• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

অরফানেজ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণ

খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী

প্রকাশ:  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:২৮ | আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:৩৫
পুর্বপশ্চিম ডেস্ক

অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গতিকে ব্যাহত করে, যার বাজে প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে সংক্রামিত হয়। তাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট্রের অর্থ পরস্পর যোগসাজসে আত্মসাতের মাধ্যমে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ৬ আসামিই রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধীন হিসেবে গণ্য হবে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসতের দুর্নীতির মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান এমনই অভিমত ব্যাক্ত করেছেন।

সম্পর্কিত খবর

    সোমবার বেলা সাড়ে ৪টার দিকে রায়ের অনুলিপি সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার কাছে হস্তান্তার করে রায় প্রদান কারী আদালতের পেশকার মো. মোকাররম হোসেন।

    এদিন দুর্নীতি দমন কামিশনকেও রায়ে অনুলিপি প্রদান করেন আদালত। কমিশনের পক্ষে মোশারফ হোসেন কাজল অনুলিপি গ্রহণ করেন। অনুলিপি গ্রহণের পর এক প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, ‘কমিশন আপিল করবে কি না এ সম্পর্কে এখনো আমাদের কিছু বলে নাই। আমরা রায়ের অনুলিপি এখন কমিশনকে প্রদান করবো। এরপর তারা যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমরা সেভাবে অগ্রসর হব।’

    রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘অনুলিপি আমরা উচ্চ আদালতে নিয়ে যাব। সেখানে আপিল প্রস্তুত হওয়ার পর আপিল দাখিল করব।’

    এর আগে সোমবার দুদুর থেকে সানাউল্লাহ মিয়ার নেতৃত্বে ওই আদালতে অনুলিপি পাওয়ার জন্য বসে থাকেন।

    রায়ের পর্যবেক্ষনে বলা হয়, এই মামলার আসামিগণকর্তৃক পরষ্পর যোগসাজসে সরকারী এতিম তহবিলের ২ কোটি, ১০ লাখ, ৭১ হাজার, ৬৪৩/৮০ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। পরিমানের দিক থেকে উহার বর্তমান বাজার মূল্য অধিক না হলেও তর্কিত ঘটনার সময়ে ওই টাকার পরিমান অনেক বেশি ছিল। আসামিগণের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া ওই সময়ে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আসামি কাজী সলিমুল হক কামাল সংসদ সদস্য ছিলেন। আসামি কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী সরকারী কর্মচারী হয়েও আসামি বেগম খালেদা জিয়াকে সরকারী এতিম তহবিলের ব্যাংক হিসাব খুলতে সহায়তা করা এবং পরবর্তীতে ওই হিসাব থেকে ২টি প্রাইভেট ট্রাস্টের অনুকূলে সরকারী অর্থের চেক বেআইনীভাবে প্রদান করায় বর্ণিত ২ জন আসামিকে অপরাধ করতে সহায়তার সামিল।

    আরও বলা হয়েছে, আসামি তারেক রহমান, মমিনুর রহমান ও শরফুদ্দিন আহমেদ কৌশল অবলম্বন করে সরকারী তহবিলের টাকা একে অপরের সহযোগীতায় আত্মসাত করতে প্রত্যাক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। এর মাধ্যমে এই মামলার ৬ জন আসামির প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে লাভবান হয়েছেন মর্মে অত্র আদালত মনে করেন। আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবেও গণ্য হবেন। অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে এবং উহার বাজে প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তবে সংক্রামিত হয়।

    দুই ধারার অপরাধ প্রমানিত হলেও একটি ধারায় দণ্ড প্রদান সম্পর্কে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে খালেদা জিয়া ও ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী মিনস রিয়ো (Mens reo) নিয়ে সরকারি এতিম তহবিলের টাকা দুই ভাগে ভাগ করে দুইটি ট্রাস্টের অনুকূলে হস্তান্তর করেন যার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট অন্যতম। ঐ ট্রাস্টে ১৯৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা স্থানান্তরের পর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর সেখানে জমা হয়।

    আসামি তারেক রহমান ও মমিনুর রহমান ট্রাস্টের নামীয় এসটিডি ৭ নং হিসেব থেকে টাকা উত্তোলন করে প্রথমে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় ২ দশমিক ৭৯ একর জমি কেনেন। অবশিষ্ট টাকা প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থানান্তর করেন। তৎপরবর্তীতে কাজী সালিমুল হক কামাল ও গিয়াস উদ্দিনের হাত হয়ে আসামি শরফুদ্দিনের হাতে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬শ ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা চলে যায় এবং তা আত্মসাৎ করা হয়।

    এগুলো সবই আসামিদের মিনস রিয়ো ইঙ্গিত করে। ফলে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (১) ধারায় বর্ণিত ক্রিমিনাল মিসকনডাক্ট এর উপাদান যেমন এই মামলায় উপস্থিত আছে, ঠিক তেমনি আসামিদের মিনস রিয়োসহ রংফুল গেইন এর উদ্দেশ্য বর্ণিত পরিমান টাকা বিভিন্ন পন্থায় রূপান্তর করে আত্মসাৎ করেছেন মর্মেও আদালত মনে করেন।

    খালেদা জিয়া এ মামলায় আত্মপক্ষ শুনানিতে বক্তব্য প্রদানের সময় নিজ জবানীতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ফলে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় তাকে শাস্তি দিতে কোনো বাঁধা নেই। আদালত মনে করেন, আসামিরা একে অপরের সহায়তায় যেভাবে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার একটি প্রিসামটিভ ভেল্যু (presumptive value) রয়েছে এবং যা এই মামলা নিষ্পত্তির জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

    আরও বলা হয়, আসামিদের মধ্যে একজন ব্যতীত অপর সবাই সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্তে¡ও অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে সরকারি এতিম তহবিলের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাৎ করেন।

    দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার বিধান পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, ঐ ধারায় সংঘটিত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যে কোনো বর্ণণার কারাদণ্ড বা যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ড যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং অর্থদণ্ড দণ্ডনীয় হওয়ার বিষয়েও বিধান রয়েছে।

    প্রসিকিউশনপক্ষ থেকে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় আসামি খালেদা জিয়া, তারেক রহমান , মমিনুর রহমান, কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে কাজী কামাল এবং ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী উভয় আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার অধীনে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট এর ২৬ ধারার বিধান বিবেচনায় গ্রহণ করে পূর্বে বর্ণিত ৫ আসামিকে যে কোনো একটি আইনে দণ্ডিত করে আদেশ প্রচার করা বিধেয় হবে বলে আদালত মনে করে।

    সকল আসামি সরকারী কর্মচারী এবং মর্চেন্ট কিভাবে হলো এ সম্পর্কে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দন্ড বিধির ৪০৯ ধারার বিধান পর্যালোচনায় লক্ষ্যে করা যায় যে, এই ধারায় কোনো ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করতে হলে তাকে সরকারি কর্রচারী, ব্যাংকার, মার্চেন্ট বা এজেন্ট হতে হবে।

    পূর্বেই লক্ষ্য করা গেছে যে, এই মামলায় আসামি খালেদা জিয়া এবং কাজী সালিমুল হক ওরফে কাজী কামাল ঘটনার সময় জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদ সদস্য বিদ্যামন আইন অনুসারে সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন। আলোচনা ইহা লক্ষ্য করা গেছে যে, আসামি তারেক রহমান এবং মমিনুর রহমান প্রাইভেট ট্রাস্ট এবং ট্রাস্টি হলেও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুসারে ট্রাস্টিগণ সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন।

    আসামি শরফুদ্দীন আহমেদ মার্চেন্ট বা এজেন্ট হিসাবে গণ্য হন। ফলে তাদের সকলের বিরুদ্ধে দন্ড বিধির ৪০৯ ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে বলে এই আদালত মনে করেন। সরকরি এতিম তাহবিলে ২কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬শ ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের আসামিদের একে অপরের সহায়তা করায় দন্ড বিধির ৪০৯/১০৯ ধারার বিধান মোতাবেক সকলে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য মর্মে এই আদালত মনে করেন।আসামি শরফুদ্দীন আহমেদ ব্যতীত সকল আসামি সরকারী কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় প্রয়োগযোগ্য বলেও এই আদালত মনে করেন।

    আসামি শরফুদ্দীন আহমেদের ক্ষেত্রে ঐ আইনের ৫(২) ধারা প্রয়োগযোগ্য না হলেও দন্ড বিধির ৪০৯/১০৯ ধারা প্রয়োগযোগ্য হবে। ফলে এই আসামি ছাড়া অপর আসামিদের ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সানের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ৫(১) ধারায় বর্ণিত সকল শর্তাবলী প্রযোজ্য হবে বলে এই আদালত মনে করেন।

    যুক্তিতর্ক শুনানীর সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী মওদুদ আহমদ বর্ণনা করেন যে, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(১) ধারায় বর্ণিত ৫টি শর্ত ঐ আসমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে তিনি তার আলাচনার এক পর্যায়ে বলেছেন যে, তর্কেও খাতিরে হলেও ঐ আইনের ৫(১) (ডি) ধারায় বিধান প্রয়োগ করতে চাইল উহার শর্তাবলী প্রসিকিউশন পক্ষের আসামি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রমান করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বিঞ্জ কৌশুলী উক্ত বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলা যায়। কেননা উক্ত ধারায় আইনের ৫(১)(ডি) ধারায় বিধান এই মামলায় প্রয়োগ করা যায়।

    রায়ে ৫ ও ১০ বছর দণ্ড প্রদানের বিষয়ে বলা হয়, দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ড যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। আসামিগণ একে অপরের সহযোগীতায় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন এবং সেকারণে তাদের সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। তবে আসামিদের বয়স ও সামাজিক অবস্থা এবং আত্মসাত কৃত টাকার পরিমান বিবেচনায় গ্রহণ করে তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা সমিচীন হবে না মর্মে অত্র আদালত মনে করেন।

    আসামিদের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া এদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধী দরীয় নেতা ছিলেন। তাছাড়া তিনি একটি রাজনৈতিক দলের কর্ণধর। তিনি একজন বয়স্ত মহিলা। ফলে তার শরীরিক অবস্থা, বয়স, এবং সামাজিক পরিচয় বিবেচনা করে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় তাঁর ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা সমিচীন বলে মনে হয়।

    বাকী ৫ আসামিকে তাদের বয়স ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা উচিত মর্মে এই আদালত মনে করেন। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় আসামিকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সশ্রম বা বিনাশ্রম দণ্ড স্পষ্ট উল্লেখ নেই। সেখানে শুধু দণ্ডের কথা উল্লেখ আছে।

    এমতাবস্থা আইনের ব্যাখার সূত্র অনুসারে সকল আসামিকে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত করা প্রয়োজন। তবে যে টাকা আত্মসাত করেছেন তা জরিমানা দণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।

    রায়ের আদেশে সকল আসামির দণ্ডের পাশাপাশি ২ কোটি, ১০ লাখ, ৭১ হাজার, ৬৪৩/৮০ টাকা অর্থদণ্ডের পাশাপাশি উক্ত অর্থ রাষ্ট্রের অনুক’লে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যা ৬০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রর অনুকূলে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রস্টের নামীয় সোনালী ব্যাংক, গুলশান নিউ সর্কেল শাখায় রক্ষিত এসটিডি-৭ নং হিসাবে জমাকৃত সাকুল্য টাকা রাষ্ট্রর অনুকুলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

    আত্মসাতকৃত টাকা দিয়ে ট্রাস্টের নামে জমি ক্রয় সংক্রান্তে আসামি পক্ষের দাবী বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামি শরফুদ্দিনের কাছ থেকে ট্রাস্টের নামে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ জমি কেনার বয়না করার দাবী করেন আসামিপক্ষ। আসামি শরফুদ্দিন ওই জমির মালিক মর্মেও দারী করা হয়। কিন্তু আশুলিয়া মৌজার ওই জমির কোন দলিল আদালতে দাখিল করতে পারেন নাই। ফলে ধরে নেওয়া যায় যে, আসামি শরফুদ্দিন আদ্যাও ৭৪ দশমিক ৫ শতক জমির মালিক ছিলেন না। ওই জমি ক্রয়ের জন্য জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সাথে তার কোনদিন কোন বায়না চুক্তিও হয়নি। আসামি শরফুদ্দিন মানি মামলায় মিথ্যা সোলেনামা দাখিল করে সরকারী এতম তহবিলের অর্থ আত্মসাৎে করার প্রক্রিয়া মিথ্যা প্রমান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

    আরও বলা হয়, আসামি শরফুদ্দিনের কাছ থেকে বায়নার টাকা আদায়ের মানি মামলাটি একটি সৃজিত মামলা বলে অত্র আদালত মনে করেন এবং উহা অত্যন্ত কৌশলে আইনকজীবী এমএম মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতে দাখিল করেন। সত্যিকার অর্থেই যদি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং আসামি শরফুদ্দিনের মধ্যে জমি কেনা বেচার বয়না চুক্তি সম্পাদিত হতো এবং চুক্তির মেয়াদের মধ্যে আসামি শরফুদ্দিন যদি বায়নার টাকাসহ জমির সাকুল্য মূল্য গ্রহণ করে দলিল সম্পাদন করে দিতে ব্যর্থ হয় তবে সে ক্ষেত্রে ট্রাস্ট্রের পক্ষে আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকনের উচিত ছিল সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে মামলা করা। কিন্তু তিনি তা দায়ের না করায় এটা ধরে নেওয়া যায় যে, তারা প্রকৃতপক্ষে জমির কোন কেনা বেচার চুক্তি আসামি শরফুদ্দিনের সঙ্গে সম্পাদন করেন নাই। তাই মানি মামলাটি একটি দূরভিসন্ধিমূলক মামলা মর্মে ধরে নেওয়া যায়।

    রায়ে বলা হয়, আসামি পক্ষ দাবী করে যে, ক্রিমিনাল বিচ অব ট্রাস্ট এর ক্ষেত্রে ক্রিমিনাল মিসএপ্রোপ্রিয়েশন অব প্রপারটি এবং ইনট্রাস্টমেন্ট প্রমান করতে হয় কিন্তু এই মামলায় উক্ত উপাদানোর কোনটিই নাই। কিন্তু নথি পর্যালোচনা করে অত্র আদালত মনে করে যে, ইউনাইটেড সৌদি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলারের ডিডি নিজ দললে নেয়ার মাধ্যমে উহার উপর আসামি খালেদা জিয়ার ডমিনিয়ন চলে আসে এবং পরবর্তীতে উক্ত টাকা হিসাবে জমা রাখা এবং আরও পরে উহা এফডিআর করে রাখার ফলে ওই টাকার উপর তার ইনট্রাস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত টাকা যখন দুই ভাগ করে তিনি তাঁর সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর মাধ্যমে -বে-সরকারী দুইটি ট্রাস্টের অনুক’লে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা করে প্রদান করলেন তখন তিনি ক্রিমিনাল মিসএপ্রোপ্রিয়েশন অব প্রপারটি এর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন মর্মে অত্র আদালত মনে করেন। কেননা সরকারী এতিম তহবিলের টাকা দেশে প্রতিষ্টিত এতমখানায় বসবাস কিংবা সরকারী অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এতিমখানায় অবস্থান করা এতিমদের জন্য খরচ করা উচিত ছিল। কিন্তু আসামি বেগম খালেদা জিয়া তা করতে ব্যর্থ হন।

    রায়ে আরও বলা হয়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নামে কোন কোন এতিমখানার অস্তিত্ব আজ অবদি পাওয়া যায় নাই। সেখানে কোন এতম বসবাস করে না। এতিমখানার দালান কোঠা বা স্থাপনা নেই। ৬, মইনুল রোড, ঢাকা সেনানিবাস কিংবা বগুড়া জেলার গাবতলী দাড়াইল মৌজায় ওই ট্রাস্টের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। একই দিনে অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ১৭টি দলিলের মাধ্যমে ওই ট্রাস্টের নামে ক্রয়কৃত ২ দশমিক ৭৯ একর জমি আজ অবধি ধানী জমি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

    কাজেই আসামি খালেদা জিয়া আইন ভঙ্গ করেন নাই মর্মে আসামি পক্ষের যুক্তি সঠিক নয়। আসামি পক্ষ থেকে দাবী করেন যে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৬ কোটি টাকার উর্দ্ধে হয়েছে। টাকা খরচ করা হয় নাই। উহার বহু গুনে বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রিমিনাল মিসএপ্রোপ্রিয়েশন অব প্রপারটি হয় নাই। কিন্তু আসামি পক্ষের উক্ত যুক্তি আইনের মাপকাঠতে টেকে না। কেননা সরকারী অর্থ অনিধারিত সময় ধরে খরচ না করে আটক রাখা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় শান্তিযোগ্য অপরাধ। এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের দুর্নীতির মামলায় ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ৫ বছর কারাদণ্ড প্রদান করে কারাগারে পাঠানো হয়। রায় ঘোষণার পর ওইদিনই খালেদা জিয়ার পক্ষে রায়ের অনুলিপি চেয়ে আবেদন করা হয়। এরপর গত ১২ ফেব্রুয়ারি অনুলিপির জন্য ৩ হাজার পৃষ্ঠা কোর্ট ফলিও স্টাম্প আদালতে দাখিল করেন খালেদার আইনজীবীরা। এরপর গত রোববার ওই আদালতের রায়ের অনুলিপি না পাওয়ার বিষয়ে বিচারককে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অবহিত করলে বিচারক সোমবার দিবে বলে জানান। সে অনুযায়ী সোমবার রায়ের অনুলিপি দিলেন আদালত।

    উল্লেখ্য, মামলাটিতে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৫ আসামি ১০ বছর করে কারাদণ্ডও প্রদান করা হয়। এছাড়া রায়ে আসামিদের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা জরিমানা করা হয়। দণ্ডিত অপর ৪ আসামি হলেন, সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। দণ্ডিতদের মধ্যে তারেক রহমান, কামাল সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান পলাতক রয়েছেন।

    সূত্রঃ আমাদের সময়

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close