বাসে শ্লীলতাহানি চেষ্টার সত্য গল্প
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। সকালে বাসে ভিড় থাকে কম। এমনই এক শুক্রবারের সকালে বাসে উঠলাম, যাত্রীরা আয়েশ করে বসে আছেন। কাউকে বিরক্ত না করে অভ্যাসবশত: একবারে পিছনের সিটে গিয়ে বসলাম। কারণ, নিয়মিত চলাচলের অভিজ্ঞতায় জানা আছে যে, পরের দুটো স্টপেজ থেকে যত যাত্রী উঠবেন তাতে পিছনের সিটও ভরে যাবে।
ঢাকার রাস্তায় যানজটের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তবে কোনো ব্যতিক্রম না হলে শুক্রবার সকালে রাস্তা প্রায় খালিই থাকে। খালি রাস্তায় বাস ছুটছে। পেসেঞ্জার উঠছে নামছে। আগারগাঁওয়ে আসতেই বাস প্রায় খালি হয়ে গেলো। সাকুল্যে দশ বারোজন যাত্রী। কিন্তু বাসে উঠলো তিনজন- দুজন ছেলে আর একজন মেয়ে। তিনজনই খুব সম্ভবত ক্লাশ টেন কি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।তারা বাসে উঠে একেবারে পেছনের সিটে এসে বসলো। জানালার পাশে একটি ছেলে, তারপর মেয়েটি, তারপর আরেকজন ছেলে। তারপর দুজনের খালি সিট শেষে আমি।
সম্পর্কিত খবর
আগারগাঁও থেকে মিরপুর পর্যন্ত হালকা যানজট আছে। মেট্রোরেলের কাজের জন্যই যানজট। তিনজনকে দেখলাম পাশাপাশি বসে গল্প করছে। নির্দোষ বিষয়। হকারের কাছ থেকে কেনা পত্রিকা পড়ছি। কিন্তু কোনো এক অস্বাভাবিক কারণে তাদের দিকে দৃষ্টিও রাখছি। কেনো যেনো কিছুটা বিসাদৃশ্য ঠেকছে। হয়তো বয়সের দোষ। হয়তো সব সিট রেখে পেছনের সিটে এসে বসায়।
বাস রোকেয়া স্মরনী হয়ে শেওরাপাড়ায় আসতেই স্তব্দ হয়ে গেলাম। আগেও আড়চোখে দুজন ছেলেকে মেয়েটার ঘাড়ের পেছন দিয়ে কথা বলতে দেখেছি। এবার আড়চোখেই যা দেখলাম, তাতে স্তব্দ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা। একটা ছেলে মেয়েটার পিঠে হাত বুলাচ্ছে, তার আঙুলের চালচলন দেখে বোঝা যাচ্ছে উদ্দেশ্য কি। পেপার খোলা রেখেই আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম জানালার পাশে বসা ছেলেটার হাত মেয়েটার পায়ে চাপ দিচ্ছে। ছেলে দুটোর কোনোদিকে কোনো খেয়াল নেই, বা পাত্তা দিবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেনা। অন্যদিকে মেয়েটা সেখান থেকে বের হতে চাইছে, কিন্তু চেচাতে পারছেনা বা এই ঘটনায় কি করণীয় বুঝতে পারছেনা।
সামনের সিটের যাত্রীরা যার যার স্টপেজের অপেক্ষায়। আমার উচিত ছিলো, ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু নিজের সিট থেকে উঠে আগে ওদের মুখোমুখি তাকাতেই ছেলেদুটো একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাত সরিয়ে নিলো। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম এই দুজনের মধ্যে কেউ তার বয়ফ্রেণ্ড কি না। সে জানালো ‘না’। আর ওর বন্ধুরা এরকম করবে জানলে সে ওদের সাথে বাসেই উঠতো না। এতোক্ষণে বাসের প্যাসেঞ্জারদের কেউ কেউ এগিয়ে এসেছেন। ছেলে দুটো পুরোই উদ্ধত- তারা যা ইচ্ছা করবে, আমি বাঁধা দেয়ার কে!
অত:পর ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। যাত্রীদের সামনেই দুই ছেলের মোবাইল চেক করা হলো- তাতে পর্নোগ্রাফি আছে। আছে অশ্লীল ছবি। তাদের নাম্বার দিয়েই তাদের অভিভাবকদের পুরো ঘটনা জানানো হলো। যাত্রীদের কেউ কেউ বলছিলেন, ঘটনা এখানেই শেষ করে দিতে। কিন্তু এখানে শেষ করে দিলে তারা আবার যে এমন করবেনা তার গ্যারান্টি কি! অত:পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচিত একজন কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে ফোন করতেই জানতে পারলাম তিনি কাছাকাছি আছেন। অতঃপর তার সহায়তায় মুচলেকা নিয়ে ছেলে দুটোকে অভিভাবকদের কাছ বুঝিয়ে দেয়া হলো। মেয়েটাকে নিরাপদে বাসায় পৌছে দেবার ব্যবস্থাও করে দিলেন তিনি।
এ্ই পুরো ঘটনায় শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাথে ছিলেন তিনচারজন উৎসুক জনতা। যাবার সময়ে একজন বলে গেলেন- ‘ভাই, এসবে কেনো জড়ান! দিনকাল ভালো না।’ কিছু না বলে একটা হাসি উপহার দিলাম। জানিনা তিনি সেই হাসিতে পড়তে পেরেছেন কি না- ‘ভাই, দিনকাল ভালো না বলেই তো জড়াই, জড়াতে হয়।’
আফসোস, পুরো ঘটনায় আমার লস পনেরো টাকা। ৫টাকায় কেনা বাংলাদেশ প্রতিদিন আর ১০টাকায় কেনা প্রথম আলো পত্রিকা দুটো বাসেই ফেলে এসেছি। খামোখা খামোখা কেনো যে এসবে জড়াই! ধুত্তোরি।
পুনশ্চ:
১. ঘটনাটি চলতি মাসের কোনো এক শুক্রবারের।
২. ঘটনাটি আরও রস নিয়ে বলা যেতো, কিন্তু সংক্ষেপেই বললাম।
৩. রুখে দাঁড়ান। চোখে খোলা রাখুন। আপনি আওয়াজ তুলুন, দেখবেন আপনি একা নন।
আবু সাঈদ আহমেদ: লেখক, সাংবাদিক ও এক্টিভিস্ট