• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী: শিক্ষামন্ত্রীকে সরান, কালো আইন করবেন না

প্রকাশ:  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৫৭ | আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:০১
পীর হাবিবুর রহমান

শিক্ষামন্ত্রীর বরখাস্ত চেয়ে সোমবার জাতীয় সংসদে বক্তৃতা করেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, শিক্ষামন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অথবা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন, তাকে বরখাস্ত করতে। ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় কয়েকদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ঘরে ফিরেছি ক'দিন হলো। এখনো দৌঁড়ঝাপ শুরু করতে পারিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। ছুটে বেড়ানো মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক বিশ্রাম জেলবন্দী কয়েদীর জীবন লাগে। নিজেকে সে রকম গৃহবন্দীই মনে হচ্ছে। কিন্তু একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক হিসেবে জীবনের দীর্ঘ সময় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে অন্দর মহলে একাত্ম হয়ে যেভাবে ছুটে বেড়িয়েছি, তাতে হৃদয়-মন স্বাভাবিকভাবে আলোড়িত হয়। রাজনৈতিক ঘটনাবহুল বাংলাদেশে আবেগ তাড়িত মানুষকে খুব সহজেই আলোড়িত করে। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সমাজ জীবনে প্রতিটি ঘটনা নাগরিক জীবনে ঢেউ তুলে। মানুষকে ভাবায়, কথা বলায়, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সর্বত্র।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনী বছরে এসে পদ্মাসেতুর মতো চ্যালেঞ্জ শেষ করার পথে হাঁটছেন। ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্রপট দৃশ্যমান করে শেখ হাসিনা সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ:)-এর মাজার জিয়ারত করে জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার সূচনা ঘটিয়েছেন। মন্ত্রীসভায়ও একটা ছোটখাট রদবদল এনে সরকারের কর্মকাণ্ডে গতি আনার চেষ্টা করেছেন। কথায় বলে একটি বাগান নষ্ট করার জন্য একটি বানরই যথেষ্ট। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনায় সরকারের সকল অর্জন ধূলোয় মিশে যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ব্যর্থ নেতৃত্বের হাত ধরে শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র অব্যাহত প্রশ্ন পত্র ফাঁস জনমনে হতাশা-ক্ষোভ থেকে অবসাদ এনে দিয়েছে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা এই পরিপাটি অযোগ্য শিক্ষামন্ত্রীর হাত ধরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যে মন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পারেন না, তিনি আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষা দূরে থাক, শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি দূরে থাক, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল ধারায় ফিরিয়ে আননে কি করে? এমন কোনো পরীক্ষা নেই ছোট-বড় সবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে না। কখনো তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, কখনো শিক্ষকদের অভিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে নিজের পাহাড় প্রমাণ ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চাইছেন।

সম্পর্কিত খবর

    নুরুল ইসলাম নাহিদকে শুরু থেকেই একজন সৎ-আদর্শিক মন্ত্রী হিসেবে জনগণের সামনে মেকাপ মেরে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছেন সমাজের সর্বত্র ছড়ানো এককালের কমিউনিস্টগণ। অথচ ২০০৮ সালে গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা তাকে টানা নয় বছর শিক্ষমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখলেও তিনি সময়মতো স্কুলে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ আর ভুলবাল প্রশ্নপত্র লেখার পরেও গণহারে ছাত্রছাত্রী পাসের রেকর্ড সৃষ্টি করে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন। শিক্ষাবভন থেকে মন্ত্রণালয় হয়ে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতি শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাহুগ্রাসে পরিণত করেছে। শিক্ষামন্ত্রী শুরু থেকেই ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা গণমাধ্যম থেকে সমাজ জীবনে নৈতিক অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন। সেই শুরু থেকে তার একান্ত সহকারী মনমথ বাড়ৈকে ঘিরে অভিযোগের ঝড় উঠেছে। গণমাধ্যমে বিতর্ক উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাকে সরাননি। তাকে পরবর্তীতে অনেক বিলম্বে সরালেও শিক্ষা বিভাগে দায়িত্বশীল পদে রেখেছেন।

    সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহাকারী মোতালেব অঢেল অর্থ-সম্পদ উপার্জনে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলায় গ্রেফার হয়েছেন। বাড়ির অন্দর মহল পর্যন্ত এই মোতালেবের যাতায়াত ছিল এমন খবর চাউর হয়েছে। এই মোতালেব বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সচিবালয়ে বিএনপি দলীয় কর্মচারীদের সক্রিয় দলীয় নেতা ছিল। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে শিক্ষামন্ত্রী যদি এত নীতিবান ও সৎ হয়ে থাকেন, তাহলে তার চতুর্দিকে দুর্নীতিগ্রস্তরা বহাল তবিয়তে দাপটের সঙ্গে লাফ-ঝাপ করে কী করে?

    শিক্ষমন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার বা তৃণমূল সন্তানদের শিক্ষার আওতায় আনার যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, সেটি মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং পদক্ষেপের ফসল। ছাত্রইউনিয়নের রাজনীতি দিয়ে উঠে আসা শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ ভাঙন কবলিত কমিউনিস্ট পার্টির দন্তহীন সাধারণ সম্পাদক হলেও জাতীয় রাজনীতি বা তার নির্বাচনী এলাকায় তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। নিজের রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যুক্ত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে পথের সাথী না পাওয়ায় ৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ তাকে দিতে দিতে নয় বছরের শিক্ষামন্ত্রণালয়ই দেয়নি, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যও করেছে। কিন্তু না সরকারের জন্য ভাবমূর্তি উজ্জল করেছেন, না দলীয় রাজনীতিতে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছেন। তার নির্বাচনী এলাকায় বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার হাতে গড়া আওয়ামী লীগ কর্মীদের সরিয়ে নিজস্ব বলয় করতে গিয়ে একজন নাহিদ নিজেকেই দুর্বল করেছেন।

    সিলেট বিভাগে অতীতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্তরা। সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আলম। ওয়ার্কিং কমিটি থেকে উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজীর মতো আাজীবন আওয়ামী লীগার। এই সব ফুলটাইম রাজনীতিবিদগণ সিলেট বিভাগে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বাম রাজনীতি থেকে এলেও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে নিজেকে একাত্ম করে যুক্ত করেছিলেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া দূরে থাক, ছাত্রলীগ প্রশ্নে নিজেকে ব্রাক্ষ্মণ জাতীয় মনে করেন। আওয়ামী রাজনীতিতে না এলে একজন নুরুল ইসলাম নাহিদের পক্ষে সংসদ নয়, স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সৌভাগ্য হত না। আওয়ামী লীগ তার জীবন ভরে দিলেও সরকার ও দলকে তিনি কতটা দিতে পেরেছেন, সেই প্রশ্নের বড় প্রশ্ন আজকের সামগ্রিক মানুষর আলাপ-আলোচনার মধ্যে নিজেকে ইতিহাসের ব্যর্থ শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

    সরকার নিয়ন্ত্রিত সংসদে আজকে তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। পদত্যাগ না করলে তাকে বরখাস্ত করার অনুরোধ উঠেছে। ২০১২ সাল থেকে এমন কোনো পরীক্ষা নেই, যেখানে আগাম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি। এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে ফলাফলে তিনি তৃপ্তির হাসি হাসলেও শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। আজকের সরকার ও আওয়ামী লীগে নুরুল ইসলাম নাহিদ একজন ব্যর্থ মানুষের বোঝা হন না হন, জাতীয় জীবনে ব্যর্থ শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বার্থে এই বোঝা বহনযোগ্য নয়। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদকে সরিয়ে এমন একজন দক্ষ শিক্ষামন্ত্রী সময়ের দাবি। যিনি শিক্ষা ব্যবস্থা ঘিরে সকল অনিয়ম প্রতিরোধ করে মানুষের সামনে আশার আলো দেখাতে পারেন। নিতে পারেন সাহসী চ্যালেঞ্জ। সততায়-দক্ষতায়, ব্যক্তিত্বে ও নেতৃত্বে কঠোর একজন শিক্ষামন্ত্রী এই মুহূর্তে সময়ের দাবি।

    সাবেক ডাকসু জিএস ও মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন বাবলু সংসদে যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সাধারণ মানুষের আত্মার ডাক প্রতিধ্বনিত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর রতন সিদ্দিকী নামের একজন কলেজ শিক্ষককে নুরুল ইসলাম নাহিদ কাছে টেনেছিলেন। সেই সময়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য তার লেখা একটি বই ইতিহাস বিকৃতির দায়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। তিনি বইটিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে দিশেহারা জাতির সামনে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আবির্ভূত করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী সংস্করণে দায়সারাভাবে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের জায়গায় স্বাধীনতার ঘোষক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বসিয়েছিলেন মাত্র। সেই ঘটনা নিয়ে উচ্চ আদালতেও মামলা ঝুলছে। কিন্তু এককালের ছাত্রইউনিয়নের কর্মী সিদ্দিকীকে শিক্ষামন্ত্রী পদোন্নতি দিয়ে কারিকুলাম বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য করে কাছেই রেখেছেন।

    সরকারে অনেক সৎ মন্ত্রী ও আমলা রয়েছেন। যারা দক্ষতায় ও অভিজ্ঞতায়, সামজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাব রাখেন। তাদের জন্য কোনো সিন্ডিকেটকে যেমন কোরাস গাইতে হয় না; তিনি সৎ তিনি সৎ, তেমনি তাদের চারপাশেও বিতর্কিত মুখ লাফ-ঝাপ করে না। দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই শিক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটি নিতে হবে। কারণ আমাদের সমাজে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কেউ পদত্যাগ করেন না। যদিও এদেশের রাজনীতিতে বিএনপি জামানায় শিল্পমন্ত্রী জহির উদ্দিন খান আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের প্রখরতা নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনার ৯৬ শাসনামালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছিলেন মরহুম জিল্লুর রহমান। বয়সের কারণে দুপুরের আগেই তিনি সচিবালয় থেকে চলে আসতেন।

    প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন। কিন্তু তার বক্তব্য অনুযায়ী অসুস্থাজনিত কারণে একান্ত সচিবের ভুলে লাল পাসপোর্টেও জায়গায় জমা না দেওয়া সবুজ পাসপোর্টে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ায় বিতর্কের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন। সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় চালানোর দক্ষতা বা যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তবুও গণমাধ্যম বিতর্কে পদত্যাগ করেন। আজকে ৭০ বারের বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানামুখী ব্যর্থতার উপর টানা নয় বছরের বোঝা নুরুল ইসলাম নাহিদকে ঘিরে জনমনে যে অসন্তোষ, অভিযোগ গণতন্ত্রের নেত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার তা বিবেচনায় নেওয়া সময়ের দাবি।

    এদিকে হাসপাতালের শয্যায় বসে মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনুমোদিত খসড়া নিয়ে বিতর্কের ঝড় পর্যবেক্ষণ করেছি। উপভোগ করতে পারিনি। অস্থিরতায় হাসফাঁস করেছি। যে ৫৭ ধারা বাতিল চেয়ে এতো লিখেছি, এতো বলেছি, সেখানে এই খসড়ায় ৩২ ধারায় যে আইন ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাত মনে হয়েছে ৫৭ ধারা যদি হয়ে থাকে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য সূতোর ফাঁস, তাহলে ৩২ ধারা হচ্ছে লোহার ফাঁস। এই ফাঁস নিয়ে গণমাধ্যম যেমন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। মানুষ তেমনি বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বুকভরা শ্বাস নিতে পারে না।

    একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেই সত্যানুসন্ধানী বা সত্য উদঘাটনে নিয়োজিত নাগরিক গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে জেল-দণ্ড ভোগ করবেন, সেটি সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। এরমধ্যে অবাক হয়ে যাই যখন দেখি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ৬৯-এর নায়ক তোফায়েল আহমেদের মতো রাজনীতিবিদের বরাত দিয়ে একটি নিউজ পোর্টাল খবর দিয়েছে যে, তিনি বলেছেন, এমপিদের ইজ্জত রক্ষায় এ আইন করা হয়েছে। প্রতিটি শাসনামালে জেল খাটা রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এবং স্নেহ কুড়ানো তোফায়েল আহমেদ এমন কথা বলতে পারেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। ব্যক্তিগত বিচারবোধ থেকেই হাসপাতালের শয্যা থেকে তাকে টেলিফোন করি। পরের দিন তিনি সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন তার বক্তব্যকে একটি নিউজ পোর্টাল বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। বাকি সবাই সত্যের উপর দাঁড়িয়েছিল। তার বক্তব্য আমাকে অভিভূত করে। আর দায়িত্বহীন গণমাধ্যমের ভূমিকার জন্য নিজেকে লজ্জিত করে।

    গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কেউ যেমন আইনের ঊর্ধ্বে নন, তেমনি রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম কর্মী দায়িত্বশীলতার জায়গাটি এড়াতে পারেন না। সংবিধান চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দিয়েছে। অসত্য ও মিথ্যার আশ্রয়ের সড়ক খুলে দেয়নি। আওয়ামী লীগের মতো আজীবন মানুষের অধিকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ের জন্য নিবেদিত একটি দল তার নেত্রী যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি জীবনের ৩৭টি বছর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার আমলে গণবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৩২ ধারা বহাল হতে পারে না।

    তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গেও তিনি কথা বলবেন। এটি সংসদে উত্থাপনের পর কমিটিতে যাচাই-বাছাই হয়ে বিল আকারে আসবে। আমরা আশা করব, এই প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে এই কালো আইন করবেন না। এই আইন গণতান্ত্রিক স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্যই নয়, রাজনৈতিক শক্তির জন্যও বুকের কাঁটা হয়ে বিধবে।

    এর মধ্যে আবার বড় ধরনের ব্যাংক লুটের জালিয়াতি ফাঁস হয়েছে। বড় বড় গবেষণা আর সুন্দর সুন্দর কথার বরপুত্র অধ্যাপক আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে এক ব্যক্তিকে ছয় বছরে ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণ সুবিদা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের মোট মুলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার। মুলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ আছে। সেখানে এক গ্রাহক ৭ শত ৫০ কোটি টাকার ঋণ নিতে পারেন না। অথচ বারাকাত পর্ষদ হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারীর রেকর্ড ভঙ্গ করে এই ঋণ দিয়েছেন। বারাকাতের সঙ্গে সেদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিরোধে সৎ মুহিতের পক্ষেই আমি অবস্থান নিয়েছিলাম বিবেকের তাড়নায়। আজ শান্তি পাচ্ছি।

    বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে যখন দেখা হয়, নিজেকে অপরাধী লাগে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় একজন সৎ-ভদ্র লোক আতিউরের পদত্যাগ ছাড়া জাতির কপালে কিছু ঝুটল না। ব্যাংকিং খাতে এতো কেলেঙ্কারী ঘটল। না হলো সংস্কার কমিশন, না উন্মোচিত হলো নেপথ্যের মুখ। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারীতেও দায়ীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হলো না ব্যবস্থা। গোটা অর্থনৈতিক খাত এক অনিশ্চিত ভঙ্গুর অবস্থায় পতিত। ব্যাংকিং খাতের সর্বগ্রাসী রুগ্ন দশা মানুষকে বিচলিত করছে। যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, সেকেন্ড হোম করেছেন, তাদের জীবনই যেন নিরাপদ। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-৭৩ দিয়েছিলেন একজন উদার গণতন্ত্রী হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্তই নন, বিভিন্ন বাণিজ্যিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিয়োগও নিচ্ছেন। আর একেকটি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া করে আসছেন। ক্যাম্পাসে মারামারি করছেন। ছাত্রদের লাঠিয়ালে পরিণত করছেন। সরাসরি দল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হচ্ছেন। সেদিন যে ড. এমরান যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মাঠে-ময়দানে কাজ করেছেন, তিনি এখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে অনেক জায়গায় সংস্কারে হাত দেওয়ার সময় এসেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ থেকে যে সব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যয় শিক্ষক বা ব্যক্তি রাজনৈতিক নিয়োগ নিয়ে চেয়ারম্যান-পরিচালক হয়েছিলেন, তাঁদের সকলের সম্পদের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থনৈতিক খাতকে নয়-ছয়ের মাধ্যমে যারা তছনছ করে দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। এতো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ সুবিধাবাদী, মতলববাজ, নষ্ট ও লুটেরাদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অগাধ সম্পদ গড়ার চারণভূমিতে পরিণত হতে দেওয়া যায় না।

    হাসপাতাল থেকে যেদিন রিলিজ নেব, হাইডোজ এন্টিবায়োটিক ইনজেকশনে শরীর তখন দুর্বল। সকালে ঘুম থেকে উঠেছি মাত্র। নাস্তা শেষ করিনি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ থেকে অগ্রজ বন্ধু রাজনীতিবিদ আ ত ম মিসবাহ টেলিফোনে অবিশ্বাস্য দুঃসংবাদ শোনালেন। তার ছেলেবেলার বন্ধু জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জের টানা দুবারের নির্বাচিত মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল ঢাকায় অকালে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। অবিশ্বাস্য এ সংবাদ বিচলিতই করেনি, ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ হাঁটা একজন অসাম্প্রদায়িক সাহসী এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুসংবাদ রীতিমতো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। রাজনীতি করতে গিয়ে প্রতিবাদের ধারায় আজীবন পথ চলা আইয়ুব বখত জগলুল সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস, ভিপি ও তরুণ বয়সে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা একটি শহর বাকরূদ্ধ হয়ে গেলো। স্বজন হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদে উঠল। তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দৃষ্টিনন্দন পৌরসভাই উপহারই দেননি। নীরবে-নিভৃতে কাজের মধ্য দিয়ে গণমানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল। নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে জীবন-যাপন করলেও নিয়তির অমোঘ বিধান অকালেই তাকে চলে যেতে হয়েছে। লাখো জনতা অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকে বিদায় করার মধ্য দিয়ে দেখেছে, একজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অকাল বিদায় কি গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর সঙ্গে কয়েক বছর ধরে আমার যে গভীর হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে হৃদয়-মন দিয়ে আমি তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

    লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ

    সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close