• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

নজরুল সঙ্গীতচর্চা ও একজন ফিরোজা বেগম

প্রকাশ:  ২৭ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৪৫ | আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৫৫
বিনোদন ডেস্ক
ফাইল ছবি

উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলাম এক ঘোরগ্রস্ত বিস্ময়ের নাম। নজরুল সংগীতের কথা বললেই যে শিল্পির নামটি সবার আগে মনে আসে-তিনি ফিরোজা বেগম। সঙ্গীতের সব শাখাতেই অনায়াস তার যাতায়াত। স্বর ও সঙ্গীতে একনাগাড়ে ছয় দশকেরও বেশি সময় বেমালুম বুঁদ হয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব থেকে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত ফিরোজা বেগম সদর্থেই নজরুল সঙ্গীতের সুললিত অনুবাদ।

কাজী নজরুল ইসলামের গান ছিলো ফিরোজা বেগমের সাধনা। আর ব্যক্তি নজরুল ইসলাম ছিলেন ফিরোজা বেগমের অনুপ্রেরণা। নজরুল সম্পর্কে ফিরোজা বেগম বলেছিলেন, 'নজরুল মানবসাধক। বিরল এই সাধকের সানি্নধ্য আমার জীবনের প্রধান স্মৃতি ও প্রেরণা। তাঁর কাছ থেকে গান শিখে আমি প্রবেশ করেছি বাংলা সংগীতের ঐশ্বর্যময় ভুবনে। নজরুলসঙ্গীত আমাকে দিয়েছে নতুন জগতের সন্ধান, যে জগৎ মানবিক সৌন্দর্যে ভরপুর।'

সম্পর্কিত খবর

    কাজী নজরুল যখন অসুস্থ ছিলেন তখন ফিরোজা বেগমই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর গানের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নজরুল সঙ্গীতকে পৃথিবীর বহুদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও ফিরোজা বেগম আরো অনেক গুণীজনের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মলি্লক, আব্বাসউদ্দীন, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছে তিনি গানের দীক্ষা লাভ করেন। গান শিখেছিলেন উপমহাদেশের আরেক বিখ্যাত সুরকার, নজরুলের স্নেহধন্য পুরুষ কমল দাশগুপ্তের কাছেও। এই কমল দাশগুপ্তকে পরবর্তীতে ফিরোজা বেগমের জীবনসঙ্গী হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

    ১৯৪২ সালে ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়। এ রেকর্ডের গান ছিল- 'ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ' আর 'প্রীত শিখানে আয়া'। নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে।

    ১৯৬০ সালে তাঁর গাওয়া 'দূর দ্বীপবাসিনী' ও 'মোমের পুতুল' গানদুটো সঙ্গীতাঙ্গনে তুমুল আলোড়ন তোলে। ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুলগীতি এতই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, তাঁর গানের রেকর্ড লাখ লাখ মানুষ কিনতে শুরু করলো। ১৯৬৮ সালে তিনি গাইলেন 'শাওন রাতে যদি' গানটি। এই রেকর্ডটি প্রথম সপ্তাহেই দু'লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। সেসময়ে দু লাখ কপি বিক্রি ছিলো অভাবনীয় ব্যাপার।

    ফিরোজা বেগম দীর্ঘ ছয় দশক সঙ্গীতের সাথে মিশে ছিলেন। এই দীর্ঘসময়ের সফল চর্চা ও সাধনা তাঁকে কিংবদন্তীর আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি দেশে বিদেশে প্রায় ৪শ' একক সঙ্গীতানুষ্ঠান করেছেন। এছাড়াও তিনি শ্রোতাদের জন্যে ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশ করেছেন। তাঁর গাওয়া 'নূরজাহান নূরজাহান', 'আমায় নহে গো', 'মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে', 'চোখ গেলো চোখ গেলো', 'শুকনো পাতার নূপুর পায়ে', 'মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর', 'রুমঝুম রুমঝুম', 'পথ চলিতে যদি চকিতে', 'বাঁকা ছুরির মতন', 'প্রিয় এমন রাত', 'আমি যার নূপুরের ছন্দ', 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো', 'আমি গগনে গহনে সন্ধ্যা তারা', 'ওগো প্রিয় তব গান' ইত্যাদি গানগুলো ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে।

    কবি নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের মে মাসে বর্ধমানে, অন্যদিকে শিল্পী ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৮ জুলাই ফরিদপুরে। সুতরাং কবি নজরুল ও ফিরোজা বেগমর বয়সের পার্থক্য প্রায় ৩১ বছর। নজরুল তার সন্তানতুল্য ফিরোজা বেগমকে অত্যন্ত মমতায় ও দরদ দিয়ে গান শিখিয়েছিলেন। ফিরোজা বেগমও ছিলেন একজন জাত শিল্পী। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গান শিখেছিলেন। আর যে কারণে তিনি দিনে দিনে হয়ে উঠেছিলেন নজরুল সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী। পৃথিবীর সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে নজরুল সঙ্গীত মানে শিল্পী ফিরোজা বেগম আর ফিরোজা বেগম মানে নজরুল সঙ্গীত।

    নজরুল সঙ্গীত ফিরোজা বেগমকে এনে দিয়েছে স্বাধীনতাপদক, একুশেপদক, নাসীর উদ্দীন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক, দেশ সেরা নজরুল সঙ্গীত শিল্পী (অনেকবার), নজরুল একাডেমি পুরস্কার (পদক) ভারত, চুরুলিয়ার স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় সম্মান সূচক ডিলিট, গোল্ড ডিস্ক পুরস্কার (জাপান), বঙ্গ সম্মান (পশ্চিমবঙ্গ) প্রভৃতি অসংখ পুরস্কার। প্রকৃত অর্থে তিনি বড় যে পুরস্কারটি পেয়েছেন তা হলো সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close