ্য।
মঙ্গলবার বিকালে বিএনপির আইনজীবীরা হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট আদালতে আপিলটি করার পরই শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য যান দুদকের মামলার শুনানির জন্য নির্ধারিত বেঞ্চ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চে। এরপর আদালত আগামী বৃহস্পতিবার আপিলের গ্রহণযোগ্যতার উপর শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন।
সূত্র: ঢাকা টাইমস